জয়ললিতার ভূমিকায় কঙ্গনা রানাওয়াত অভিনয় করছেন শুনে আমি মর্মাহত
জয়ললিতার ভূমিকায় অভিনয় করতে হলে বাড়তি দক্ষতা লাগে, যেগুলো কঙ্গনার নেই
- Total Shares
তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতার বায়োপিক তৈরি হচ্ছে। 'থালাইভি' (জননেত্রী) নামের সেই সিনেমায় জয়ললিতার ভূমিকায় নাকি কঙ্গনা রানাওয়াতকে অভিনয় করতে দেখা যাবে। খবরটি পেয়েই আমি প্রথমে খবরটির সত্যতা যাচাই করতে শুরু করি। ওয়াটসঅ্যাপ ও ফেক নিউজের যুগে যে কোনও তথ্য যাচাই না করে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। যাচাই করে দেখতে পেলাম যে তথ্যটি সত্যি। আর আমিও যারপরনাই ভেঙে পড়লাম।
সিনেমার পরিচালক এএল বিজয়ের কাছে আমি আরও বেশি কিছু আশা করেছিলাম।
'গ্যাংস্টার' সিনেমায় নবাগতা হিসেবে কঙ্গনা সত্যিই আমার মন জয় করেছিলেন। তাঁর অভিনয়ের দক্ষতা নিয়ে আমার মনে কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু জয়ললিতার চরিত্রে অভিনয় করতে হলে বিশেষ কয়েকটি দক্ষতার প্রয়োজন রয়েছে। আমার মতে সেই বিশেষ দক্ষতাগুলো কঙ্গনার মধ্যে নেই।
তামিলনাড়ুর লৌহমানবী জয়ললিতাকে কখনোই হালকা ভাবে নেওয়া ঠিক নয়, তা চিত্রতারকা হিসেবেই হোক কিংবা রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবেই হোক।
আমার মতে, এ ধরণের একজনের চরিত্রে অভিনয় করাটা কঙ্গনার কাছে কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
সিনেমার নির্মাতাদের সঙ্গে ২৪ কোটি টাকার চুক্তি সই করার পর কঙ্গনা নিজে কী বলেছেন তা দেখে নেওয়া যাক। কঙ্গনা জানিয়েছেন যে তাঁর জীবন কাহিনী নাকি অনেকটাই জয়ললিতার মতো। সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, "আমি আমার বায়োপিক নিয়ে কাজ করছিলাম। অথচ, তাঁর (জয়ললিতার) গল্পও তো অনেকটা আমার গল্পের মতোই। যদিও, তাঁর জীবনে সাফল্যের কাহিনী আমার থেকে অনেকটাই বেশি। সিনেমাটির গল্প শুনে মনে হল, দুটি (আমার আর জয়ললিতার) গল্পই অনেকটা একই রকম। তাই যখন তাঁর কিংবা আমার বায়োপিকের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার সময় এল আমি জয়ললিতার বায়োপিককে বেছে নিলাম।"
কঙ্গনাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান জানিয়ে বলতে হচ্ছে, আপনি হয়তো অক্লান্ত পরিশ্রম করে শেষ পর্যন্ত বলিউডের তারকা হয়েছেন। কিন্তু আপনার পরিশ্রমকে কোনও রকম খাটো না করে বলছি আপনি আম্মার জীবন সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল নন।
জয়ললিতার ভূমিকায় কঙ্গনা রানাওয়াতকে কেমন মানাবে? [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
তাঁর হয়ে তাঁর পরিবারে কথা বলার মতো কেউ ছিল না, একজনের 'কেনা দাসী' হয়ে তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী জীবনের অনেকটা সময়েই চলতে হয়েছে তাঁকে, অনেকেই তাঁর বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে এবং তাঁকে ভুল কাজে ব্যবহার করেছে - তা সত্ত্বেও জয়ললিতা কিন্তু সর্বদাই মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। জয়ললিতার জীবনকাহিনি সকলকেই অনুপ্রাণিত করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। তাঁর চরিত্র হয়তো ত্রুটিমুক্ত নয়, তাই বলে রাজনৈতিক নেত্রী কিংবা অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর দক্ষতা নিয়ে কেউই প্রশ্ন তুলতে সাহস পায় না।
সিনেমা জগৎ হোক, কিংবা রাজনৈতিক জগৎ, তাঁর প্রখর বুদ্ধি সকলকেই মোহিত করেছে। এক বিখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক একবার বলেছিলেন, "করুণানিধির কথা শুনতে দর্শক ভিড় করত। আর শুধুমাত্র একমাত্র চোখের দেখা দেখতে তারা জয়ললিতার জনসভায় পাড়ি দিত।" তাও এমন একটা সময়কার কথা, যখন তাঁর মধ্যে আর অভিনেত্রী জীবনের তারুণ্য অবশিষ্ট নেই। তখন তিনি রোগগ্রস্ত, নিয়মিত ওষুধ খান ও স্টেরয়েড ব্যবহার করেন।
তিনি কম কথার মানুষ ছিলেন। শুধুমাত্র ইঙ্গিতে কিংবা মাথা হেলিয়েই তিনি দলের সবচেয়ে প্রবীণ সদস্যকেও তাঁর বার্তা পাঠাতে পারতেন। একমাত্র ছোর রামস্বামীর অধিকার ছিল তাঁর সঙ্গে জোর গলায় কথা বলতে পারতেন। রামস্বামী যে আসলে জয়ললিতার রাজনৈতিক জীবনের 'চাণক্য' ছিলেন। সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে জয়ললিতার জীবনের কঠিনতম সময়তে রামস্বামী তাঁকে আগলে রেখেছিলেন।
জয়ললিতার এই জীবন অভিনয়ের মাধ্যমে কঙ্গনা কতটা ফুটিয়ে তুলতে পারবেন তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
তাঁর মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর জীবন নিয়ে সিনেমা করার জন্য নির্দেশকদের মধ্যে হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। এই মুহূর্তে জয়ললিতার পাঁচ পাঁচটি বায়োপিক তৈরির কাজ চলছে। গতবছর পরিচালক প্রিয়দর্শিনী ঘোষণা করেছেন, তাঁর নির্মিত জয়ললিতার বায়োপিকের নাম হচ্ছে 'দ্য আয়রন লেডি'। নিত্য মেনন ও ভরালক্ষ্মী শরৎকুমারকে এই সিনেমার মুখ্য চরিত্রে দেখা যাবে।
তাঁর জীবনে যে পরিমাণ ওঠা-পড়া রয়েছে তাতে তাঁর জীবনের উপর সিনেমা তৈরি করতে একজন পরিচালককে নিজের সেরাটা উজাড় করে দিতে হবে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও খুব ভাবনা চিন্তা করে বাছাই করতে হবে।
অনেকের মতে, বিদ্যা বালান কিংবা অনুষ্কা শেট্টি কিংবা রম্য কৃষ্ণণ অথবা নিত্য মেননই তাঁর ভূমিকায় অভিনয় করতে পারেন। ১৯৯৯ সালের সিমি গ্রেওয়ালের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে জয়ললিতা বলেছিলেন, "পর্দায় তাঁর চরিত্রে অভিনয় করার জন্য একমাত্র ঐশ্বর্যা রাই-ই উপযুক্ত। তিনি জানিয়েছিলেন, "আমার তরুণী অবস্থার ভূমিকায় ঐশর্য্য রাই অভিনয় করতে পারেন। কিন্তু আমার বর্তমান অবস্থা বা ভবিষ্যতের আমির ভূমিকায় অভিনয় করার মতো অভিনেত্রী খুঁজে পাওয়া মোটেই সহজ নয়।"
খুব সম্ভবত, জয়ললিতা ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া মনি রত্নমের ইরুভার দেখেছিলেন। তিনি অবশ্য সেই সিনেমার সঙ্গে তাঁর জীবন কাহিনীর মিল রয়েছে সে কথা স্বীকার করেননি। বলা হয়ে থাকে, এই সিনেমায় ঐশ্বর্যা রাই যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন তা অনেকটাই জয়ললিতার অভিনেত্রী জীবন থেকে অনুপ্রাণিত। এই সিনেমায় এমজিআর ও করুণানিধির জীবনও তুলে ধরা হয়েছিল। যদিও সিনেমায় ঐশ্বর্যা রাইয়ের অভিনীত চরিত্রটিকে রাজনীতিতে প্রবেশের আগেই সিনেমার শেষ মুহূর্তে হত্যা করে দেওয়া হয়।
বর্তমানে, কঙ্গনাকে নিয়ে যে সিনেমাটি তৈরি হচ্ছে সেই সিনেমার পরিচালক এএল বিজয়। সিনেমাটির প্রযোজনা করেছেন বিষ্ণু বর্ধন ইন্দুরি ও শৈলেশ আর সিং। কেভি বিজয়েন্দ্র প্রসাদ সিনেমাটির চিত্রনাট্য লিখেছেন এবং সিনেমার গানগুলো লিখেছেন মদন কর্কি।
সিনেমাটি প্রথমে তামিলে মুক্তি পেলেও পরবর্তীকালে তা হিন্দিতে করা হবে বলে জানা যাচ্ছে। কঙ্গনা জানিয়েছেন, এই সিনেমাটির জন্য তিনি তামিল ভাষা রপ্ত করছেন। কঙ্গনা জানিয়েছেন, "যদি আমি তামিল আয়ত্ত না করতে পারি তাহলে ডাবিংয়ের সাহায্য নিতে হবে।" জয়ললিতা ছ'টি ভাষা জানতেন এবং তাঁর সময়ে তিনি ডাবিংয়ের কথা চিন্তা করতেও ভয় পেতেন।
হয়তো আমি কঙ্গনাকে নিয়ে একটু বেশি বিচলিত। আশা করব গোটা দলটি যেন এমন একটা সিনেমা তৈরি করে যাতে তা আম্মার চরিত্র ও আম্মার জীবনকাহিনি প্রতি সুবিচার করতে পারে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে