মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ঘরের' আসন কলকাতা দক্ষিণ কেন তৃণমূলের জন্য সুরক্ষিত নয়
এক দশকে বাঙালি কমেছে, সংখ্যা বেড়েছে গুজরাটি মাড়োয়ারি ও হিন্দি বলয়ে থেকে আগত ভোটার
- Total Shares
১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচন। দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছেন কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রতিপক্ষ সিপিএমের হেভিওয়েট প্রার্থী বিপ্লব দাশগুপ্ত। সকলেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের প্রত্যাশা করেছিলেন। না করার কোনও কারণ নেই। কারণ সেই ১৯৫২ সাল থেকেই কোনও একটি নির্দিষ্ট দল এই আসনটিতে নিজেদের মৌরুসি পাট্টা কায়েম করতে পারেননি।
এই আসনটি থেকে যেমন সিপিআই প্রার্থী সাংসদ হয়েছেন, তেমনি সিপিএম প্রার্থীও জিতেছেন। কংগ্রেসের প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি কিংবা ভোলানাথ সেনও এই আসন থেকে সংসদ হয়েছিলেন। আবার ভারতীয় লোক দল এমনকি নির্দল প্রার্থীও এই আসনে জয়লাভ করেছিলেন। সুতরাং ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে ১৯৯১ সালেও এই আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।
অবশেষে সেই লড়াইয়ে জিতলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৯৩,৬৬৩ ভোট নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের বিপ্লব দাশগুপ্তকে পরাজিত করে। মমতার প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৫১.৫ শতাংশ।
এই জয় স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু এই জয়ের পরেই এই আসনে অন্য একটি ইতিহাসের সৃষ্টি হল।
সেই ১৯৯১ সাল থেকেই দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে নিজের মৌরুসি পাট্টা কায়েম করেছিলেন মমতা বদ্যোপাধ্যায় [সৌজন্যে: ইন্ডিয়া টুডে]
১৯৯১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক পরিচয় কী ছিল? একজন তরুণ প্রদেশ কংগ্রেস নেত্রী যিনি ১৯৮৪ সালে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে সিপিএমের সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে (পরে লোকসভার অধ্যক্ষ হয়েছিলেন) হারিয়ে রীতিমত 'ঝড়' তুলে সাংসদ হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে আবার সেই কেন্দ্র থেকেই সিপিএমের মালিনী ভট্টাচার্যের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
অর্থাৎ একটি কেন্দ্র থেকে হেরে দু'বছরের মধ্যে অন্য একটি কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন মমতা - এই ছিল তাঁর পরিচয়।
কিন্তু ১৯৯১ সালের দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্র থেকে জয়ের পর আর সেই অর্থে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মমতাকে। দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্র আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে সমার্থক হয়ে পড়েছিলেন। ইতিহাস বলছে এর পর মোট পাঁচবার - ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০৪ ও ২০০৯ - এই কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়েছেন মমতা। পাঁচবারই জিতেছেন। পাঁচ বারই নিজের জয়ের ব্যবধান বাড়িয়েছেন।
২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে তিনি তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের রবিন দেবকে ২ লক্ষ ১৯ হাজার ভোটে পরাজিত করেছিলেন। প্রাপ্ত ভোটের হার ৫৭.১ শতাংশ।
১৯৯১ সাল থেকে ২০১৯। আদি গঙ্গার দু'পাশে প্রচুর পরিবর্তন দেখা গিয়েছে এই ২৮ বছরে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাংলার ক্ষমতা পরিবর্তন। ২০১১ সালে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের রাজত্ব শেষ করে বাংলার মসনদ দখল করেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। তাঁর তৃণমূল কংগ্রেসই এখন পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল। কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রও এখন তৃণমূলের দখলে।
২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর উপনির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্র থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবর্তে তৃণমূল প্রার্থী হন সুব্রত বক্সী। এর পর ২০১৪ লোকসভাতেও সুব্রত বক্সীকেই প্রার্থী করে তৃণমূল। এই আসনটি এখনও মমতার দখলে থাকলেও শেষ দুটি নির্বাচনে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের হার অনেকটাই কমেছে।
শুধু লোকসভা নির্বাচন নয়, দক্ষিণ কলকাতার কেন্দ্রের অন্তর্গত বিধানসভা ও পুরসভা কেন্দ্রগুলোতেও তৃণমূলের ভোট কমেছে [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
২০১১ সালের উপনির্বাচনে যেখানে সুব্রত বক্সী সিপিএমের ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে দু'লক্ষ তিরিশ হাজারের বেশি ভোটে হারিয়েছিলেন সেখানে ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে সুব্রত বক্সীর সঙ্গে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, বিজেপির তথাগত রায়ের ভোটের ব্যবধান ছিল ১,৩৬,৩৩৯। অর্থাৎ দেড় লক্ষেরও কম। তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের হার নেমে দাঁড়িয়েছিল ৩৬.৯৫ শতাংশে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্র যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের কেন্দ্র বলে পরিচিত, তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা উত্তরোত্তর কমছে কেন?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই কেন্দ্র থেকে আর প্রার্থী হচ্ছে না বলে কি? ভোটের ফলাফল কিন্তু অন্য কথা বলছে। এই কেন্দ্রে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে বিজেপি প্রার্থী জ্যোৎস্না বন্দ্যোপাধ্যায় মাত্র ৩৯,৭৪৪ ভোট পেয়েছিলেন এবং তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৩.৯৫ শতাংশ। সেখানে ২০১৯ সালে তথাগত রায় ২,৯৫,৩৭৬টি ভোট পেয়েছিলেন এবং তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ২৫.২৮ শতাংশ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার ২১.৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এই কেন্দ্রে।
এই তথ্য থেকে একটা বিষয়ে পরিষ্কার এই কেন্দ্রে তৃণমূলের, সিপিএম ও কংগ্রেসের ভোট বাক্সে অনেকটাই থাবা বসিয়েছে বিজেপি। কারণ শেষ কয়েকটি নির্বাচনে এই তিনটি দলের প্রাপ্ত ভোটের হার অনেকটাই কমেছে।
দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা নির্বাচন কেন্দ্রে মোট সাতটি বিধানসভা আসন রয়েছে - বেহালা পূর্ব ও পশ্চিম, রাসবিহারী, বালিগঞ্জ, কসবা ও ভবানীপুর। শুধুমাত্র ২০১৪ লোকসভা নির্বাচন নয় ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে এই সাতটির মধ্যে ছ'টি আসনেই তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের হার অনেকটাই কমেছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিজেপির ভোট।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্র। ২০১১ সালের উপনির্বাচন থেকে এই কেন্দ্রে প্রার্থী হচ্ছেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে (পুনর্বিন্যাসের পর ২০১১ সালে গঠিত হয়েছিল এই কেন্দ্র) উপনির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে সুব্রত বক্সী ৮৭,৯০৩টি ভোট পেয়েছিলেন। এর পর উপনির্বাচনে মমতা ৭৩,৬৬৫টি ভোট পেয়েছিলেন এবং তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৭৭.৪৬ শতাংশ। সেখানে ২০১৪ সালে এই কেন্দ্র থেকে মমতার প্রাপ্ত ভোট ৬৫,৭২০। প্রাপ্ত ভোটের হার ৪৭.৬৭ শতাংশ।
অনেকে তৃণমূল সমর্থক মনে করেন যে ২০১১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে বেঁধেছিল তৃণমূল তাই ২০১৬ সালে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা কমেছে। মানে, ২০১৬ সালে কংগ্রেস সমর্থকরা এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী দীপা দাশমুন্সিকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে পাল্টা প্রশ্ন উঠতে পারে বিজেপি এর ভোট পেল কী ভাবে? ২০১১ সালে বিজেপি প্রার্থী দেয়নি এই কেন্দ্র থেকে। আর ২০১৬ সালে ২৬,২৯৯টি ভোট পেয়েছিল। প্রাপ্ত ভোটের হার ১৯.১৩ শতাংশ।
২০১৫ সালে পুরসভা নির্বাচনে বিজেপির মোট সাতজন কাউন্সিলর হয়েছিলেন। এর মধ্যে তিন জন দক্ষিণ কলকাতার অন্তর্গত বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে জিতেছিলেন।
শুধুমাত্র মোদী ম্যাজিক নয়, স্থানীয় নির্বাচন বিশ্লেষকরা দক্ষিণ কলকাতায় বিজেপির এই উত্থানের পিছনে অন্য একটি কারণও খুঁজে পাচ্ছেন। এলাকার জনবিন্যাস অর্থাৎ ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের এক বৃহদংশই বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে হয়ে গিয়েছে।
দক্ষিণ কলকাতায় এমন বাসিন্দাদের সংখ্যা বেড়েছে যাঁরা আদতে বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক [ছবি: পিটিআই]
একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এই অঞ্চলগুলোতে বিশেষ করে পুর ভবানীপুর বিধানসভার অন্তর্গত অঞ্চল ও রাসবিহারী ও বালিগঞ্জ বিধাসভার অন্তর্গত কিছুটা অঞ্চল থেকে বাঙালি বাসিন্দারা বেশ কয়েক বছর ধরেই অন্যত্র সরে যেতে শুরু করেছেন। বিগত বছর দশেক ধরেই এই অঞ্চলের পুরোনো বাড়িগুলো ভেঙে তার জায়গায় এক হয় অফিস বাড়ি নয়তো বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হয়েছে। আর, এই অ্যাপার্টগুলোতে যাঁরা আসছেন তারা মূলত গুজরাটি ও মাড়োয়ারি - যাঁদের অধিকাংশই বিজেপির ভোটার।
এছাড়া এই অঞ্চলে বরাবরই হিন্দি বলয়ের মানে বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দাদের উপস্থিতি চোখে পরার মতো। যাঁরা মূলত বিভিন্ন ধরনের চালক হিসেবে বা চায়ের দোকান কিংবা অন্যান্য ছোটখাটো ব্যবসা করে দিন গুজরান করেন। সিপিএমের আমলে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক বাড়াতে এদের অনেককেই সচিত্র পরিচয়পত্র করে দিতে সাহায্য করেছিল তৃণমূল। কিন্তু এখন বাংলায় বিজেপির পা কিছুটা শক্ত হওয়ায় তাঁরা বিজেপি সমর্থক হয়ে উঠেছেন। সব মিলিয়ে, দক্ষিণ কলকাতার একটি অংশ জুড়ে বাঙালি ভোটারের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ও অবাঙালি ভোটারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তৃণমূলের ভোট কমছে। একই সঙ্গে বিজেপির ভোট বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আরও একটি জিনিস লক্ষ করা যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের বাঙালিদের বিজেপিকে সমর্থনে কোনও কুণ্ঠা নেই, তাঁরা সর্বদাই উন্নয়নের পক্ষে। আর এই প্রজন্মের বাঙালি ভোটারদের একাংশের ভোটও বিজেপির ঝুলিতে ঢুকছে।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পর ভারতের শাসনব্যবস্থা কোন দলের হাতে যাবে কিংবা এই প্রথম কোনও বাঙালি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন কি না তার উত্তর ভবিষ্যতে জানা যাবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরের আসন দক্ষিণ কলকাতা যে আর তৃণমূলের জন্য সুরক্ষিত নয়, সেই ইঙ্গিত পাওয়া শুরু হয়ে গেছে।