শুধুমাত্র ধীর গতির বলেই কি পরিবেশবান্ধব ট্রাম মহানগরের রাস্তা থেকে তুলে দেব?

ইতিহাস হয়ে যাওয়ার আগে শহরের এই ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে

 |  4-minute read |   18-03-2018
  • Total Shares

আশির দশকের এক ভোরবেলা। মহানগরীর আকাশে তখনও সূর্য্যোদয় হয়নি। কিন্তু বালিগঞ্জ রেল স্টেশন সংলগ্ন ট্রাম ডিপোয় লোকের ভিড় চোখে পড়ার মতো। ডিপোতে তিন চারটে ট্রাম দাঁড়িয়ে এবং ইতিমধ্যেই প্রতিটি গাড়িতেই লোক চড়তে আরম্ভ করে দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রথম গাড়ির ঘণ্টি বেজে উঠল। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে তখন ভোর ৪.৪০। দিনের প্রথম ট্রাম গাড়ির যাত্রা শুরু হল। সারাদিন অবিরাম যাত্রার শেষে শেষ ট্রামটি ভিড়ে ঠাসা অবস্থাতেই রাত ১১.৫০ নাগাদ ডিপোতে ঢুকবে।

শুরুর দিনগুলি

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট অবধি প্রথম ট্রামটির সূচনা করেছিল ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। মাত্র ন'মাস চলার পরে হঠাৎ করেই কোনও এক অজানা কারণে এই পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর সাত বছর বাদে ১৮৮০ তে, পাকাপাকি ভাবে শহরে ফের ট্রাম পরিষেবা শুরু হয়। সেই বছরই লন্ডনে ক্যালকাটা ট্রাম কোম্পানির সূচনা হয়।

প্রথম ২২ বছর ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলেছিল শহরে। শেষে ১৯০২ সালে এশিয়ায় প্রথমবারের জন্যে ইলেকট্রিক ট্রাম পরিষেবা চালু হয় কলকাতায়। ২৭ মার্চ প্রথম ট্রামটি ধর্মতলা থেকে খিদিরপুর অবধি চলে। এরপরে, ১৪ জুন দ্বিতীয় ট্রামটি ধর্মতলা থেকে কালীঘাট অবধি চলে।

body_031918114211.jpgপ্রথম ২২ বছর ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলেছিল শহরে [সৌজন্যে: সিটিসি]

 পরিষেবার মেরুদণ্ড

খুব দ্রুত বাড়তে বাড়তে কলকাতায় ট্রাম পরিষেবা এক সময় শহরের পরিবহণ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হয়ে ওঠে। আশির দশক অবধি এই ট্রামই কলকাতার পরিবহণ ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ মাধ্যম ছিল।

শহরের প্রথম ট্রামটি ৪.৪০ মিনিটে ছাড়ত। হাওড়া বা শিয়ালদহের ট্রেন যাত্রীরা এই ট্রামগুলোর প্রথম শ্রেণীর কামরায় স্টেশন চত্বরে পৌঁছাতেন। দ্বিতীয শ্রেণীগুলোতে অবশ্য সবজি, ফল ও মাছ বিক্রেতার ভিড়। মফস্ সল থেকে ট্রেনে করে এসে ট্রাম ধরে তারা শহরের বিভিন্ন বাজারে পৌঁছে যেতেন।

এর ঘণ্টা দেড়েক পরে সাড়ে পাঁচটা কি ছ'টা নাগাদ গোঁড়া হিন্দুরা বাবুঘাটগামী ট্রেনগুলোতে ভিড় করতেন। সে সময় তাঁরা নিয়মিত ট্রামে চেপে গঙ্গায় স্নান করতে যেতেন। আটটা নাগাদ কচিকাঁচা হাতে মা-বাবারা প্রথম শ্রেণীতে ভিড় করতেন। উঁচু ক্লাসের পড়ুয়ারা অবশ্য বাড়ি থেকে পাওয়া 'পকেট মানি' বাঁচাতে দ্বিতীয শ্রেণীতে যাতায়াত পছন্দ করত।

এর পরে অফিস যাওয়ার ব্যস্ত সময় যখন ধর্মতলা বা ডালহৌসিগামী ট্রামে তিলধারণের জায়গা থাকত না। আপনি কোন শ্রেণীতে যাতায়াত করবেন তা কিন্তু আপনার সামাজিক পরিচয় ও মাসিক রোজগারের উপর নির্ভর করবে।

সেই সময় সরকারি ও বেসরকারি বাস হাতেগোনা। শহরের অনেকাংশ জুড়েই ট্রাম লাইন পাতা। আর তাই তো তখন শহরের পরিবহণ ব্যবস্থায় ট্রামের প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য।

body_031918115039.jpgট্রাম পরিষেবা এক সময় শহরের পরিবহণ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হয়ে ওঠে

শেষের শুরু

আশির দশকে উত্তর-দক্ষিণ মেট্রো করিডোরের (এখন যেটা নোয়াপাড়া থেকে কবি নজরুল অবধি চলে) জন্য শহরের ট্রাম পরিষেবা প্রথমবার ধাক্কা খায়। শহরের অফিস পাড়া ডালহৌসি থেকে দক্ষিণ কলকাতা অবধি বিস্তৃত ১২ কিমি ট্রাম রাস্তা সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই লাইন আর কোনওদিনও জোড়া লাগেনি।

এর পর ট্রাম কোম্পানি বাস পরিষেবা চালু করবার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাস নামিয়ে 'সামান্য' লাভের মুখ দেখতে পেয়ে ট্রামের প্রতি নিজেরাই অনুৎসাহী হয়ে পড়ে।

সব শেষে বর্তমান ট্রামে পরিষেবার সঙ্গিন দশার জন্যে কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগও কিছুটা দায়ী। ট্রামের জন্যে যানজটে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে - এই অজুহাতে ট্রাফিক আধিকারীদের সুপারিশে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রাম লাইন বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

কলকাতার ট্রাম নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। তবে এই গবেষণাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২০০৮ এর একটি সমীক্ষা। সেই সমীক্ষার একটি জায়গায় জানানো হয়েছে, "২০০৮ সালে প্রতিদিন গড়ে ট্রামযাত্রীর সংখ্যা মাত্র ৭৭,৫০০। ১৯৮০র শুরুতেও সেই সংখ্যাটি ছিল সাড়ে সাত লক্ষের বেশি। মধ্যবর্তী সময় শহরের জনসংখ্যা ৬৭ শতাংশ বাড়লেও ট্রামযাত্রীর সংখ্যা ১০ গুনের বেশি কমেছে।"

body1_031918115248.jpgমৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এখন আইসিইউ-তে দিনযাপন করছে শতাব্দীপ্রাচীন এই গণযান

নতুন লক্ষ্য

১৯৯২ তে একটি জনসভায় তৎকালীন পরিবহণ মন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তী বলেছিলেন, "ট্রাম একদিন স্বাভাবিক নিয়মে মারা যাবে।"

কলকাতাবাসীদের জন্যে সুখবর সেই আশঙ্কা সত্যি হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকলেও, আশঙ্কা কিন্তু এখনও সত্যি হয়নি। বলা যেতে পেরে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এখন আইসিইউ-তে দিনযাপন করছে শতাব্দীপ্রাচীন এই গণযান। সরকারি আধিকারিকরা চেষ্টা করে চলেছেন যাতে সঠিক সেবার মাধ্যমে ফের সুস্থ করে তোলা যায় শহরের ট্রামগুলোকে।

ইতিমধ্যেই বেশ কযেকটি শীত তাপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাম কয়েকটি রুটে নামানো হয়েছে। বেশ কয়েকটি পুরোনো ট্রামের ভিতরকার খোলনলচে পাল্টে নতুন করে সাজানো হয়েছে। বিবাহ বা জন্মদিনের অনুষ্ঠান কিংবা নিছকই অফিস বা বন্ধুদের আমোদ অনুষ্ঠানে ভাড়া নেওয়া যাবে এই ট্রামগুলো। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে শেষ কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বন্ধ হয়ে যাওয়া রুট ফের চালু করতে সফল হয়েছে ট্রাম কোম্পানির আধিকারিকরা।

এখন প্রশ্ন একটাই, শুধুমাত্র ধীর গতির যান বলেই কি ট্রামের মত একটি পরিবেশ বান্ধব যান আমরা শহরের রাস্তা থেকে তুলে দেব? ভুলে গেলে চলবে না ট্রামের সঙ্গে এই মহানগরের ইতিহাসও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে।

ইতিহাস কি শুধুমাত্র ইতিহাস বইয়ের পাতাতেই মানায়? কিছু 'ইতিহাস' তো চলমান, তা তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

ARPIT BASU ARPIT BASU @virusfound007

Arpit Basu is the Special Correspondent with the India Today Group’s fact check team. With more than one-and-a-half decade's experience in print and digital media, he has reported on aviation, transport, crime, civic and human interests issues. His sting operation on how precious Aviation Turbine Fuel, meant for Kolkata airport, was pilfered and sold in local market as ‘white kerosene’ received widespread acclaim. Arpit has worked with reputed media houses like The Times of India and Hindustan Times and had received letter of appreciation for reporting during the Phalin cyclone in Odisha in 2013.

Comment