#মিটু: নিউজরুমের বাদশাহের হাত থেকে কী ভাবে রক্ষা পেয়েছিলাম আমি

সাংবাদিকতায় তাঁর নাকি ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা, এখন তিনি রাজনীতির ময়দানে

 |  5-minute read |   12-10-2018
  • Total Shares

এক মোগল সম্রাটের নামেই তাঁর নামও রাখা হয়েছিল। তবে তাঁর হাবভাব অনেকটা গ্রামের ঠাকুরদের মতো। 'নতুন' কিছু পছন্দ হলেই তার উপর যেন তাঁর অধিকার জন্মে যায়।

অফিসের করিডরে যদি এই সম্পাদকের সঙ্গে কখনও দেখা হয়ে যায় তাহলে তাঁর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার একটাই উপায় আছে - কোনও মতে সেখান থেকে পালিয়ে যাও। শুরুর দিকে আমিও সেই চেষ্টা করে দেখেছি। কিন্তু এক সময় আর না পেরে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে দিল্লি পালিয়ে এসেছি।

অনেকেই অবশ্য তা করেনি।

আশির দশকের শেষের দিকে কলকাতায় একটি নতুন সংবাদপত্রে শিক্ষানবিশ হিসেবে আমার কর্মজীবনের শুরু। ওখানে যোগ দেওয়ার প্রধান কারণ আমাদের বলা হয়েছিল, আমাদের পেশায় তিনি নাকি ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভার অধিকারী। সেই সময় আমি রাসেল স্ট্রিটে এক বয়স্ক পার্সি দম্পতির বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতাম আর প্রতিদিনই বাসে চেপে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে আনন্দবাজারের দপ্তরে কাজ করতে যেতাম।

body_101218030009.jpgমোগল সম্রাটের দরবার [সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স]

এই আনন্দবাজারের দপ্তরে বসে বাদশাহ নিজের সাম্রাজ্য চালাতেন। শুরুতে আমার মতো একজন শিক্ষানবিশ সাংবাদিকের সঙ্গে বেশ ভালো ব্যবহার করতেন তিনি। গোটা বিশ্বের খবরগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোকে বাছাই করার গুরুদায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় আমার মনে হয়েছিল যে এক হয় আমি অসামান্য প্রতিভাবান আর তা না হলে আমার বাবাও এই পেশায় ছিলেন বলে সম্পাদক মশাই আমাকে সুনজরে দেখতেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। দপ্তরে কাজ করা বন্ধুদের কাছে জানতাম পারলাম যে তিনি নাকি নতুনদের দেখলেই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।

নানান ছল-চাতুরী করে তাঁকে এড়িয়ে চলতে শুরু করতাম - কিন্তু লোকটি কিছুতেই পিছু ছাড়তেন না।

একদিন তো আমার বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। বৃদ্ধা বাড়িওয়ালিকে দিয়ে বলতে পাঠালাম যে আমি বাড়ি নেই। পরের দিন আমার ডাক পড়ল তাঁর কেবিনে। কলকাতায় আমি কেমন আছি সে বিষয় খোঁজ খবর নিয়ে আমাকে তিনি জানালেন যে তিনি "পভার্টি অ্যান্ড টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি" নামের একটি সিরিজের উপর কাজ করছেন এবং আমার বাড়ির তলায় নাকি অনেক ফুটপাথবাসী থাকেন। সেই কারণেই গতকাল তাঁর আমার বাড়িতে আগমন ঘটেছিল।

সত্যিই কি তাই?

body1_101218030041.jpgসম্রাট সম্পাদকের সাম্রাজ্য

উনি সেই সময় দারিদ্র্য নিয়ে লিখছিলেন সেটা আমি জানতাম। কিন্তু সেদিন তিনি সত্যি সত্যি রাসেল স্ট্রিটের ফুটবাসীদের ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন কি না সে ব্যাপারে আমি আজও নিশ্চিত নই। তবে এর পরে মাঝে মধ্যেই উনি আমাকে কোনও কারণ ছাড়াই ঘরে ডেকে পাঠাতেন।

কয়েক মাস বাদে আমার একটি বয়ফ্রেন্ড হয় (পরবর্তীকালে যে আমার মেয়ের বাবা হন)। তিনি সেই সময় আমাদের নিউজডেস্কে সাব-এডিটর পদে চাকরি করতেন। হঠাৎ করে শিলিগুড়িতে বদলি করে দেওয়া হল সাংবাদিক হিসেবে। যদিও, কাজের দিক থেকে সুযোগটা বেশ লোভনীয় কারণ সেই সময় দার্জিলিংয়ে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন জোর কদমে চলছিল। কিন্তু সেই সময় অফিসে আমার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে হাসাহাসি শুরু হয়েছিল যে তাঁর নতুন শিকারের মাঝে কোনও অযাচিত তরুণ যাতে না থাকতে পারেন সেই কারণেই ধর্মাবতার সম্পাদক মশাই নাকি আমার বয়ফ্রেন্ডকে বদলি করে দিয়েছেন।

body2_101218030144.jpgকে জানে সেদিন তিনি সত্যিই রাসেল স্ট্রিটের ফুটবাসীদের ইন্টারভিউ নোয়েছিলেন কি না [ছবি: রয়টার্স]

তখনও আমি তাঁকে এড়িয়ে চলতাম এবং তখনও আমি নতুন নতুন কাজের সুযোগ পেয়ে চলতাম। সানডে পত্রিকার কভার স্টোরির জন্য এরপর আমাকে ওড়িশা পাঠানো হল। সেই খবরটা রাজ্যের গ্রামাঞ্চলের এক বাসিন্দাকে নিয়ে ছিল যাঁর স্ত্রীর সংখ্যা একশো। এই ভদ্রলোক পেশায় কৃষক এবং এক সঙ্গে একশো জন স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটাননি। একজনকে ছেড়ে অন্যজনকে বিবাহ করেছেন এবং সেই সময় তিনি অতীতের বহু স্ত্রীদের বর্তমান খবর জানতেন না। আমার জীবনের প্রথম কভার স্টোরি। আর কী আশ্চর্য এখন যে বিষয় নিয়ে লিখছি তার সঙ্গে সেই কভার স্টোরির বিষয়বস্তুর প্রভূত মিল রয়েছে।

যাই হোক, এদিকে আবার আমার কাছে আরও একটি কাজের সুযোগ এল। আমাকে বলা হল যে বিংশ শতাব্দীর দারিদ্র্য নিয়ে তিনি যে কাজ করছেন সেই বিষয় কিছু গবেষণা করতে আমাকে আবার ওড়িশা যেতে হবে।

body3_101218030243.jpgখোলা দরজায় কিন্তু অনেক ধরণের সুযোগ রয়েছে [সৌজন্যে: উইকিমিডিয়া কমন্স]

এর মাঝে অবশ্য আরও একটি বিশ্রী পরিস্থিতি এড়ানো গিয়েছিল। আমাকে আবার তাঁর ঘরে ডেকে পাঠানোর হয়েছিল কিছু অপ্রয়োজনীয় আলোচনার জন্য। একটা সময় তিনি আমার খুব কাছে চলে এসেছিলেন কিন্তু ঠিক সময় তার সেক্রেটারি ঘরে ঢুকে পড়েন। আমার কেন জানি না মনে হয় যে এই সেক্রেটারি তাঁর বসের স্বভাব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন বলেই তিনি আমাকে রক্ষা করতে সেদিন সে ঘরে ঢুকেছিলেন।

এর এক বছরের মধ্যে আমি দিল্লি চলে আসি এবং এখন থেকেই আমি আমার ইস্তফাপত্র পাঠাই। এরপর আমার সেই সম্রাট সম্পাদক হাতে লেখা একটি চিঠি পাঠান আমাকে। সেখানে তিনি আমি আর আমার বয়ফ্রেন্ডকে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান।

body4_101218030335.jpgঅঞ্চলিক সংবাদপত্রে যৌন হেনস্তার খবর আরও বেশি

লোকটি কোনও দিনও আমার গায়ে হাত দেননি ,কিন্তু আমি জানি বস হিসেবে তিনি আমাকে হেনস্থা করতে চেয়েছিলেন। এর পর আমার অনেক সহকর্মীদের আচরণ ঠিক ছিল না। কিন্তু তাদের আচরণ কোনও মতেই ভীতিপ্রদ ছিল না। আমার মতে, নারী পুরুষ নির্বিশেষেই অন্য লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ মানুষের প্রাকৃতিক স্বভাবের মধ্যেই পড়ে। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি উপায় সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলুন।

কিন্তু আমার প্রথম চাকরির অভিজ্ঞতা একেবারে অন্যরকম ছিল। আমি একজন শিকারির সঙ্গে কাজ করছিলাম যাঁর শিকারের সংখ্যা নেহাতই মন্দ নয়। তিনি এতটাই প্রতিভাবান যে তিনি মনে করতেন প্রতিভার জোরেই তিনি এরকম আচরণ করতে পারেন।

সাংবাদিকতা জয় করে তিনি এখন রাজনীতির মাঠে প্রবেশ করেছেন।

আমার কর্মজীবনে আমি এই ধরণের খবর প্রচুর শুনেছি যেখানে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নিগ্রহের শিকার হয়েছেন মহিলারা। এখন সেই খবরগুলোকে প্রকাশ্যে আনার মাধ্যম হয়ে উঠেছে #মিটু আন্দোলন। কিন্তু এই আন্দোলনে সংবাদমাধ্যম জগতের খবরগুলো শুধুমাত্র ইংরেজি পত্রিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। যদিও এই ধরণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে আঞ্চলিক সংবাদপত্রগুলোর দপ্তরে।

এই বিষয় নিয়ে লিখতে আমার ভালো লাগছে না। তাও লিখছি যাতে ভবিষ্যতে পুরুষ বসেরা একটু সতর্ক থাকেন।

বহুবছর বাদে সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়েছিল। কোনও সন্দেহ নেই আমার সম্পাদকদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে খারাপ মানুষ ছিলেন।

আমি বিপদের আশঙ্কা করে পালাতে পেরেছিলাম।

অনেকেই পারেননি। আবার অনেকেই বোকার মতো ওনাকে 'ভালোবেসে' ফেলেছিলেন। কিন্তু শিকারি তো শুধু শিকারই খুঁজবেন।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SABA NAQVI SABA NAQVI @_sabanaqvi

Eminent political journalist and writer. Author, most recently of Shades of Saffron: From Vajpayee To Modi

Comment