শহর জুড়ে নতুন স্লোগান: “আমি হব ‘বুদ্ধিজীবী’, এটাই আমার অ্যামবিশন”
ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ও সৌরভের পাশাপাশি সন্তানদের বুদ্ধজীবী করতে চান বাবা মায়েরা
- Total Shares
সালটা ছিল ২০০৭, বাংলা তথা কলকাতার বাবা মায়েরা তাঁদের সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা এমবিএ-র পাশাপাশি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ক্রিকেটার করে তুলতে স্কুল থেকে টিউশন হয়ে খেলার মাঠে নিয়ে দৌড়াতেন। ঠিক তখনই বাংলার রাজনীতিতে ৩৪ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করেছে রাজ্যের মানুষ। বাংলার শিল্পী সমাজের বেশ একাংশ অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। এই করে গড়াল ক'টা বছর, সংবাদমাধ্যম এই সব শিল্পীদের নামকরণ করল ‘বুদ্ধিজীবী’।
সন্ধ্যা হলেই টিভিতে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে অনুষ্ঠান, “কী বলছেন বুদ্ধিজীবীরা?” হাঁ করে বোকা বাক্সের সামনে বসে শুনত ‘নির্বুদ্ধিজীবীরা’। ‘নির্বুদ্ধিজীবী’ বলার একটাই কারণ, যদি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষদের আমরা ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে চিহ্নিত করি তা হলে বাকিদের কী বলা হয়? যাইহোক, এই বুদ্ধিজীবীদের স্টুডিওতে বসে সন্ধের পর সন্ধে অক্লান্ত শব্দ খরচ, বা পথে নেমে নানা রকমের উদ্ভাবনী মিছিল করার ফল হল ৩৪ বছরের সরকারের পরিবর্তন। অবশ্যই এখানে জয়ী দলের কৃতিত্বকে ছোট করার কোনও অবকাশই নেই। সাধারণ ‘নির্বুদ্ধিজীবী’ মানুষদের মনে ভালোর জন্য পরিবর্তনের স্বপ্নকে জাগিয়ে তোলা কঠিন কাজ তো বটেই। এই পরিবর্তনের পর যে সব ‘বুদ্ধিজীবীরা’ তাঁর “কাছের মানুষ” হতে পেরেছেন তাঁরা সবচেয়ে বেশি লাভবান।
বাবা মায়েরা সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এমবিএ ছাড়াও সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ক্রিকেটার করতে চাইতেন
আজ ২০১৮তে গুচ্ছ গুচ্ছ বুদ্ধিজীবীদের ‘বুদ্ধিজীবী’ হওয়ার পাওনা দেখলে যে কোনও বাবা মা তাঁদের সন্তানকে ‘বুদ্ধিজীবী’ করে তোলার স্বপ্ন দেখাতেই পারেন। কিন্তু এখানে একটা কথা না বললেই নয়, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা উকিল হওয়া কিন্তু বুদ্ধিজীবী হওয়ার লক্ষণ নয়। তার জন্য প্রয়োজন সন্তানকে শিল্পী সমাজের অংশ করে তোলা। কারণ বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীরই প্রথম পরিচয় তাঁরা আগে একজন শিল্পী। ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আরে এই শিল্পী সেই শিল্পী নয় যারা তাঁদের শিল্পে শ্রেষ্ঠ, একটা দুটো ফ্লপ সিনেমা বা অ্যালবাম করলেও তো তাঁদের শিল্পী বলা যায়। আর সবচেয়ে মজার কথা হল ‘বুদ্ধিজীবী’ হতে গেলে সবসময় বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজে নির্বোধ জেনেও বোদ্ধা হওয়ার ভান করাটাই যথেষ্ট। আর একবার যদি কোনও একটি প্রভাবশালী দলের সুনজরে পড়ে যান আর তার দৌলতে একটা কোনও পদ জোগাড় করে নিতে পারেন, এর চেয়ে ভালো ‘রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান’ আর হয় না।
এই ‘বুদ্ধিজীবী’-রা ঠিক কীরকম আসুন দেখে নিই
বাংলার শিল্পী সমাজের বেশ কিছু মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে কথা বলতে শুরু করলেন, যাদের নামকরণ হল বুদ্ধিজীবী
বুদ্ধিজীবী কয় প্রকার ও কী কী?
বুদ্ধিজীবী মূলত ৪ প্রকার।
১) ‘সুযোগসন্ধানী’ – যে কোনও পরিবর্তনের আভাস এঁরা সবার আগে পান। তাই টেনিস বলের মতো এই কোর্ট ওই কোর্ট করে বেড়ান। কখনও একদলের হয়ে কথা বলেন আবার কখনও আর এক দলের হয়ে। দেখাতে চান নিরপেক্ষ কিন্তু আসলে যে বেশি সুবিধে দেয় তার হয়ে বলেন। এদের দলে বেশ কিছু চিত্রশিল্পী থেকে নাট্য ব্যাক্তিত্ব এমনকী অনেক সিনেমা জগতের মানুষও আছেন। আজকের ডান আসলে গত কালের বাম এবং প্রয়োজনে আগামীর রাম হতেও সময় নেবেন না এঁরা।
২) অবসরপ্রাপ্ত শিল্পী- নিজের শিল্পের প্রদর্শন করতে বয়সজনিত কারণে শারীরিক ভাবে অক্ষম এঁরা। এদিকে একসময় যা কামিয়েছেন সব ফূর্তি করে উড়িয়েছেন বা হয়তো আরও টাকার লোভ ছাড়তে পারছেন না। তাই এখন যে দলের পাল্লা ভারী তাদের নাম জপ করেন। সারাজীবন দেবদেবীর পূজার্চনা করেও তো না দেখা পেয়েছেন না টাকা পেয়েছেন তাই এখন পধবি পাল্টে যদি ‘ঈশ্বরী’-র মন্দির গড়ে হাসপাতাল আর ওষুধের খরচা উঠে আসে তাতে ক্ষতি কি? যদিও এমন অনেক অবসরপ্রাপ্ত শিল্পী আছেন যারা আর্থিক অনটনে দিন কাটালেও এ সবের থেকে অনেক দূরে।
৩) ফ্লপ হিরো/ হিরোইন বা অভিনেতা/অভিনেত্রী – এঁরা জীবনে যে ছবিতেই অভিনয় করেছেন দায়িত্ব নিয়ে সেই ছবিকেই ডুবিয়েছেন বা যারা একসময় ভালো অভিনয় করতেন তাঁদের এখন আর তেমন বাজার নেই। তাই মুখচেনা এবং দেখতে শুনতে ভালো হওয়ার সুবাদে চারটে টিভি চ্যানেলের ‘লুক অ্যান্ড ফিল’ তো বাড়াতেই পাড়েন। আর এই সব করে যদি কুড়িয়ে বাড়িয়ে কিছু পাওয়া যায়, মন্দ কি? তার উপর রাজনীতিতে যোগ দেওয়াটা এঁদের জন্য খুব সহজ। পুরনো কিছু ছবিতে ভালো অভিনয় করার সুবাদে কিছু ভোটও চলে আসতে পারে। আর তার জন্য যদি গরিব চাষিদের সঙ্গে অন্যায়ের প্রতিবাদে ক্যামেরার সামনে বলতে যাওয়ার আগে একবার লিপ গ্লস আর কাজলটা ঠিক আছে কি না দেখে নেয়, সেটা কি খুব দোষের? বা দলের প্রচারে চাষির ছোট্ট ছেলেটার গাল টিপে আদর করার পরে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোওয়াতেই বা দোষ কী?
৪) প্রকৃত বুদ্ধিজীবী – এঁরা ধান্দাবাজির ‘বুদ্ধি’ দিয়ে নিজেদের ‘জীবিকা’ অর্জন করেন না। বাকিদের মতো কোনও কিছুর লোভে কারো গুণগান করেন না। ২০০৭-এ যেমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন, তেমন আজও অন্যায় দেখলে আওয়াজ তোলেন। এনাদের মধ্যে সমাজের শিক্ষিত ও সুরুচি সম্পন্ন শিল্পীরা আছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা এঁদের মতো মানুষ খুবই কম।তাই আজকের বাবা মায়েরা তাঁদের সন্তানকে কীধরনের ‘বুদ্ধিজীবী’ বানাতে চান তার উপর নির্ভর করছে পরবর্তী প্রজন্মের ভাগ্য। যদিও আর কিছুদিনের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হওয়ার ক্র্যাশ কোর্সও চালু হয়ে যেতে পারে। যে হারে প্রথম তিন রকমের বুদ্ধিজীবীরা পদ পেতে সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন তাতে রাজ্যে বুদ্ধিজীবীর বেশ কিছু আসন খালি হয়েছে বইকি। তবে এই সব আসন যদি চতুর্থ রকমের বুদ্ধিজীবীতে ভরে তবেই বোধহয় মঙ্গল।
বোকা স্লেটের (এলইডি টিভির/ ল্যাপটপের) সামনে বসে বুদ্ধিজীবীদের কথা বাণীর মতো মানার আগে তাঁদের এই চার ভাগে ভাগ করে সিদ্ধান্ত নিন কার কথা শুনবেন আর কারটা নয়। সাধারণ মানুষ কখনই ‘নির্বুদ্ধিজীবী’ নয়। কিন্তু নির্বুদ্ধি বা কুবুদ্ধি সম্পন্ন বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনে সাধারণ মানুষের ভাবনাশক্তির মৃত্যু হচ্ছে না তো?