জাপানিরা ইয়েনের হিসাবের মতোই নিখুঁত (ভারতীয়রা কেন ঠিক বিপরীত)
জাপানিরা নীরবে কঠোর পরিশ্রম করা এবং বচসা না করায় বিশ্বাসী, সেটাই সাফল্যের মন্ত্র
- Total Shares
তাঁরা খুবই নম্র, তাঁরা কোনও ভাবেই কাউকে কখনও বিরক্ত করেন না, তাঁরা কোমল ভাবে কথা বলেন, তাঁরা অত্যন্ত নিয়মানুবর্তী, তাঁরা সুশৃঙ্খল তাই সর্বদাই ঝঞ্ঝাটের পরিপন্থী।
আরেকটা কথা অবশ্যই বলা দরকার, বিশ্বে তাঁদের শৌচালয় হল সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন। যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে টেলিভিশনের বিতর্ক, যেখানে উচ্চগ্রামে একে অপরকে হেয় করেন, তেমন কোনও অনুষ্ঠান হয় কিনা, উত্তর হল – না।
বছর পাঁচেক আগে একটি বৃত্তি নিয়ে আমি জাপানে মাস দুয়েক ছিলাম সেখানে টোকিয়োতে নানা ক্ষেত্রের নেতৃত্বস্থানীয়রা এসেছিলেন, তাঁদের সকলকে জাপান, সেই দেশের ইতিহাস এবং সেই দেশের উদ্বেগের বিষয়ে জানানো হয়েছিল। তখন থেকেই জাপানের ব্যাপারে আমি ভীষণভাবে শ্রদ্ধাশীল, তার কিছুটা কারণ হল সে দেশের মানুষের ভদ্রতার মাত্রা, তাঁদের চারিত্রিক গঠন ও আচারব্যবহার ভারতীয়দের চেয়ে এতটাই পৃথক যা ছিল আমার কল্পনারও অতীত।
না, এটা ক্লিশে হয়ে যায়নি, জাপানিরা চিরকালই শান্ত ও বিনয়ী (ছবি: রয়টার্স)
টোকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আলোচনা সভায় যোগ দিতে গত সপ্তাহে আমি আবার জাপানে গিয়েছিলাম। যেই সেই পার্থক্যটা দেখে নতুন করে উদ্দীপিত হলাম – তখনই উদীয়মান সূর্যের দেশ সম্পর্কে আমার মোহ আবার বেড়ে গেল। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকা, যিনি ভারত বিশেষজ্ঞ (সে জন্য তিনি হিন্দিও শিখেছিলেন কারণ পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের মতো জাপানিরা সেগুলিকে ইংরেজিতে বদলে নিতে পারেন না)।
সেই অধ্যাপিকা বলেছিলেন যে জাপানি ছাত্রদের দিয়ে কোনও প্রশ্ন করানো খুব কঠিন, কারণ তাঁরা নিজেদের নম্র স্বভাবের ব্যাপারে এতটাই সচেতন যে বক্তাকে কোনও রকম চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে চান না, আর একদল ছাত্র নিজেদের কম ইংরেজি জানা নিয়ে ভীষণ ভাবে সচেতন, যদিও আমার প্রতিটি শব্দই অনুবাদ করে দেওয়া হচ্ছিল।
চারজন ছাত্রছাত্রী যে জাতপাত, রাজনৈতিক দলের আয় থেকে মিটু এবং তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ভারতের সহজাত প্রতিভা নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন তাতে সেই অধ্যাপিকা অতিশয় প্রীত হয়েছিলেন। যে জাপানে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকরা জোরাজুরি করেন সেই দেশে অত্যন্ত পছন্দের ছবি থ্রি ইডিয়টস আর এই ছবি যখন আমাকে প্রশ্ন করা হল তখন আমিও ভীষণ খুশি হয়েছিলাম।
ওই অধ্যাপিকা বাহুবলী ও দঙ্গল ছবি দু’টিও দেখেছেন।
আমির খানের ছবি জাপানে বিপুল ভাবে জনপ্রিয় (ছবি: ফেসবুক)
পরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু কলেজের পড়ুয়াদের সাম্প্রতিক আচরণের সঙ্গে জাপানি পড়ুয়াদের আচরণের বৈপরীত্যটা অনুভব করি -- সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে আমি শুধু একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিতই হইনি, যারা আমরা বক্তৃতা শোনেইনি, তারাও বক্তৃতা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে সেখানে হাজির হয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করে দিয়েছিল।
ভারতে আমরা বিতর্ক পছন্দই করি বেশিরভাগ সময়ই আমরা নিজেরা নিজেদের কথা শুনতে ভালোবাসি বলে ও বিপরীতে কোনও একটি বিষয়ট উত্থাপিত হলেই তার বিরোধিতা করার জন্য। সেই অধ্যাপিকা, যিনি ভারত সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল তিনি খুব গম্ভীর ভাবেই আমাকে আমাকে একটা কথা বললেন, “আপনি টানা বলে যান, না হলে অন্য কেউ সেই জায়গায় বলবেন! আমরা জাপানিরা ভারতীয়দের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা করি।”
ভারতীয়দের তর্কপ্রিয়তার কথা সকলেই জানেন, এমনকী অমর্ত্য সেনও এ নিয়ে লিখেছেন (ছবি: ফারার, স্ট্রস অ্যান্ড গিরো)
এখন জাপানিরা বসবাস করেন এমন এক অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী দেশে যে দেশের যুদ্ধ করার মতো সেনা নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই জাপান ঠিক করে ফেলে যে তারা আর কোনও দিনই যুদ্ধের জন্য বাহিনীকে কাজে লাগাবে না। এমন একটা দিন ছিল যখন জাপানের সার্বভৌম সম্রাটের বাহিনী বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমী সেনাদের অন্যতম ছিল এবং তাদের কোরীয় উপদ্বীপ দখন করা এখনও দুই জাতিকে পৃথক করে রেখেছে।
আমি যখন জাপানে ছিলাম তখন একটি প্রতিবেদন পড়ি, সেখানে বলা হয়েছে যে, উত্তর কোরিয়ার এজেন্টদের দ্বারা জাপানি নাগরিকদের অপহরণের সমস্যা দূর করার জন্য পিয়ংইয়ংয়ে একটি সমন্বয়কারী কার্যালয় স্থাপনের জন্য উত্তর কোরিয়ার প্রস্তাব কী ভাবে জাপান নাকচ করে দিয়েছে। জাপানের হিসাব অনুযায়ী ৭০ ও ৮০-র দশকে ১৭ জন জাপানি নাগরিককে অপহরণ করেছিল উত্তর কোরিয়া।
২০২০ সালে অলিম্পিক্সের আয়োজন করা হচ্ছে টোকিয়োতে, জাপান চাইছে পুরোনো তিক্ততা ভুলে উত্তর কোরিয়ারকে সম্ভাব্য যোগদানকে স্বাগত জানাতে। পিয়ংইয়ং ঘোষণাপত্রে ২০০২ সালে জাপান ও উত্তরকোরিয়া “বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগ”-এর বিষয়টি উল্লেখ করেছিল, ১৯১০ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কোরিয়া ছিল জাপানের উপনিবেশ।
৬ অগস্ট হিরোসিমায় ও ৯ অগস্ট নাগাসাকিকে আমেরিকা দুটি পারমাণবিক বোমা ফেলার পরে সেই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। মানুষ নমনীয় হলেন, সাম্রাজ্য অবলুপ্ত হল।
এক বোমা যা চিরকালের জন্য জাপানকে বদলে দেয় (ছবি: এপি)
সেই তখন থেকে জাপানে সেনাছাউনি করে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এখন তারা রয়েছে জাপানের আমন্ত্রণেই। বর্তমানে জাপানে ৫৪,০০০ জওয়ান রয়েছেন, নিজের দেশের বাইরে এটাই আমেরিকার সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। জাপানকে কোনও রকম আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। জটিল ও নাটকীয় অতীত জাপানের উপরে অমোঘ প্রভাব বিস্তার করেছে।
জাপানে থাকার সময় প্রাতঃরাশে মাছ ও মিসো স্যুপ খেতে এবং মধ্যাহ্নভোজে সুশি খেতে পেলে আমি দারুণ খুশি হই। এখানে থাকার সময় আমি সে দেশের মানুষের মুখের দিকে চেয়ে দেখি আর নিজেই নিজেকে বলি যে এই দ্বীপরাষ্ট্রই বিশ্বকে দিয়েছে নিনজা যোদ্ধা, অ্যানিমে নামে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত হাতে আঁকা এবং তার পরে কম্পিউটারকৃত অ্যানিমেশন এবং এই দেশেই জন্মগ্রহণ করেছেন সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র পরিচালকদের অন্যতম আকিরা কুরোসাওয়া এবং সর্বকালের সেরা সাহিত্যিকদের অন্যতম হারুকি মুরাকামি। (যে বুলেট ট্রেন নিয়ে ভারতের জন্য পরিশ্রম করছে জাপান, আমি সেই প্রসঙ্গ এখানে টানছি না)।
সবকিছুই নিখুঁত ভাবে উপস্থাপিত করতে পছন্দ করেন জাপানিরা – তা সে রান্না হোক, সাহিত্য বা চলচ্চিত্র (ছবি: ফেসবুক)
বর্তমানে ২০২০ সালের অলিম্পিক্সের জন্য টোকিয়ো প্রস্তুত হচ্ছে এবং সবকিছু সময়মতো করে ফেলতে চাইছে জাপানিরা। ট্যাক্সিগুলিতে এখন লেগেছে অলিম্পিক্সের লোগো, বিশ্বের সবেচেয়ে বেশি মাছ খায় যে দেশ সেই দেশের সুপ্রাচীন ও আকর্ষণীয় মাছের বাজার সুকিজি এখন পুরোপুরি বন্ধ, এই বাজারটা আমি দেখেছি। যে দিন আমি টোকিয়োয় পৌঁছলাম টয়োসু নামে নতুন একটি মাছের বাজার সেদিন ব্যবসার জন্য খুলেছে। আমি নিশ্চিত যে এই বাজারটা অত্যন্ত আধুনিক মানের ও মনোগ্রাহী হবে, তাও বলছি, সুকিজি বাজারের প্রতি আমি একটু ব্যথা অনুভব করছি।
আমি নিশ্চিত যে টোকিয়ো অলিম্পিক্সের ব্যাপারে সব প্রস্তুতিই সময়মতোই হয়ে যাবে (যদি না নির্ধারিত সময়ের আগে হয়ে যায়)।
তবে জাপানিরা যে ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না তা হল বিশ্ব উষ্ণায়ন যার প্রভাব তাদের দেশে পড়ছে বলে শোনা যাচ্ছে। ২৪ জুলাই ও ৯ অগস্টের মধ্যে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হবে আর সেই সময়ে টোকিয়োর গড় তাপমাত্রা থাকবে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এ বছর তাপপ্রবাহের জেরে বহু লোককে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে, এ বছর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার করে ফেলেছিল। জাপানিরা এখন ভীত-সন্ত্রস্ত – তবে তারা এর প্রভাব যথাসম্ভব কমাতে এবং ক্ষ.ক্ষতির মাত্রা যথাসম্ভব কম রাখতে সব রকম চেষ্টা করবেন জাপানিরা।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে