নির্বাচনে মহিলাদের জয়ের হার খুব কম: আমাদের এই ভ্রান্ত ধারণার থেকে মুক্তি পাওয়া উচিত
সত্যটা একবারেই ভিন্ন, বরঞ্চ মহিলাদের নির্বাচন জয়ের হার দুই থেকে চারগুন বেশি
- Total Shares
একটি দেশের মহিলারা কতটা সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা পেয়ে থাকেন তা দিয়েই সেই দেশের মহত্ব বিচার করা হয়।
যেদিন ভারত গণতন্ত্র হয়ে উঠেছিল সেদিন থেকেই পুরুষদের সঙ্গে দেশের মহিলারাও সমান ভোটাধিকার লাভ করেছিল। পুরুষদের সঙ্গে মহিলাদের সমান ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের কিন্তু ১৪৪ বছর লেগেছিল এবং ইউনাইটেড কিংডমের ১০০ বছর লেগেছিল। ১৯২৮ সালে ইউকে-র মহিলারা ভোটাধিকার পেয়েছিল। অথচ তার আগেই, বৃটিশ ভারতে, ৪১ বছরের মহিলা চিকিৎসক মুথুলক্ষী রেড্ডি প্রথম মহিলা হিসেবে মাদ্রাস বিধান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন।
অনেকেই মনে করতে পারেন যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়। আদতে, বিষয়টির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
দুর্ভাগ্যবশত, সমান ভোটাধিকার কিন্তু মহিলাদের আরও বেশি করে রাজনৈতিক ময়দানে অংশগ্রহণ করা নিশ্চিত করতে পারেনি।
স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও এখনও দেশের মহিলাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রভূত বাধা রয়েছে। সাংস্কৃতিক অন্তরায়, কঠোর সামাজিক নিয়ম, শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাব, নিরাপত্তাজনিত কারণগুলো ও সর্বপরি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ফলে মহিলারা এখনও ঘরে-বাইরে পুরুষদের হাতে লাঞ্চিত হয়ে থাকে। মা, স্ত্রী, বোন কিংবা গৃহবধূ - এই ভূমিকাগুলোর বাইরে বেরিয়ে আসতে গেলে তাদের আজও বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়।
মহিলাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রভূত বাধা রয়েছে [ছবি: রয়টার্স]
একটি বিষয় নিয়ে যথেষ্ট চিন্তার কারণ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের লিঙ্গ বৈষম্য সূচকের হাল বেশ খারাপ - প্রতি এক হাজার পুরুষ পিছু মহিলাদের সংখ্যা মাত্র ৯৪০। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)-এর আন্তর্জাতিক লিঙ্গ বৈষম্য সূচক (গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স) রিপোর্টে ১৪৯টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৮ নম্বরে। শিক্ষাগত সাফল্য, স্বাস্থ্য, অর্থনেতিক সুযোগ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন- এই চারটে মূল ক্ষেত্র সহ মোট ১৪টা ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতায় কেমন অগ্রগতি হয়েছে তার ভিত্তিতেই এই সূচক তৈরি করা হয়। এর মধ্যে অর্থনৈতিক সুযোগের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর - ১৪৯টি দেশের মধ্যে ১৪২ নম্বরে রয়েছে ভারত। ভোটার তালিকাতেও নারী-পুরুষ ব্যবধানের ছবিটা বেশ করুন। ২০০৬ সালে আমি যখন কমিশনে যোগ দিয়েছিলাম তখন কিছু কিছু রাজ্যে প্রতি এক হাজার পুরুষ ভোটার পিছু মাত্র ৮০০জন করে মহিলা ভোটার ছিল।
একটি পরিবারের যে মহিলাদের নাম ভোটার তালিকায় নেই সেই মহিলাদের 'খোঁজ' শুরু করতে যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে কাজ শুরু করেছিল নির্বাচন কমিশন।ইলেক্টোরাল রোলে লিঙ্গ উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে, মহিলা ভোটারদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল।
নাম নথিভুক্ত হওয়ার পর আরও একটি গুতুত্বপূর্ণ কাজ বাকি রয়ে যায় - তারা যেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে আসে তা নিশ্চিত করা। এর জন্য কিছু প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষা অনুষ্ঠিত করা হয়েছিল যাতে মহিলাদের ভোট দিতে না আসার কারণগুলো অনুসন্ধান করা যায়। নিরাপত্তার অভাববোধ (যেমন মহিলারা মনে করে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে তাদের দুষ্কৃতীদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হতে পারে), পারিবারিক চাপ, শৌচালয়ের অভাব - এই ধরণের বেশ কয়েকটি কারণ সেই সমীক্ষায় উঠে এসেছিল।
এর সঙ্গে, ভোটারদের জন্য সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল যাতে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে পরিবারের মহিলাদের ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য রাজি করানো যায়। ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে মহিলা ভোটারদের জন্য বেশ কয়েকটি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল - মহিলাদের জন্য আলাদা লাইন, মহিলা নির্বাচনী আধিকারিক ও মহিলা পুলিশ আধিকারিক মোতায়ন করা এবং কিছু অঞ্চলে শুধুমাত্র মহিলা ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা। উত্তরপ্রদেশে, ২০১২ সালের নির্বাচনে, একটি সরল অথচ উদ্ভাবনী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল - লাইনে প্রতি একজন পুরুষ ভোটারের পিছনে দু'জন করে মহিলা ভোটারকে দাঁড়াবার সুযোগ দেওয়া হবে। এই সিদ্ধান্ত বেশ ফলপ্রসূ হয়েছিল।
নিবাচন কমিশনের জাতীয় ও রাজ্য স্তরের আইকনগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে সেগুলো মহিলাদের ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে যাওয়ার বার্তা বহন করে উত্তরপ্রদেশে মালিনী অবস্থী ও বিহারে শারদা সিনহার মতো বিখ্যাত লোকশিল্পীকে দিয়ে মহিলাদের ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছিল।
এর ফলে, ২০১০ বিহার বিধানসভা নির্বাচনে পুরুষ ভোটারদের চাইতে বেশি সংখ্যক মহিলা ভোটার ভোটদান করেছিল। সেই নির্বাচনে, মহিলা ভোটারের হার যেখানে ৫৪.৮৫ শতাংশ ছিল, সেখানে পুরুষ ভোটারের হার ছিল ৫০.৭৭ শতাংশ। একই অবস্থা ২০১২ উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল - সেই নির্বাচনে ৬০.২৮ শতাংশ মহিলা ভোটার ভোটদান করেছিল আর পুরুষ ভোটারের হার ছিল মাত্র ৫৮.৬৮ শতাংশ।
নির্বাচন কমিশন এসভিইইপি (সিস্টেমেটিক ভোটার এডুকেশন এন্ড ইলেক্টোরাল পার্টিসিপেশন) কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল যে কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের, বিশেষ করে মহিলা নাগরিকদের, ভোটদানের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই কর্মসূচির সৌজন্যে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মহিলা ভোটদাতাদের হার এক লাফে দশ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল - ২০০৯ সালের ৫৫.৮২ শতাংশ থেকে ৬৫.৬৩ শতাংশ।
এর উপর আবার ১৬টি রাজ্যে মহিলা ভোটারদের সংখ্যা পুরুষ ভোটারদের চাইতে বেশি ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে নারী-পুরুষ ভোটারদের ব্যবধান হার কমে একেবারে সর্বনিম্ন ১.৪৬ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল।
ভোটদাতা হিসেবে মহিলাদের অংশগ্রহণের কথা আলোচনা করার পর এবার আইন পরিষদগুলোতে মহিলাদের উপস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা যাক। লোকসভায় মাত্র ১২.১৫ শতাংশ মহিলা সাংসদ রয়েছে। বিধানসভাগুলোতে মহিলাদের উপস্থিতির হার আরও খারাপ। তুলনা করলে দেখা যাবে আফগানিস্তান, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার রক্ষণশীল মুসলমান দেশগুলোতেও মহিলা জনপ্রতিনিধির সংখ্যা বেশি। এমনকি, নেপালেও মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রভূত উন্নতি করেছে।
সূত্র: জাতীয় নির্বাচন কমিশন
মহিলা সহকর্মীদের সংসদে বা বিধানসভায় সুযোগ না দেওয়ার যে প্রবণতা পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে তা সত্যিই অনভিপ্রেত । স্থানীয় নির্বাচনে মহিলাদের অংশগ্রহণ মেনে নেওয়া হলেও, সংসদে বা বিধানসভাতে তাদের প্রবেশাধিকার অনেকটাই কম।
১৯৯৩ সালে স্থানীয় বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ মহিলাদের সুযোগ দেওয়া হত, যা ২০০৯ সালে বেড়ে ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। প্রচুর রাজ্যে পুর নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা রয়েছে। কিন্তু সরকারের ওপরের স্তরগুলোর নির্বাচনের ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত মহিলা সংরক্ষণ বিল চালু করা হয়নি, যা নিয়ে প্রচুর তর্ক বিতর্ক হয়ে গিয়েছে।
ভারতকে সত্যি সত্যিই গণতন্ত্র করে তুলতে মহিলাদের ভোটদান ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহিলাদের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতির সেরা উপায় হল শাসন ব্যবস্থায় মহিলাদের সমান সুযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়া।বৈধ্যতামূলক সংরক্ষণের কথা বাদ দিন, রাজনৈতিক দলগুলোর বেশি সংখ্যক মহিলাদের প্রার্থী করার ব্যাপারে প্রবল অনীহা রয়েছে। এর ফলে, নির্বাচনগুলোর প্রার্থীদের মধ্যে ১০ ভাগের মাত্র এক ভাগ মহিলা প্রার্থী। মহিলা প্রার্থীদের নির্বাচন জয়ের হার বেশ খারাপ - এই ধারণাটি সর্বৈব মিথ্যে। যারা ভারতের নির্বাচনের ইতিহাসের সঙ্গে সামান্যতম ওয়াকিবহাল তারা জানেন যে মহিলা প্রার্থীদের নির্বাচনে জয়ের হার দুই থেকে চার গুন বেশি।
গ্রাফ: ফ্যাক্টলি ডট কম, তথ্যসূত্র: জাতীয় নির্বাচন কমিশন
মহিলারা যতক্ষণ না পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে তাদের প্রাপ্য অধিকার পাচ্ছেন ততক্ষন পর্যন্ত এই গণতন্ত্র অসম। দেশের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘুদের, মানে মহিলাদের, বিরুদ্ধে ঘটে চলা বৈষম্যগুলো নিয়ে প্রতিবছর ৮মার্চ আলোচনা হয়ে থাকে। মহিলারা যেন ভোট দিতে ও নির্বাচনে প্রার্থী হতে এগিয়ে আসেন তার জন্য তাদের সবরকম ভাবে উৎসাহিত করতে হবে।
একমাত্র যদি সত্যিকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে এবং বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা সম্ভব হয় তাহলেই এই লক্ষ পূরণ করা যাবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে