ভারতের 'ডন' কার্তিক বসু কেন বাংলার ক্রিকেটের প্রাণপুরুষ

ব্র্যাডম্যানের মতো ব্যাট করতেন বলে তাঁকে ভারতের ব্র্যাডম্যান বলা হত

 |  3-minute read |   19-04-2018
  • Total Shares

ছোট থেকেই আমি বাংলার ক্রিকেট নিয়ে চর্চা করতে ভালোবাসি। বেশ কয়েকদিন আগে উত্তর কলকাতার আর্মহাস্ট স্ট্রিট দিয়ে হাঁটছিলাম। এমন সময় হটাৎ চোখে পড়ল ৫২ নম্বর বাড়িটি, যে বাড়িটি এককালে বঙ্গজ ক্রিকেটের প্রবাদপ্রতিম কোচ কার্তিক বসুর (কার্তিক বোস নামেই বেশি পরিচিত) বাসস্থান ছিল। বাড়ির লাগোয়া একটি খুপরি সাইজের কচুরি-সিঙাড়া-জিলিপির দোকান, যা এক সময় কার্তিক বোসের ঘুড়ির দোকান হিসেবে বিখ্যাত ছিল।

মনটা কেমন জানি অপুর কল্পনার মতো অতীতে হারিয়ে গেল। বাড়িটির মরচে পড়া গেটের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল যে একটা সময় বাংলার ক্রিকেটের তীর্থক্ষেত্র ছিল এই বাড়িটি। বাংলার দিকপাল ক্রিকেটাররা এই বাড়িতেই ছুতে আসতেন কার্তিক বোসের কাছে প্রশিক্ষণ নেবেন বলে।

১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কার্তিক বোস। শৈশব থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। কিন্তু তখনকার দিনে ক্রিকেট প্রশিক্ষণের এত প্রচলন ছিল না, তাই ক্রিকেট শিক্ষার জন্য তিনি বাইরে থেকে বই নিয়ে আসতেন। বোস পরিবারের আরও দুই সদস্য কার্তিক বোসের ভাই গণেশ ও বাপি বোসও ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ। তিন ভাই স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে খেলতেন এবং তিনজনেই বাংলা দলে জায়গা পেয়েছিলেন। এক পরিবারের তিন ভাই এক সঙ্গে বাংলা দলে খেলেছেন, এমন উদাহরণ প্রায় নেই বললেই চলে।

কার্তিক বোস অবশ্য বাংলা দলকে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৫২ অবধি তিনি বাংলার হয়ে মোট ৪৪টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছিলেন। কার্তিক বোসের প্রিয় ক্রিকেটার ছিলেন ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান এবং তাঁর ক্রিকেট শৈলী অনেকটা ব্র্যাডম্যানকে অনুসরণ করে। ব্র্যাডম্যানের মতই তিনিও কাট, হুক ও পুল শটে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। কথিত আছে তাই তাঁকে ভারতের ডন ব্র্যাডম্যান বলে সম্বোধন করা হত। ভারতের ডন বাংলার হয়ে মোট ১,৬৫৯ রান করেছিলেন।

body_040518125031_041918020034.jpgব্র্যাডম্যানের মতো ব্যাট করতেন বলে তাঁকে ভারতের ব্র্যাডম্যান বলা হত

ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে তিনি ক্রিকেটার গড়ার দিকে মন দেন। বনেদি জমিদার বংশের সন্তান, অর্থের অভাব কোনওদিনও ছিল না। তাই নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে নেট, ব্যাট, প্যাড, গ্লভস কিনে উনি ছোটদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন, আজকের দিনে এ ধরণের দয়ালু প্রশিক্ষক নিতান্তই বিরল।

কার্তিক বোস অবশ্য খেলোয়াড়ের থেকেও প্রশিক্ষক হিসাবে বেশি সাফল্য পেয়েছিলেন। শ্যামসুন্দর মিত্র, কল্যাণ মিত্র, নিমাই ঘোষ, মন্টু ব্যানার্জি, উদয়ভানু ব্যানার্জি, সম্বরণ ব্যানার্জি, বরুণ বর্মন, দলজিৎ সিংহ, স্বপন সেন, কল্যাণ বিশ্বাস, চুণী গোস্বামীর মত ক্রিকেটার তাঁর হাতেই তৈরি। ভারতীয় দলের অধিনায়ক হয়েও পঙ্কজ রয় তাঁর পুত্র প্রণবকে কার্তিক বোসের কাছে ক্রিকেট পাঠের জন্য পাঠিয়েছিলেন। স্পোর্টিং ইউনিয়ন, অ্যালবার্ট, মোহনবাগান, টাউন ক্লাব-সহ ময়দানের বিভিন্ন ক্লাবে তিনি কোচিং করিয়েছেন।

শুধু বাংলা কিংবা কলকাতার ক্রিকেটে উনি থেমে থাকেননি, বিজয় মার্চেন্টের মতো ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব ওঁকে ক্রিকেট ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার কোচ এবং সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত করেন। সেই সময় বিজয় মঞ্জরেকর, পলি উমরিগড়, দীপক সোধন, সেলিম দুরানি এবং আরও অনেক ভারতীয় ক্রিকেটার ওঁর কাছে অনুশীলন করতেন। সব মিলিয়ে চার বছর তিনি মুম্বাইতে ছিলেন।

কলকাতায় ফিরে আসার পর একবার অনূর্ধ্ব-১৯ পূর্বাঞ্চল স্কুল দল বোম্বেতে (অধুনা মুম্বাই) কোচবিহার ট্রফি খেলতে গিয়েছিলেন। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন বিহারের সুনীত সোম। বাংলা থেকে উদয়ভানু ব্যানার্জি, প্রদীপ রায়চৌধুরী, বরুণ বর্মন, অটলদেব বর্মন এবং প্রণব নন্দী সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই সময়েই উদয়ভানু ব্যানার্জিকে একটি চিঠি দিয়ে কার্তিক বোস বলেছিলেন, বিজয় মার্চেন্টের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সে বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পূর্বাঞ্চল এবং পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মার্চেন্টের হাতে সেই চিঠি তুলে দিয়েছিলেন উদয়ভানু।

চিঠি পেয়ে যারপরনাই খুশি হয় মার্চেন্ট ওই অনুষ্ঠানেই কার্তিক বোসের গুণগান গাইতে শুরু করে দেন। তিনি বলেছিলেন, "তাঁরা সত্যিই ভাগ্যবান যাঁরা বাবুজির (কার্তিক বোসের) মতো কোচের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছেন।"

প্রদীপের আলোর পিছনে আঁধার তো থাকবেই। কার্তিক বোসের শেষ জীবনটা খুবই দুঃখজনক। সারা জীবন বাংলার ক্রিকেটের উন্নতির স্বার্থে উনি নিজের সমস্ত অর্থ ব্যয় করেছিলেন। অথচ শেষ জীবনে কেউই তাঁর পাশে থাকেননি। একটা সময় চিকিৎসা খরচ চালানোর মতো টাকাও ওঁর কাছে ছিল না।

১৯৮৪ সালে ৭৭ বছর বয়সে বাংলা ক্রিকেটের সাধক শ্রদ্ধেয় কার্তিক বোস শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। এমন একজন মহান ক্রিকেট ব্যক্তিত্বকে আমরা যোগ্য সম্মান দিতে পারেনি এটাই চরম সত্য। অন্তত ওঁর কর্মকাণ্ডের কথা মাথায় রেখে ময়দানে যদি একটি মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করা গেলে ভালো হত।

উনি যেখানে অনুশীলন করাতেন সেই ৫২ নম্বর আর্মহাস্ট স্ট্রিটের বাড়িতে এখন গাড়ির গ্যারাজ তৈরি হয়েছে। এখনও বাড়িটির সামনে দাঁড়ালে মনে হয় বাড়িরই মধ্যে উনি কোথাও একটা লুকিয়ে রয়েছেন এবং এখনও বর্তমান ক্রিকেট পরিস্থিতি অনুধাবন করে চলেছেন।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

Prosenjit Chatterjee Prosenjit Chatterjee

Businessman. Cricket buff. Presently attached with the cricket team of East Bengal club.

Comment