বিশ্ব বন্যপ্রাণী সপ্তাহ: ভারতে এই সপ্তাহটাই সবচেয়ে খারাপ কাটল কেন?

গিরে ২৩টি সিংহের মৃত্যু, মধ্যপ্রদেশে মানুষখেকো বাঘিনী অবনীর খোঁজ চলেছে

 |  4-minute read |   08-10-2018
  • Total Shares

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ব বন্যপ্রাণী সপ্তাহ পালন করল ভারত। তবে এই সপ্তাহটি দেশের বন্যপ্রাণীদের নিরিখে জঘন্যতম সপ্তাহ রূপে দেখা দিল।

গুজরাটের গিরে এক মাসের মধ্যে কমপক্ষে ২৩টি সিংহ মারা গিয়েছে। এর ফলে ওই অঞ্চলে মহামারীর আশঙ্কা দানা বাঁধছে। দেশজুড়ে বাঘেদের অবস্থাও বেশ খারাপ। মহারাষ্ট্রে বনদপ্তরের কর্মীরা এক মানুষখেকো বাঘিনীকে গুলি করে মারার চেষ্টা করে চলেছে। অন্যদিকে, অসমে ‘গো-হত্যার' দায়ে আরেকটি বাঘিনীকেই বন্দি করার চেষ্টা করে চলেছেন সেখানকার বন দপ্তরের কর্মীরা।

এই ঘটনাগুলো থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার - সংরক্ষিত বনানঞ্চলগুলোতে দুটি জিনিসের প্রয়োজন রয়েছে - বিজ্ঞান ও মাঠে নেমে কাজ করার পারদর্শিতা। আপাতত এই দুটি বিষয়ের ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ভারতের কাছে সিংহের গুরুত্ব অপরিসীম। অশোক স্তম্ভে সিংহের ছবি রয়েছে। দেশের প্রতিটি নোটেও সেই ছবি শোভা পায়। দেশের জাতীয় প্রতীকে চার চারটি সিংহের ছবি রয়েছে এবং ১৯৭২ সাল অবধি সিংহই আমাদের দেশের জাতীয় পশু ছিল। সিংহকে এখনও আমরা পশুরাজ হিসেবে গণ্য করি। যদিও সিংহের পরিধি এখন অনেকটাই কমেছে, সিংহ সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলের কিন্তু অন্ত নেই।

সাহিত্যেও সিংহের প্রবেশ অবাধ। যেমন সি ডাব্লু লুইসের 'ক্রনিকলস অফ নর্নিয়া'।

এত কিছু সত্ত্বেও সিংহকেও দেশের রাজনীতির শিকার হতে হয়েছে।

বহুবছর আগে, মধ্যপ্রদেশেকে কয়েকটি সিংহ দেওয়ার জন্যে গুজরাটকে নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। এর কারণ এশিয়াটিক সিংহরা একমাত্র গুজরাটেই রয়েছে। কিন্তু গুজরাট সেই 'ভাগ বাঁটোয়ারায়' রাজি হয়নি। উল্টে, রাজ্যের তরফ থেকে বলা হয়েছিল যে তারা সিংহদের শারীরিক শুশ্রূষার জন্য যথাপোযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।

সবকটা ডিম একই বাক্সে থাকলে যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

body_100818044601.jpgরাজনীতি এবার বিপদে ফেলল পশুরাজ সিংহকে [ছবি: রয়টার্স]

একই জায়গায়কার সিংহদের মধ্যে বছরের পর বছর প্রজনন হতে হতে মহামারীর আশঙ্কা দেখা দিতেই পারে।

আর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পাঁচ বছরের মধ্যে গুজরাটে এক মাসে ২৩টি সিংহ মারা গেল। তাও এটা সরকারি হিসেবে। সূত্র বলছে ৫০টির কাছাকাছি সিংহ মারা গিয়েছে।

এদের অনেকেই নাকি এমন একটি রোগের শিকার হয়েছে যা বাড়ির পোষা কুকুরেরও হয়ে থাকে আর এই রোগটি প্রতিরোধের জন্যে পোষ্যদের টিকা দেওয়া হয়ে থাকে। বেশ কয়েকটি সিংহের বিষক্রিয়া ও নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ের ফলে মৃত্যু হয়েছে।

আর এখানেই বিজ্ঞান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারত।

জীববিদ্যায় বলা হয়ে থাকে যে বন্যপ্রাণীরা উপযুক্ত পরিবেশেই সুস্থ থাকতে পারে।

বিজ্ঞান এও বলছে যে বন্যপ্রাণীদের মাত্রাতিরিক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন নেই কারণ তা প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ।

body1_100818044658.jpgগুজরাট সিংহদের নিয়ে ভাগ বাটোয়ারায় রাজি হয়নি [ছবি: রয়টার্স]

গুজরাট এখন সিংহদের জন্য ৩০০টি টিকাকরণের নির্দেশ দিয়েছে। কোনও রকমে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করা হচ্ছে। এবং, এর ফলে কিন্তু একই বাক্সে সবকটি ডিম থাকার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে যখন এর সমস্যার থেকেই মহামারীর আশঙ্কার সূত্রপাত।

বন্যপ্রাণী সপ্তাহে গুজরাট আরও একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাজ্যের বরোদা অভয়ারণ্যে তারা কয়েকটি সিংহকে স্থানান্তরিত করতে চায়।

কিন্তু এই সমাধানটিও কেমন জানি 'লোক দেখানো' সমাধান হিসেবে মনে হচ্ছে।

আয়তনে বরোদা খুবই ছোট - মেরেকেটে ৩০০ বর্গকিলোমিটার। সবচেয়ে বড় কথা গির থেকে এর ভৌগোলিক দূরত্ব খুব বেশি নয় - মাত্র ১০০ কিলোমিটার হবে। সুতরাং এই সিদ্ধান্তে যে মহামারীর আশঙ্কা মুছে যাবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

বহু যুগ ধরেই গুজরাটের বনদফতর সিংহদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। তাই তাদের আমি রীতিমতো শ্রদ্ধা করি।

কিন্তু, এবার বিজ্ঞানের উচিত রাজনীতিকে টেক্কা দেওয়া। সিংহদের দূরে কোথাও কোনও এক বড় অভয়ারণ্যে পাঠাতেই হবে। সুপ্রিম কোর্ট ও ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া মধ্যপ্রদেশের কুনো অভয়ারণ্যকে এর জন্য বেছে নিয়েছে।

body2_100818044807.jpgশখের শিকারি শাফাত আলি [সৌজন্যে: ইউটিউব]

এদিকে, দেশের অন্য প্রান্তে অবনী নামক একটি বাঘিনীকে নিয়ে নাটকের সৃষ্টি হচ্ছে। দুই বাচ্চার মা এই বাঘিনী নাকি মানুষখেকো হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রদেশের বনদপ্তর হন্যে হয়ে যাবতমল অঞ্চলে এই বাঘিনীটির সন্ধান করে বেড়াচ্ছে।

এই কাজে খুব বাজে একটি সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। শাফাত আলি খান নামের এক শিকারিকে নিয়োগ করে। আলি এর আগে অনেক মানুষখেকোকেই গুলির করেছেন। তিনি শখের শিকারিও বটে। আলি সাধারণত দাবি করে বেড়ান যে শিকার ব্যাপারটি তাঁর রক্তে রয়েছে এবং তাঁর ঠাকুরদা তো বাঘেদের 'কুকুরের' মতো গুলি করে মারতেন। বাঘ বা চিতার দেহের পাশে বসে বেশ কয়েকবার ছবিও তুলেছেন আলি এবং তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছিল।

মহারাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন পশুচিকিৎসক খানকে দিয়ে বাঘিনীকে অজ্ঞান করার বিষয়টিতে বাধা দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য কোনও পশুকে অজ্ঞান করা একেবারে সহজ কাজ নয়, ভুল হলে বাঘের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সুতারং শুধুমাত্র পশু চিকিৎসক দ্বারাই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যেতে পারে। বেশ কয়েকজন পশুপ্রেমী জানিয়েছেন যে খানকে এই অভিযানে কোনও মতেই রাখা যাবে না।

body3_100818044904.jpgঅবনীর বাচ্চাদের কী হবে?

এরই মাঝে বাঘিনীর খোঁজ চলছে। তাকে এক হয় বন্দি করে হবে না হয় গুলি করা হবে। তার বাচ্চাদের কী হবে সে নিয়ে এখনও অবধি কেউই নিশ্চিত নয়।

বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ যাই হোক না কেন সে ব্যবপারে সিদ্ধান্ত আগে নিতে হবে।

সর্বপ্রথম খোঁজ নেওয়া উচিত যে বাঘিনী আদৌ মানুষখেকো কি না। এটাই প্রথম পদক্ষেপ। যদি সত্যি হয় থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে। এর পাশাপাশি বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তাভাবনা করতে হবে। খুব সম্ভবত বাচ্চাদের জঙ্গলেই রাখা হবে কিন্তু বিশেষ নজরদারির মধ্যে। আর, এই কাজ কোনও শখের শিকারির দ্বারা সম্ভব নয়।

বছরটা দেশের বন্যপ্রাণীদের জন্য একদমই ভালো যায়নি। যদিও এর মধ্যে কয়েকটি সাফল্যও এসেছিল। বন্যপ্রাণী সপ্তাহ উদযাপনের মাঝে আমাদের নজর দিতে হবে যেন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বিজ্ঞানই শেষ কথা হয়।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

NEHA SINHA NEHA SINHA @nehaa_sinha

Neha Sinha is a wildlife conservationist, and lover of the weird, wonderful, wordy and wild.

Comment