লখনউ ও অন্যত্র কাশ্মীরিদের মারধর করা ভারতকে ও আমাদের সংবিধানকে অবমাননা করার সামিল
সবুজ পোশাক পরিহিতই হোক বা গেরুয়া, এ দেশে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
- Total Shares
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ক্রোধ এখন দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে এসেছে – এবং এমন একটা জায়গায় তা পৌঁছে গেছে যে অনেকেই এখন সেই রাগের বশবর্তী হয়ে পড়েছেন। আর ক্রোঝ ক্রমেই সম্পূর্ণ ভাবে ঘৃণায় পর্যবসিত হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনউয়ে তারা একেবারে ঠগীদের মতো আচরণ করেছে – দুর্ভাগ্যের কথা হল, এই শহরটা চিরকালই সাংস্কৃতিক মানসিকতার জন্য বিখ্যাত।
The videos were filmed in Lucknow and widely shared. Now, one of the attackers, Bajrang Sonkar, has been arrested.https://t.co/6hhgCrUgvw
— India Today (@IndiaToday) 7 March 2019
লখনউয়ে দুই কাশ্মীরি বিক্রেতাকে মারধর করার ভিডিয়ো সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বর্বরতা তার মুখোশ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। সেই ভিডিয়োটিতে দেখা যাচ্ছে যে গেরুয়া রংয়ের কুর্তা পরে একজন লোক কাশ্মীরি এক বিক্রেতার উপরে লাঠি চালাচ্ছেন, একই সঙ্গে তিনি তাঁর ক্ষোভও উগরে দিচ্ছেন।
যখন পথচারীরা ওই প্রহাররত ব্যক্তির থেকে জানতে চাইলেন যে কেন মারধর করা হচ্ছে, অভিযোগ, ওই ব্যক্তির জবাব ছিল – “কারণ উনি কাশ্মীরি।”
আরও একটি একই রকম ভিডিয়ো দেখা গেল যেটি ৬ মার্চ বিকেল পাঁচটা নাগাদ ঘটেছিল, সেটি লখনউয়েরই ডালিগঞ্জ এলাকার ঘটনা।
কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ১৪ ফেব্রুয়ারি ৪০ জন সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ) জওয়ানকে হত্যা করার পর থেকে দেশের অনেক জায়গাতেই এমন সব ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। একের পর এক এই ধরনের ঘটনা ঘটার জেরে গত ২২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার ও ১০টি রাজ্যকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে জানতে চায় যে এ প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য কী এবং কাশ্মীরি ছাত্রদের উপর হামলা রোখার ব্যাপারে তারা কী পদক্ষেপ করেছে।
রাজ্যগুলিকে সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছে যারা অভিযুক্ত তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে এবং বিষয়টি পরবর্তী শুনানিতে জানাতে। তার পরেও হামলা হয়ে চলায় এটি সুপ্রিম কোর্টের আদেশের অবমাননা করা। তারা দেশের সাংবিধানিক ভাবাদর্শটিই লঙ্ঘিত করছে। তাই এই ধরনের হামলা ভারতের যে ভাবাদর্শই বিনষ্ট করছে, যে ভাবাদর্শে একেবারে দ্ব্যর্থহীন ভাবে কখনোই জাতিগত ভেদাভেদ ও নির্বোধের মতো হিংসার কোনও ঠাঁই নেই।
Jenab @rajnathsingh Sahib. You represent this constituency in the Lok Sabha, this is the constituency where Vajpayee Sb was elected from & went on to be PM. If no one else will step in & deliver justice can we expect you to punish those guilty of this assault? https://t.co/QyJKJ2zFxI
— Omar Abdullah (@OmarAbdullah) 7 March 2019
ভারতে ঘটে চলা অগণিত ঘটনায় আমরা দেখেছি যে ক্রোধ কী ভাবে প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। যে ভাবে দুই কাশ্মীরিকে নিগ্রহ করা হয়েছে সে ভাবে যে কোনও কিছুই ঘটে যাওয়া সম্ভব।
আদিন আহমদ দার, পুলওয়ামায় বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি চালিয়ে এসে যে ২০ বছর বয়সী কাশ্মীরি নিজেকে উড়িয়ে দিল এবং একই সঙ্গে ভারতের ৪০ জন সাহসী মানুষকে হত্যা করল, সেই তরুণ বিপথগামী ছিল, তার মগজধোলাই করা হয়েছিল। সীমান্তের ওপারে তার মগজধোলাই করা হয়েছিল এবং তাকে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। এই ভাবে কাশ্মীরিদের প্রহার করলে উন্মত্ততা আরও বাড়বে এবং তা বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতায় আরও বেশি করে ইন্ধন জোগাবে।
পাকিস্তান যে ভাবে ‘কাশ্মীরিদের প্রতি ভারতীয়দের নৃশংসতা’র কথা বলে চলেছে, এই ধরনের হিংসা তাদের কথাকেই আরও শক্তপোক্ত করবে।
পুলওয়ামার ঘটনার পরে কাশ্মীরিদের উপরে হামলার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ভারতের লড়াইটা হল সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে, কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে নয়। কাশ্মীরিদের উপরে হামলা করলে তা আসলে সন্ত্রাসবাদীদের জয়েরই সহায়ক হবে।
পাকিস্তানের প্রতি ভারতীদের ক্রোধের প্রকাশ এখন দেশের অভ্যন্তরেই দেখা যাচ্ছে। (উৎস: রয়টার্স)
তারা সীমান্তের ওপারের বলে ধরে নিয়ে যদি তাঁদের আমরা সুরক্ষা না দিই তা হলে নৈতিক ভাবে পাকিস্তান অনেক বেশি জায়গা পেয়ে যাবে। ভারতকে কড়া হাতে এই ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কারণ এটি অমানবিক তো বটেই অসাংবিধানিকও বটে। কেউ যদি কোনও কাশ্মীরির নিগ্রহ করেন তবে তা হবে সংবিধানের অবমাননা করার সামিল তাই রাষ্ট্রের উচিৎ কেউ তা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া।
ভারতের যে কোনও রাজ্যের যে কোনও জেলায় লেখাপড়া করা ও কাজ করার অধিকার রয়েছে কাশ্মীরিদের। সংবিধান তাদের এই অধিকার দিয়েছে। কোনও কাশ্মীরি যদি সন্ত্রাসবাদী হয়ে যায় – এটা অন্য যে কোনও স্থানে অন্য যে কোনও কারও তা হয়ে যাওয়ার মতোই – আর এই সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য ভারতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলিতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গেরুয়া বা অন্য কোনও রঙের পোষাক পরা কোনও ব্যক্তিই দেশের আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে নিশ্চিত করতে হবে যে সুপ্রিম কোর্ট যে চিঠি দিয়ে যে নির্দেশিকা দিয়েছে তা পালন করা হচ্ছে এবং একই সঙ্গে ওই সব অসামাজিক কারকর্মের সঙ্গে যুক্ত যে লোকগুলো দুই কাশ্মীরির উপরে চড়াও হয়েছে তাদেরও কঠোর শিক্ষা দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে মুখ খুলেছেন – তবে বিজেপির মধ্য থেকে আরও অনেকেরই এই ঘটনার নিন্দা করা উচিত। শুরুটা করতে পারেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং।
(পুনশ্চ: এই ধরনের ঘটনায় দেখা গেছে যে দু’মুখো নীতি নিয়ে চলা লোকজন বর্বরোচিত ঘটনার ভিডিয়ো রেকর্ড করা ছাড়া আর কিছুই করে না, তবে লখনউয়ের ঘটনায দেখা গেছে যে ওই দুই ব্যক্তিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন লখনউয়ের লোকজন। আমি প্রকৃতপক্ষে লখনউয়ের, তাই এই উদ্যোগ আমার মনে আশার সঞ্চার করছে।)
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে