রাজায় রাজায় খেলা হয়, উলুখাগড়ার পয়সা যায়
ভারতে এখন বিনোদন ও বিনিয়োগের শ্রেষ্ঠ উৎসব হল আইপিএল
- Total Shares
ঘড়িতে তখন বাজে রাত ১১টা, প্রায় ৭০,০০০ মানুষ ধর্মতলা চত্বরের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। গত ১১ বছর ধরে ভ্যাবসা গরম থেকে কালবৈশাখী হামেশাই এই চিত্র ধরা পড়েছে। কপালে সোনালি-কালো বা এখন সোনালি-বেগুনি ফিতে বেঁধে আর গালে রং করে কখনও উদাস মনে আবার কখনও হাসি মুখে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে বাড়ি ফেরাতে ফন্দি আঁটতে দেখা যায়। হ্যাঁ, এটাই আইপিএল-আসক্তি।
বহু বছর আগে রোম ও গ্রিসে রাজারা নিজেদের বিনোদনের জন্য অনেক যুগলবন্দির আয়োজন করতেন এবং দেশবাসীকেও সেই বিনোদন উপভোগ করার সুযোগ করে দিতেন। হলিউডের গ্ল্যাডিয়েটর ছবিতে সেই বিখ্যাত দৃশ্য সবারই জানা। এই বিনোদনের সঙ্গে আজকের আইপিএল-এর বেশ কয়েকটি জায়গায় মিল আছে। আবার অনেক জায়গায় অমিলও আছে।
রোম ও গ্রিস দেশের রাজারা নিজেদের বিনোদনের জন্য অনেক যুগলবন্দির আয়োজন করতেন
মিলের কথা যদি বলা হয়, তখনকার দিনের মতো এই খেলাতেও যেখানে এই যুগলবন্দি হবে তার চারিদিকে ছিল দর্শকাসন এবং সবচেয়ে সেরা আসনে বসতেন রাজা এবং তাঁর বিশিষ্টজনেরা। যেটা এখন আইপিএলে টিম মালিক, নেতা, মন্ত্রী বা বিশেষ অতিথিদের বসার জায়গা। প্রতিযোগীদের রাখা হত বিশেষ খেয়াল এবং যত্নের কোনও ত্রুটি থাকত না। আজও প্রতিটি খেলোয়াড়কে পাঁচতারা হোটেলে আলাদা আলাদা ঘরে রাখা হয়। সব রকম সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা ভালো খেলে সবাইকে আনান্দ দিতে পারেন। তখনও বাজি হত হারজিতের উপর, আর এখন আইপিএল-এর তো একটা অলিখিত অংশই হল জুয়া। যার উদাহরণ গত ১১ বছরে বহুবার মিলেছে। আর এই বছর তো মোবাইলে সম্প্রচারকারী সংস্থা প্রতি খেলার প্রতি বলের আগাম ফলাফল জানানোর উপর রেখেছে পুরস্কার। এখানেই শেষ নয়, সেই সময়ও প্রচুর অর্থ দেওয়া হত প্রতিযোগীদের। আর এখন তো নিলামে তোলা হয় খেলোয়াড়দের।
সবচেয়ে সেরা আসনে বসতেন রাজা এবং তাঁর বিশিষ্টজনেরা, যেটা এখন আইপিএলে টিম মালিক, নেতা, মন্ত্রী বা বিশেষ অতিথিদের বসার জায়গা
এবার আসা যাক অমিলের দিকে। এই বিনোদন তখন আয়োজন করত দেশের রাজা বা ধনী মানুষজন। আর আইপিএল আয়োজন করে বিসিসিআই, সঙ্গে টিম মালিকরা। এটাও প্রায় এক ধরনের মিলই বলা যায়, কারণ টিম মালিকরা সবাই দেশের কোটিপতি। কিন্তু মূল যে জায়গাতে তফাৎ, সেটা হল তখনকার ধনী মানুষজন বিনোদনের জন্য ‘খরচা’ করতেন ‘বিনিয়োগ’ নয়। দর্শকদের থেকে বিনোদনের পরিবর্তে টাকা নেওয়া হত না। আর এখন তো টিকিটের কালো বাজারিও হয়। তখন মানুষের কাছে অফুরন্ত সময় ছিল এবং বাড়ির ভিতরে বা বাইরে তেমন কোনও বিনোদনের সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখন মানুষের সময় কম হলে কী হবে, বিনোদনের সুযোগ ছাড়ে না কেউই, তা সে আইপিএলই হোক বা সিরিয়াল।
মানুষের সময় কম হলে কী হবে, বিনোদনের সুযোগ ছাড়ে না কেউই
আর এই বিনোদন যদি হয় কলকাতায় তা হলে তো কথাই নেই। কলকাতার মানুষকে সারা পৃথিবী আবেগপ্রবণ হিসেবেই চেনে। তা সে রাজনীতি হোক বা খেলার মাঠ। তাইতো এই ইডেন যেমন সাক্ষী ছিল ‘গ্রেগ চ্যাপেল গো ব্যাক’-এর তেমনই ফেটে পড়েছিল আইপিএল জেতার আনন্দে। আবেগপ্রবণ বলেই কোনও কিছুতেই অংশগ্রহণে পিছপা হন না কলকাতাবাসী। মোমবাতি মিছিল হোক বা হোক কলরব অথবা বইমেলা বা আইপিএল সবেতেই উপচে পড়ে ভিড়। আর তা না হলে ১১ বছরের আইপিএল ইতিহাসে নানা ওঠা পড়া সত্ত্বেও প্রতি বছর আর্থিক ভাবে সবচেয়ে সফল হয় কী করে কে কে আর? কিন্তু এই আবেগে গা ভাসাতে গিয়ে মাঝে মাঝেই গাড্ডায়ে পড়ে মানুষ। হাজার হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কেটে বিনোদন তো হল কিন্তু বারুইপুর বা দমদমে নিজের বাড়ি ফিরবেন কী করে? যদিও বেশ কয়েক বছর ধরে স্পেশ্যাল বাসের আয়োজন করছে সরকার এবং মেট্রোর সময়সীমাও বাড়ানো হয়। তবু যদি হেলতে দুলতে আপনি সবার শেষে বেরোন তা হলে আপনার কপালে অ্যাপ ক্যাবে ‘নো ক্যাব’। আর ‘নো রিফিউসাল’ কিন্তু ‘রিফিউসাল’ ট্যাক্সিতে তিনগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকে না।
এই আবেগে গা ভাসাতে গিয়ে মাঝে মাঝেই গাড্ডায় পড়ে মানুষ
প্রথমে ক্রিকেট মানে ছিল আবেগ, আর এখন সেটা পুরোটাই বিনোদনের পর্যায়ে পড়ে গেছে। কখনও সেটা টাকা খরচা করে উপভোগ করতে হয়, এই যেমন আইপিএল, আবার কখনও নিখরচায়, যেমন খবরের শিরোনামে ক্রিকেটার স্বামী ও তাঁর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ঝগড়া বা কেচ্ছা। কখনও কোনও টিভি চ্যানেলে লাইভ দেখেছেন কোনও হকি খেলোয়াড়কে তাঁর স্ত্রী ক্ষমা চাইতে বলছেন? বা কোনও বক্সার বিয়ে করছে আর টিভি চ্যানেলগুলি সরাসরি সম্প্রচার করছে? এইখানেই ভারতে ক্রিকেট আর পাঁচটা খেলার থেকে আলাদা। তাই ক্রিকেট এখন বিনোদন আর আইপিএল হল এই বিনোদনের শ্রেষ্ঠ উৎসব।