লাদাখ: জম্মু-কাশ্মীরের তৃতীয় ও সবচেয়ে অবহেলিত অংশ

৩৭০ ধারা অন্য প্রশ্ন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক বিকাশ ও সুশাসন না দেওয়া বড় ভুল

 |  6-minute read |   11-08-2018
  • Total Shares

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০০০ মিটার উচ্চতায় আকাশি-নীল রঙের জাঁসকার নদীর একটি উপনদীর প্রায় তীরে অবস্থিত ছোট্ট একটা গ্রাম, লাদাখের সুমদা চুন। এই প্রথমবার গ্রামের হাজার বছরের ইতিহাসে গত বছর একটি মোটর-চলাচলের যোগ্য সড়ক তৈরি করা হল। গ্রামটিতে অবশ্য হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার বসবাস করে। 

৬০ কিলোমিটার দূরে লাদাখের রাজধানী লে যেতে হলে, প্রথমে দু-ঘণ্টা হেঁটে হাইওয়েতে পৌঁছাতে হত। আর এখন গাড়িতে পুরো রাস্তাটি যেতে ৯০ মিনিট সময় লাগে। সড়কটির সুফল ইতিমধ্যেই সেখানকার মানুষ পেতে শুরু করেছেন। যেমন ধরুন, আগে ওই অঞ্চলে তরমুজ ছিল দুষ্প্রাপ্য। ঠান্ডার মধ্যে বরফের মরুভূমি পেরিয়ে ভারবাহী পশুর পিঠে চাপিয়ে তরমুজ পাহাড়ের চড়াই ভেঙে গ্রামে আনা হত। এখন বাড়িতে অতিথি এলে তাঁদের অভ্যর্থনায় তরমুজ দেওয়া হয়।

1_081118084417.jpgআকাশি নীল রঙ জাঁসকার নদী

সড়ক ধরে আধুনিক বিলাস-সামগ্রী এখানে সহজলভ্য হয়েছে, সৌর শক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। তবে এই সব সুবিধার ফলে সুমদা চুনের মানুষ নতুন সব সমস্যার সম্মুখীনও হচ্ছেন।

ওখানকার স্থানীয় একটি বৌদ্ধগুম্ফা, যেটি সম্ভবত দ্বাদশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল, সেই গুম্ফাটির বাইরের দেওয়ালে অসাধারণ সমস্ত মাটির ও কাঠের কারুকাজ করা রয়েছে। দেওয়ালের গায়ে দারুণ সব হাতে আঁকা ছবিও রয়েছে। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলের খুঁটিনাটি নিয়ে যে সব ইতিহাসবিদরা কাজ করেন, তাঁদের মতে গুম্ফাটির গায়ের কারুকাজ এবং চিত্র অনন্য এবং অমুূল্য। ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড অনুসারে পৃথিবীতে যে সব ঐতিহ্যমণ্ডিত অনন্য নিদর্শন খুব দ্রুত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে, সেগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। যাঁরা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের চোরাব্যবসা করে, দীর্ঘদিন ধরেই তাদের এই গুম্ফাটির গায়ের অমূল্য সব কারুকাজ ও চিত্রের উপরে নজর রয়েছে। গুম্ফাটির একটি কক্ষে ছাদের গায়ে একটি কারুশিল্পের নিদর্শন রয়েছে। সেই কাঠের ছাদের মাঝামাঝি একটি সুড়ঙ্গ মতো করা রয়েছে যার ভেতরে হাতে আঁকা একটি ছবি বসানো ছিল। ছবিটি আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে চুরি হয়ে যায়।

2_081118084516.jpgআধুনিকতা এসেছে, তবে ঐতিহ্য এখন প্রশ্নের মুখে

এবার এই সড়কটি তৈরি হওয়ার ফলে অন্যান্য জায়গার সঙ্গে গ্রামটি যুক্ত হয়ে গেছে বটে, তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের কপালে চিন্তা ভাজ পড়েছে কারণ তাঁদের মতে এই সড়কটি দিয়ে খুব সহজেই এই সব চোরা কারবারিরা গ্রামে ঢুকে আসতে পারবে এবং ওখানকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তাদের কাছে খুব সহজলভ্য হয়ে উঠবে।

গিরিবর্ত্মের দেশ লাদাখ

লাদাখ হল জম্মু-কাশ্মীরের এমন একটি অংশ যেখানে জনবসতি খুবই অল্প। দিল্লি থেকে আকাশপথে লাখাদ যেতে মোটে দু'ঘন্টা সময় লাগলেও মনে হয় জায়গাটা যেন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। মাথার উপরে খোলা নীল আকাশ আর সামনে বিস্তৃত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পাশাপাশি অনন্য একটি সংস্কৃতি জায়গাটাকে একটা আলাদা পরিচয় এনে দিয়েছে। সমতল থেকে জায়গাটি প্রায় ৩,৫০০ মিটার উঁচুতে তাই বিমান থেকে লে-তে থেকে অবতরণ করার পরে পর্যটকদের সাময়িক অস্বস্তি হতে পারে, তবে অল্পক্ষণের মধ্যেই তা ঠিক হয়ে যায়।

মোট জনসংখ্যা তিন লক্ষের মতো হওয়া সত্ত্বেও লাদাখ ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পূর্বদিকে রয়েছে চিন যার মধ্যে জনশূন্য জায়গা আকসাই চিনও রয়েছে। সীমান্ত এলাকাটি বেশ উত্তেজনাপূর্ণ, এখানে ভারত ও চিনের সোনা সর্বক্ষণ মোতায়েন রয়েছে। মাঝেমধ্যে দুই দেশের সেনার মধ্যে সংঘর্ষও বেধে যায়। পশ্চিমে জায়গাটিকে ঘিরে রেখেছে পাকিস্তান যারা এই জা.গাটি তাদের বলে দাবি করে। শুধু এই অঞ্চলটিই নয়, কার্গিল ও সিয়াচেন হিমবাহও নিজেদের বলে দাবি করে পাকিস্তান। পৃথিবীর সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র সিয়াচিন হিমবাহ পার হলেই শুরু পাক অধিকৃত কাশ্মীর। ভারতীয় সৈন্যের একটি বড় অংশ সবসময় লাদাখে মোতায়েন রয়েছে। পাশাপাশি বর্ডার রোড অর্গানাইজেশনের ট্রাক সব সময় এই রাস্তা দিয়ে সশব্দে যাতায়াত করে চলেছে।

3_081118084557.jpgগুম্ফাটির বাইরের দেওয়ালে অসাধারণ সমস্ত মাটির ও কাঠের কারুকাজ রয়েছে

সুমদা চুনের মানুষ আধুনিক সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি তাদের পারম্পরিক জীবনযাত্রার সঙ্গে আধুনিকতার সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এই বদল যেমন তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের উপর প্রভাব ফেলেছে তেমন ভাবেই প্রশাসনের উপরেও প্রভাব ফেলেছে।

লাদাখের খুব অল্প সংখক মানুষ জম্মু ও কাশ্মীরে বসবাস করেন। তাঁদের অভিযোগ, রাজ্য সরকার তাঁদের উপেক্ষা করে, তাই অনেকেই একটি কেন্দ্রশাসিত স্বতন্ত্র অংশ বলে ঘোষণার দাবি করছে। কিন্তু সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী এই দাবি মানার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

4_081118084621.jpg

5_081118084655.jpgসীমান্ত এলাকাটি উত্তেজনাপূর্ণ, সীমান্ত দু-পারে মোতায়েন থাকে দু-দেশের সেনা

অনেক আলাপ আলোচনার পরে অবশেষে ১৯৯৫ সালে প্রত্যক্ষ স্বায়ত্তশাসনের উন্নতির কথা মাথায় রেখে অটোনমাস হিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল গঠন করা হয়। তবে যে অর্থনৈতিক উন্নতির কথা বলা হয়েছিল সেগুলিও পরিপূর্ণ হয়নি। তাই লাদাখের বহু মানুষকে উচ্চশিক্ষা ও চাকরির সুযোগ পেতে দেশে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে যেমন দিল্লি, পঞ্জাব এবং দক্ষিণ ভারতে। দক্ষিণ ভারতকে সাধারণত এঁরা সমতল কিংবা শুধু ভারত বলে থাকেন। সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার ফলে অনেক সময় দেশের অন্যত্র এঁদের সাম্প্রদায়িকতার সম্মুখীন হতে হয়। সম্প্রতি অজ্ঞতাবশত এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তো জিজ্ঞেস করেই বসলেন যে লাদাখের বাসিন্দাদের দেশের অন্যত্র যেতে হলে কি ভিসার প্রয়োজন পড়ে!

জীবিকার অভাব, তাই ওই অঞ্চলে ভারতীয় সেনার উপস্থিতি তাঁদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লাদাখের অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভরশীল সেনার উপর। অল্প দামে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা থেকে শুরু করে রাস্তা মেরামত ও সাধারণ মানুষের সুরক্ষা তো আছেই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল বহু লাদাখি ভারতীয় সেনায় যোগ দিচ্ছেন।

দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পর্যটন। ১৯৭৪ সাল থেকে এই অঞ্চলে প্রথম বিদেশি পর্যটকের আগমন শুরু হয়, ধীরে ধীরে তাঁদের সংখ্যা বাড়তে থাকে আর এখন দেশি পর্যটকের চেয়ে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেশি। ওখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস এবং গুম্ফা এখানে বিদেশি পর্যটকদের টেনে আনে।

অন্যদিকে জলের অভাবের জন্য এখানকার কৃষিকাজের তেমন একটা উন্নতি ঘটেনি। এ ছাড়াও কৃষিজাত জিনিস যেমন আনাজ ও ফসলের বণ্টনের দিকটাতেও তেমন একটা জোর দেওয়া হয় না। লে-তে এমন বহু ব্যবসায়ী আছেন যাঁরা চোরা পথ দিয়ে দিয়ে উচ্চমানের আখরোট নিয়ে আসে পাকিস্তান থেকে। পাকিস্তানের কৃষকরা আখরোট ফলান। পাশাপাশি লাদাখে যে পুষ্টিকর সিবাকথর্ন ফলটি হয় তার চাহিদা বাড়ছে সারা পৃথিবীতে। 

ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংঘাত

রাজনীতি ও অর্থনৈতিক উন্নতি ছাড়াও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও আধুনিকীকরণ প্রভাব বিস্তার করেছে।

6_081118084757.jpgগতস্যাং বৌদ্ধগুম্পা

পার্শ্ববর্তী তিব্বতের অনেক প্রভাবই লাদাখের সাংস্কৃতিক জীবনে দেখতে পাওয়া যাবে, তাই হয়তো ভারতীয়রা তো বটেই, দেশের বাইরের অনেকেই লাদাখকে 'লিটল টিবেট' বলে থাকেন। যদিও এমন আখ্যা দেওয়া ঠিক নয়। কারণ ভাষা, পোশাকআশাক ও শিল্পকলা-- সব ক্ষেত্রেই তাদের একটা স্বতন্ত্র পরিচয় রয়েছে। ধর্ম তাঁদের সামাজিক জীবনের একটা বিরাট অঙ্গ। ওখানে বৌদ্ধধর্মের মানুষই সংখ্যায় বেশি। প্রধানত চার ধরণের বৌদ্ধমতাবলম্বী রয়েছেন এখানে - ড্রুকপা- এঁরাই সংখ্যায় সব চেয়ে বেশি, আমি যাঁদের অতিথি হয়েছিলাম, গেলুকপা যাঁদের মুখ হলেন দলাই লামা, শাক্য এবং ড্রিকুং কাগইউ। এই বিভাগগুলি এবং তাঁদের গুম্ফা তাঁদের জীবনের একটা অতন্ত্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিভিন্ন ধর্মীয় আচার যেমন উৎসব, বিবাহ, প্রথাগত ঔষধ তৈরি, শিক্ষা এবং গ্রামে কোনও বিবাদ হলে তা মেটানো।

বৌদ্ধমতাবলম্বী ছাড়াও এখানে বেশ কিছু সংখ্যায় মুসলমান বাস করেন। এঁরা মূলত শিয়া এবং খুব অল্প সংখ্যক সুন্নি।

লাদাখের প্রতি বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ পাশাপাশি আকাশপথে যাত্রার সুবিধা এবং গাড়ির পথ যদি আরও উন্নত হয় তাহলে সারা পৃথিবীর কাছে লাদাখ আরও সুগম হয়ে উঠবে।

তবে খুব নিশ্চিন্তে এবং একটি ছোট গণ্ডীর মধ্যে আবধ্য থাকা এই সব মানুষজন নানা পরস্পরবিরোধী চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। একদিকে যেমন তাঁরা আধুনিকীকরণের বিভিন্ন সুবিধা পেতে চান, জীবিকার সুযোগ পেতে চান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিষেবার উন্নতি চান, অন্যদিকে আবার অনেকেই তাঁদের ঐতিহ্য বজায় রাখতে চান, গ্রামীণ শাসনব্যবস্থা বজায় রাখতে চান, ধর্মীয় নিয়মকানুন আগের মতোই ধরে রাখতে চান এবং পুরোনো পদ্ধতিতে জলবণ্টন পর্যন্ত চান। তাই লাদাখের মানুষজন বিশেষ করে এই সুমদা চুনের মানুষ আধুনিকতার মধ্যেই নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছেন।

লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

DHRUVA JAISHANKAR DHRUVA JAISHANKAR

Dhruva Jaishankar is a Fellow in Foreign Policy Studies at Brookings India in New Delhi

Comment