শিয়ালদহে ট্যাক্সির দায়িত্বে কলকাতা পুলিশ, পরিস্থিতির সুরাহা হবে বলে আশা
বেশ কয়েকটি স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি আমদানি হওয়ায় কারচুপি ও কারিকুরি করা মুশকিল
- Total Shares
বছর খানেক আগেকার কথা। জলপাইগুড়ি থেকে পদাতিক এক্সপ্রেস ধরে সকাল সকাল শিয়ালদহ স্টেশনে নেমেছি। ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারার উত্তেজনা নিয়ে স্টেশনের বাইরে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যাক, তা হলে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি ফিরতে পারব। কিন্তু ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে পৌঁছই আমার চক্ষু চড়কগাছ। যাত্রীদের লম্বা লাইন কিন্তু ট্যাক্সি কোথায়? বস্তুত একটি ট্যাক্সিও সেদিন ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে চোখে পড়ল না।
অ্যাপ ট্যাক্সির খোঁজ শুরু হল। কিন্তু সেখানেও বিড়ম্বনা। সারচার্জ যোগ করে মোটা ভাড়া হাঁকছেন অ্যাপ ক্যাব সংস্থাগুলো। দু'টি পরিবার বিরক্ত হয়ে লটবহর নিয়ে রওনা হল শিয়ালদহ ব্রিজের দিকে। যদি রাস্তা থেকে চলতি ট্যাক্সি পাওয়া যায়। কিছু লোক দেখলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ড লাগোয়া অটো স্ট্যান্ডে বিভিন্ন রুটের অটোচালকদের সঙ্গে দর কষাকষি শুরু করে দিয়েছেন। যদি অটো রিজার্ভ করে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়।
কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম আমি। এই পরিস্থিতিতে আমার কী করা উচিৎ? আমিও কি বাস বা চলতি ট্যাক্সির আশায় শিয়ালদহ ব্রিজের দিকে হাঁটা দেব? নাকি, বেআইনি ভাবে অটো রিজার্ভ করে বাইপাস লাগোয়া রুবি হাসপাতাল পর্যন্ত চলে যাব। হঠাৎই আমার চোখ গেল স্টেশনের পার্কিং এলাকার দিকে। কী আশ্চর্য! ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে একটাও ট্যাক্সি নেই অথচ পার্কিং বুথে পাশাপাশি সার দিয়ে দাঁড়ানো ১৫ টি নীল-হলুদ ট্যাক্সি।
ধড়ে প্রাণ পেলাম। এগিয়ে গেলাম পার্কিং এলাকার দিকে। পরের ১০ মিনিট আমার যা অভিজ্ঞতা হলো তা সচরাচর সকাল বেলা বাজারে গেলে হয়ে থাকে। মিটার ট্যাক্সি মিটারে যাবে না। তার উপর শিয়ালদহ থেকে আমার বাড়ি অবধি যা ভাড়া হওয়ার কথা তার থেকে পাঁচগুণ বেশি ভাড়া হাঁকছেন ট্যাক্সি চালক। বিস্তর দর কষাকষির পর দ্বিগুণ ভাড়ায় যেতে রাজি হলেন তিনি। কিন্তু শর্ত সাপেক্ষে।
শিয়ালদহের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দায়িত্বে কলকাতা পুলিশ
বেশ অদ্ভুত সেই শর্ত। আমার সঙ্গে আরও একজন যাত্রী কসবা থানার লাগোয়া তালবাগান যাবেন বলে দর কষাকষি করছিলেন। রুবি থেকে তালবাগানের দূরত্ব বেশি নয়। শুধুমাত্র আমি আর ওই সহযাত্রী যদি একসঙ্গে যেতে রাজি থাকি তা হলে একেক জনের যা ভাড়া হওয়ার কথা তার থেকে 'মাত্র' দ্বিগুণ বেশি ভাড়ায় (একেক জনের কাছ থেকে) চালক যেতে রাজি হবেন। সোজা কথায়, দ্বিগুণ ভাড়া দিয়েও শেয়ারে যেতে হবে।
অসংখ্য ধন্যবাদ সেই সহ যাত্রীটিকে। তিনিও নিশ্চয়ই আমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন একই ভাবে। এই অদ্ভুত শর্তে দুজনেই রাজি হয়েছিলাম বলেই না সেদিন অপেক্ষাকৃত কম খরচ (অ্যাপ ক্যাব বা অটো রিজার্ভ করতে যা খরচ হত তার চেয়ে কম) করে বাড়ি ফিরলাম। উপরি পাওনা - খুব বেশি সময় ব্যয় করতে হয়নি।
এখন প্রশ্ন হল, পুলিশকে কেন অভিযোগ জানালাম না। সেই সময় শিয়ালদহ স্টেশনের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিল জিআরপির হাতে। তাঁদের নাকের ডগায় এই ঘটনা ঘটছে আর তাঁরা কিছুই জানেন না এ হতে পারে না। এত যাত্রীকে হয়রানির শিকার হতে দেখেও তাঁরা চুপ। তার মানে তাদের অন্য কোনও স্বার্থ রয়েছে। নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে আমার অভিযোগে তাঁরা কান পাততে যাবেন কেন?
শিয়ালদহতেও ট্যাক্সি সমস্যার কিছুটা সুরাহা হবে বলে মনে হচ্ছে
স্বার্থ যে কী তা ট্যাক্সি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণ হয়ে গেল। গেটের মুখে যেখানে পার্কিং ফি দেওয়ার কথা সেখানে কেউই আমাদের ট্যাক্সির চালকের কাছে কোনও টাকা চাইল না। কিন্তু বিআর সিং হাসপাতালের কাছে এক সাদা পোশাকের লোক হাত বাড়াতেই চালক একটি ২০ টাকার নোট বের করে দিলেন।
কৌতুহলবশতঃ জানতে চাইলাম বিষয়টি কী? চালক জানালেন, "প্রিপেইডে যাত্রী তুললে ঝামেলা বিস্তর। যাত্রীরা বুথে ভাড়া জমা দিয়ে ট্যাক্সিতে চড়েন। তার পর বুথকর্মীরা নিজেদের চার্জটা কেটে নিয়ে মূল ভাড়াটা আমাদের হাতে তুলে দেন। এই ভাড়া পেতে অনেক দেরি হয়ে যায়।" তাই এই বিকল্প ব্যবস্থা। চালকের দাবি, এই ব্যবস্থার জন্য মাসহারার ব্যবস্থা রয়েছে। তার পর যাত্রী নিয়ে স্টেশন থেকে বেরোলে প্রতিবার করে ২০ টাকা। সহযাত্রী প্রশ্ন করলেন, "কিন্তু এই ট্যাক্সিতে তো দুজন আলাদা গন্তব্যের যাত্রী রয়েছে। তাহলে ৪০ টাকা দিলেন না কেন?" জবাব না দিয়ে শুধু স্মিথ হাসলেন চালক। বুঝলাম সুযোগ পেলে চোরের উপরেও বাটপাড়ি করে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এই দুর্বিসহ অভিজ্ঞতার বছরখানেক পর একটা স্বস্তির খবর পেলাম। যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য বাড়াতে শিয়ালদহ স্টেশনের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে পূর্ব রেল।
পরের প্রশ্ন, কলকাতা পুলিশ আবার জিআরপির পথেই হাঁটবে না তো? না হাঁটার কোনও কারণ নেই। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। যে সব কলকাতা পুলিশের আধিকারিকরা শিয়ালদহ স্টেশনের ট্যাক্সি বুথে কাজ করবেন, তাঁদের ইচ্ছে থাকলেও 'অন্য রকম' কিছু করবার উপায় নেই। কারণ উন্নতমানের প্রযুক্তি যার থেকে বেরিয়ে আসার কোনও উপায় নেই।
প্রথমেই আরএফআইডি বলে একটি প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করতে চলেছে কলকাতা পুলিশ। এই ব্যবস্থা হাওড়া স্টেশনেও রয়েছে। এই ব্যবস্থায় স্টেশন চত্ত্বরের মুখে আলাদা ট্যাক্সি বে করে দেওয়া হয়। কোনও ট্যাক্সিকে সেই নির্দিষ্ট বে ছাড়া অন্য কোনও বে-তে ঢুকতে দেওয়া হয় না। ট্যাক্সির উইন্ডস্ক্রিনগুলোতে একটি করে স্টিকার লাগান থাকে যা আদতে স্ক্যানার। একটি ট্যাক্সি বে-তে প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গেই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মাধ্যমে সেই স্টিকার থেকে স্ক্যান হয়ে ট্যাক্সির রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রিপেইড বুথ কর্মীদের কাছে চলে যায়।
এর পর কোনও বুকিংয়ের সময় স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো যে ট্যাক্সিটি সবার আগে বে-তে ঢুকেছে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সেই ট্যাক্সিটিই লাইনে দাঁড়ান প্রথম যাত্রীটির জন্য বুকিং হবে। কোনও চালক যদি নির্দিষ্ট কোনও গন্তব্যে যাবেন না বলে বুথ কর্মীদের 'ম্যানেজ' করবার চেষ্টা করেন তা করতে পারবেন না। কারণ পুরো ব্যবস্থাটাই স্বয়ংক্রিয়। এই ব্যবস্থায় ম্যানুয়ালি কোনও কিছুই পরিবর্তন করা যায় না।
এর ফলে দুটি সমস্যার সুরাহা এক সঙ্গে হবে। শিয়ালদহ স্টেশনে যে ট্যাক্সি প্রবেশ করবে তাকে প্রিপেড বুথে ঢুকতেই হবে। অর্থাৎ, চালকরা যাত্রী নামিয়ে পার্কিংয়ে ট্যাক্সি ঢোকাতে পারবেন না। এমনকি, ফাঁকা ট্যাক্সি নিয়ে স্টেশন চত্ত্বরের বাইরে যেতে পারবেন না। দুই, কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাবে না বলে যাত্রী প্রত্যাখানের উপায় নেই।
সাঁতরাগাছি স্টেশনে যে অসুবিধা রয়েছে, তা শিয়ালদহে নেই। এখানে দূরপাল্লার ট্রেনগুলোর অধিকাংশই ভোরের দিকে বা রাতের দিকে আসা যাওয়া করে। এতে চালকদের সুবিধা যে স্টেশনে প্রবেশ করলে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করতে হবে না। একই সঙ্গে যাত্রীরা ট্রেন থেকে নামলে ট্যাক্সি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কারণ সে সময় বেশ কয়েকটি দূরপাল্লার ট্রেন স্টেশন থেকে ছাড়ে।
সব মিলিয়ে হাওড়া স্টেশনের মতো শিয়ালদহতেও ট্যাক্সি সমস্যার কিছুটা সুরাহা হবে বলে মনে হচ্ছে।