এক বছর বয়সে আমি কাশ্মীর ছেড়েছি, তার পরেও কেন আমি তৎকাল পাসপোর্ট পেলাম না?
এর কারণ আমার পদবি বলে দেয় যে আমি কাশ্মীরি পণ্ডিত, তাই আমি আগে কাশ্মীরি পরে ভারতীয়
- Total Shares
সুযোগ দোরগোড়ায় অপেক্ষা করলে আপনি সেই সুযোগ সদ্ব্যবহারের চেষ্টা করবেন। সেই সুযোগ কোনও বড় দায়িত্বের রূপে আসতে পারে, যেখানে আপনার সম্মান জড়িয়ে রয়েছে। আবার আপনি কোনও পদোন্নতির সুযোগও পেয়ে থাকতে পারেন। কিংবা আপনার সামনে কোনও সফরের সুযোগ আসতে পারে যা আপনার ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে।
কিন্তু যদি আপনি আর আপনার সুযোগের মাঝখানে পাসপোর্ট পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, সে ক্ষেত্রে, কী হবে?
আমার অভিজ্ঞতা বলছে, আপনি যদি কোনও এক কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারের সদস্য হন তাহলে পাসপোর্ট পেতে আপনাকে ভুগতে হবেই। দশকের পর দশক ধরে উপত্যকায় বিদেশি হামলাকারীদের আক্রমণের শিকার হওয়ার পরেও। এর পিছনে অবশ্য একটি কারণ রয়েছে - ভারত সরকার কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ভিন গ্রহের বাসিন্দা বলে মনে করে থাকে।
আপনাকে যদি একবার ভিটেমাটি ত্যাগ করতে হয় তাহলে আপনার সঙ্গে আপনার দেশের সম্পর্ক প্রমাণ করাটা বেশ দুর্বিসহ হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে আপনি আর কীই বা করতে পারেন? একজন সুস্থ মানুষ যা করেন আপনিও তাই করবেন - দাঁতে দাঁত চাপ লড়াই করে, কাজটা করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। কর্মসূত্রে দেশের বাইরে যেতে হবে বলে আমিও ঠিক সেই চেষ্টাই করেছিলাম।
অনলাইনে আবেদন জমা দেওয়া পর লাইনে দাঁড়িয়ে আপনার সমস্ত নথিপত্রগুলো যাচাই করে নিয়ে পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার প্রক্রিয়াটা কতটা কঠিন হতে পারে? অথবা আপনি যে কোনও রক্তচোষা পিশাচ কিংবা ভিন গ্রহের প্রাণী নন, আপনি একজন ভারতীয় নাগরিক - এই বিষয়টি প্রমাণ করাও কতটা কঠিন হতে পারে?
আমার অভিজ্ঞতা বলছে ভারতীয়দের কাছে এই দুটি বিষয়ই বেশ কঠিন। বিশেষ করে, আপনার জন্ম যদি জম্মু ও কাশ্মীরের কোনও কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারে হয়ে থাকে।
পাসপোর্ট পাওয়ার প্রক্রিয়াটা কতটা কঠিন [সৌজন্যে: টুইটার]
পাসপোর্ট সমস্যা
সম্প্রতি আমি একটি পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্রের (পিএসকে) লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পাসপোর্ট নেওয়ার সময়ে "অ্যাপয়েন্টমেন্ট-এর" প্রয়োজন হয়। আর, সেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করতেই আমি পিএসকে-তে গিয়েছিলাম।
আমার খুব দ্রুত পাসপোর্টের প্রয়োজন পড়েছিল কারণ আমার সামনে হটাৎই একটা সুযোগ এসেছিল। তাই আমি 'তৎকাল পাসপোর্টের' জন্য আবেদন করেছিলাম এবং আবেদন করার পরের দিনই আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ধার্য হয়েছিল। পাসপোর্ট আধিকারিকদের সামনে আমার সঠিক পরিচয় প্রমাণ করে আমার পাসপোর্ট পেতে কোনও অসুবিধা হবে না - এই আশা নিয়েই আমি সেদিন লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম।
সুষমা স্বরাজ বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব পাওয়ার পর পাসপোর্ট সংক্রান্ত আইন অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। আইনগুলো অনেকটাই শিথিল হয়েছে। পাসপোর্ট পাওয়ার প্রক্রিয়াকে তিনি আরও দ্রুত করেছেন এবং সাধারণ মানুষকে যাতে পাসপোর্ট পাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বেশি অসুবিধা ভোগ করতে না হয় সেই চেষ্টাও করেছেন তিনি। প্রচুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাসপোর্ট প্রক্রিয়ার সমস্যাগুলোর অনেকটাই মিটিয়ে দিয়েছেন তিনি।
তাই পিএসকেতে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল যে পাসপোর্ট হাতে পেতে আমাকেও খুব একটা বেগ পেতে হবে না। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টোটা। পিএসকের প্রথম লাইনে আপনাকে একটা টোকেন দেওয়া হয়ে থাকে। টোকেনে লেখা নম্বরটি আপনার পরবর্তী সবকটা কাউন্টারেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আমাকে টোকেন দেওয়া হল না। বরঞ্চ, আমাকে সেই পিএসকের দায়িত্বে থাকা ডিপিও-র সঙ্গে যোগাযোগ করার নির্দেশ দেওয়া হল। সাধারণত, কোনও সমস্যা দেখা দিলে ডিপিও শেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমার ক্ষেত্রে সমস্যাটা ঠিক কী ছিল?
এক্ষেত্রে, সমস্যাটা অবশ্য আমার জন্মস্থান। আমাকে ডিপিও-র অফিসে নিয়ে যাওয়ার কারণ আমার জন্ম জম্মুতে। আর, সেই পিএসকের আধিকারিকদের দাবি, যেহেতু আমার জন্ম জম্মুতে আমি তৎকাল পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারব না।
ভারত সরকারের পাসপোর্ট পোর্টালে তৎকাল পাসপোর্ট সংক্রান্ত নিয়মাবলিতে বলা হয়েছে, জম্মু ও কাশ্মীর ও নাগাল্যান্ডের নাগরিকদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কিছুটা বেশি সময় লাগবে। কিন্তু কোথাও লেখা নেই যে জম্মু ও কাশ্মীরের নাগরিকরা তৎকাল পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারবে না। পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বেশি সময় লাগার কথা বলা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাও শুধু জম্মু-কাশ্মীরে যারা থাকে তাদের জন্য। জম্মু-কাশ্মীরে কেউ জন্মেছে অথচ বর্তমানে অন্য রাজ্যে রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই কথাটি প্রযোজ্য নয়। তা সত্ত্বেও, আমি ডিপিও-র অফিসে বসে সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। সমাধানের রাস্তা অবশ্য ডিপিও নিজেই বাতলে দিলেন - সাধারণ ক্যাটেগরিতে আবেদন করার পরামর্শ দিলেন তিনি।
যেহেতু আমার হাতে আর অন্য কোনও উপায় ছিল না আমি ডিপিও-র কথা মেনে নিলাম। তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমি পুনরায় লম্বা লাইনে দাঁড়ালাম। আশা করেছিলাম, এবার অন্তত আমার সঙ্গে আর কোনও 'অবিচার' হবে না।
কিন্তু আমার ভাগ্য নিতান্তই খারাপ।
আমার পরিবারকে কাশ্মীর ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল, তা সত্ত্বেও কাশ্মীরি বলে তৎকালে পাসপোর্ট পেলাম না [ছবি: রয়টার্স]
আমার আবেদন মঞ্জুর হল। কিন্তু মঞ্জুর হওয়ার শর্ত ছিল পুলিশ ভেরিফিকেশনের পরে আমি পাসপোর্ট হাতে পাব। এই প্রক্রিয়ার পোশাকি নাম "প্রি-পুলিশ ভেরিফিকেশন মোড"। নিয়ম অনুযায়ী, আবেদনের সময়ে আধার কার্ড জমা দিলে "পোস্ট পুলিশ ভেরিফিকেশন" মোডে পাসপোর্ট পাওয়া যায়। এই ব্যবস্থায়, পুলিশ ভেরিফিকেশন পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পরেও হতে পারে। স্বভাবতই, দ্বিতীয় ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আবেদনকারীরা পাসপোর্ট অনেক দ্রুত পেয়ে থাকে। কিন্তু আমি আধার কার্ড জমা দেওয়া সত্ত্বেও, আমার আবেদন "প্রি-পুলিশ ভেরিফিকেশন" ব্যবস্থায় মঞ্জুর করা হল। এই ব্যবস্থা বেশ সময় সাপেক্ষ।
ভারত সরকারেরও বোঝা উচিত ছিল আমি মাত্র এক বছর বয়সে জম্মু ছেড়েছি। আরও কয়েক হাজার কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারের মতো আমার পরিবারকেও জম্মু ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। এর পর থেকেই সেই রাজ্যের সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ নেই। তা সত্ত্বেও, ভারত সরকারের কাছে আমি সর্বপ্রথম একজন জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিক। আমি যে একজন ভারতীয়ও, সেই পরিচয়টা তাদের কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
নিয়মটা একপেশে নয় কি?
প্রথমত, জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদের তৎকাল পাসপোর্ট দেওয়া হবে না, এমন কোনও কথা সরকরের পাসপোর্ট পোর্টালে লেখা নেই। শুধু বলা হয়েছে, নাগাল্যান্ডের মতো কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও পাসপোর্ট আবেদনকারীর হাতে পৌঁছানোর আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক।
দ্বিতীয়ত, যদি ৩৭০ ধারার কথা ধারা যায় (পাসপোর্ট আধিকারিক আমাকে এই ধারার অজুহাত দিয়েছিলেন) তাহলে সেই ধারা জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদের জন্য কার্যকর, আমার জন্য নয়। কারণআমি জম্মু ও কাশ্মীরে বাস করি না। যে সমস্ত নথি আমি আবেদনের সময়ে জমা দিয়েছিলাম তাতে একটা কথা বেশ পরিষ্কার - আমি গত ২৫ বছর ধরে কাশ্মীরের বাইরে কাটিয়েছে।
তৃতীয়ত, নাম দেখে বোঝা যাচ্ছে আমি একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত। এবং শুধুমাত্র আমার নামের জন্য যদি আমি তৎকালে পাসপোর্ট না পাই সে ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটিকে বেশ হাস্যকর বলেই মনে হবে।
প্রায় তিরিশ বছর আগেই কাশ্মীর থেকে পণ্ডিতদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর পর থেকে এই সম্প্রদায়ের লোকজন দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। অনেকে তো আবার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে উচ্চপদে কর্মরত।
সরকার বলে আমরা ভারতীয়, আমরা বলি আমরা ভারতীয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নথির সময়তেই আমাদের লাল পতাকা দেখিয়ে দেওয়া হয়।
কেন? আমি এখানে আমার জন্য কোনও ব্যতিক্রমী নিয়মের কথা বলছি না। আমি শুধু বলছি আমাকেও দেশের অনান্য নাগরিকদের সঙ্গে সমান অধিকার দেওয়া হোক।
আমি শুধু বলছি আইনটা সকলের জন্য এক করা হোক। অনান্য ভারতীয় নাগরিকদের মতো একজন পণ্ডিত কিংবা জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদের জন্য আইনটা এক যেন হয়। আমি কি খুব বেশি দাবি করে ফেলছি? হয়তো। কিন্তু দেশের নাগরিক হিসেবে আমার তো কিছু অধিকারও রয়েছে?
আমার জন্মস্থানটাই যদি এক্ষেত্রে কারণ হয়ে থাকে তাহলে আমার একটি প্রশ্ন রয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশে জন্মেছে এমন কোনও তেলুগু সন্তান যদি কাশ্মীরে বসবাস করে তাহলে তার ক্ষেত্রেও কি এই রূপ ব্যবহার করা হবে? আমার মনে হয়, তা করা হবে না।
আমার বক্তব্য
টোকেন তো দিনের শুরুতে দেওয়া হয়ে থাকে। এর পর, আবেদনকারীদের পিএসকের তিনটি কাউন্টারে যেতে হয় যেখানে আবেদনকারীদের নথিপত্র খতিয়ে দেখে তাদের আবেদন মঞ্জুর কিংবা খারিজ করে দেওয়া হয়। আমার ক্ষেত্রে আমার নথিগুলো যে জাল নয় এবং আমি সত্যি সত্যিই কাশ্মীরের নাগরিক নই, শুধুমাত্র নিশ্চিত করতে, প্রথম দুটি কাউন্টারে আমাকে প্রায় হাফডজন বিবৃতিতে সই করতে হয়েছে এবং আমার নথিগুলো বারংবার পরীক্ষা করা হয়েছে।
পাসপোর্ট আধিকারিকরা অবশ্য আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি। বরঞ্চ আমি অপ্রস্তুত হচ্ছি দেখে তাঁরা আমার প্রতি যথেষ্ট সৌজন্য দেখিয়েছেন। তাঁদের কোনও দোষ নেই। দোষ যদি দিতে হয় তাহলে ব্যবস্থাতাকেই দিতে হবে। আমার মতে, পাসপোর্টের নিয়মগুলো এমনভাবে লেখা হয়েছে যে দশজন দশ রকম ভাবে এই নিয়মগুলোর ব্যাখ্যা করতে পারেন। পাসপোর্ট পাওয়ার প্রক্রিয়ার আইনগুলো সরল করা হোক যাতে সেগুলো ব্যাখ্যা করতে কোনও অসুবিধা না হয়।
দেখে শুনে মনে হচ্ছে, সরকার মনে করে যে কাশ্মীরি পণ্ডিতরা পরে ভারতীয় আগে জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দা। কোনও কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারের সন্তান যদি তিরিশ বছর কাশ্মীরের বাইরে থাকে তার ক্ষেত্রেও এই ধারণা বদলায় না।
এই ধারণা কিন্তু নিতান্তই বেশ বোকা বোকা।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে