স্বাধীন ভারতের শব্দকোষে নতুন রূপে 'আমরা বনাম ওরা' শব্দটি জায়গা করে নিয়েছে
এই লড়াইয়ের শুরুটা হয়ে ছিল ভারত (আমরা) বনাম পাকিস্তান (ওরা) দিয়ে
- Total Shares
গত সপ্তাহে আমার এক ডানপন্থী বন্ধু দাবি করলেন যে বিজেপির হয়ে কয়েকটি লাইন লেখার জন্যে তাঁকে নাকি কয়েকজন উদার মনোভাবাপন্নের হাতে নিগৃহীত হতে হয়েছিল। তাঁর কথায়, "জনা বিশেক লোক আমাকে মুসলমান বিরোধী বলে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটা বিষয় বেশ পরিষ্কার হল। কোনও হিন্দু যদি বলে যে দেশের মুসলমানরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আছে তাহলে তাঁর ভাগ্যে এই ধরণের পরিস্থিতি অপেক্ষা করে রয়েছে। বিজেপি সমর্থক হিন্দু মানেই সে নাকি মুসলমান বিরোধী .... না, এ জিনিস মেনে নেওয়া যায় না।"
তাঁর শেষ কথাগুলো শুনে আমি যারপরনাই আশ্চর্য হয়েছিলাম। বিজেপি সমর্থক হিন্দু মানেই মুসলমান বিরোধী - উদারমনস্ক ব্যক্তিরা কি সত্যি সত্যিই এ কথা বলেন?
তা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমি বলব আমরা সার্বিকভাবে ব্যর্থ।
আমার সেই বন্ধুটি আরও কিছু কথা বলে ছিলেন, "এই ঘটনা আমাকে আমার চারপাশের মানুষদের চিনিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। এমন একটা ঘটনার সাক্ষী থাকতে পেরেছি বলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। এই দেশে, বিশেষ করে দেশের শহরাঞ্চলে, কী মাত্রায় ঘৃণার সঞ্চার হয়েছে তা আমি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছি।"
এখানে একটা কথা বলে রাখি। আমার এই বন্ধুটি যথেষ্ট উচ্চশিক্ষিত। দেশের একটি নামকরা ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেছেন এবং কয়েক দশক জুড়ে তিনি একটি মানব সম্পদ সংক্রান্ত ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অনগ্রসর শ্রেণীর উন্নয়নের জন্যে কাজ করেন। একদিকে তিনি প্রবলভাবে আধ্যাত্মিক, অন্যদিকে তিনি আমার পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে যথেষ্ট স্পর্শকাতর। সব মিলিয়ে তাঁকেই উদার মনোভাবাপন্ন বলা যেতেই পারে।
কিন্তু এই কথাটাই বলতে গেলে তিনি অভিমান করে বসেন।
এর কারণ হয়ত আমাদের শব্দকোষে আবার নতুন রূপে 'আমরা বনাম ওরা' শব্দটি জায়গা করে নিয়েছে।
আমরা বনাম ওরার শুরুটা ছিল ভারত (আমরা) বনাম পাকিস্তান (ওরা) দিয়ে। কিন্তু খুব দ্রুত তা হিন্দু বনাম মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। আর বর্তমানে এই লড়াইয়ের নতুন রূপ হিন্দু বনাম সেকুলার লিবারেল।
কে কী ভাবল তা নিয়ে এই নতুন রূপের লড়াইয়ের যোদ্ধাদের কিছু এসে যায় না। তাঁরা নিজেদের বিশ্বাসকে আরও মজবুত করতে সদা সচেষ্ট। তাঁরা সর্বদাই মনে করেন যে এই সেকুলার লিবারেলরা হিন্দু মাত্রেই দোষ খুঁজে বেড়ান। আমার এই ডানপন্থী বন্ধুটির মত তাঁরাও হিন্দুত্ব নিয়ে গর্ব বোধ করেন। তাঁরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে মুসলমানদের ঘৃণা না করলেও তাঁদের হিন্দু প্রীতি নাকি তাঁদের মুসলমান বিরোধী আখ্যা দিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এই দুই পরিস্থিতি কি একে অপরের পরিপূরক নয়?
মুদ্রার অন্য পিঠটাও যে একই রকম। ধর্ম অন্ত মুসলমান মানেই কি তাঁরা অন্য ধর্মের বা অন্যের বিশ্বাসের প্রতি সম্মান জানান না? কোরান নিয়ে যে রকম মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে বা যে রকম ভাবে আমরা প্রত্যেক মুসলমানকে বিধর্ম বিরোধী বলে আখ্যা দিয়ে থাকি, সে ভাবেই কি উদার মনোভবাপন্ন লোকেরা এখন মনে করতে শুরু করে দিয়েছেন যে কেউ ধার্মিক হিন্দু ডানপন্থী মানেই সে মুসলমান বিরোধী?
আমার ক্ষেত্রে একটা সমস্যা রয়েছে। এই ধরণের বিষয়বস্তুর সম্মুখীন হলেই আমার কথা বন্ধ হয়ে যায়।
'আমরা বনাম ওরা' লড়াইতে প্রবেশ করা মানেই মানুষ শুধু নিজেদের উপলব্ধিটাই প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু এই ধরণের আলোচনা সাফল্যমন্ডিত করে তুলতে গেলে সকলের মতামত গ্রহণ করাটাই শ্রেয়।
সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে যে ধরণের মতামত প্রকাশ করা হয় তাতে সামাজিক উদ্বেগ আরও বৃদ্ধি পায়। আমি চোখের সামনে দেখতে পাই কিভাবে জ্বলজ্যান্ত মিথ্যেকে ধ্রুব সত্যি বলে প্রতিপন্ন করে দেওয়া হয়। আমার এই বন্ধুটি যেমন। আমি তাঁর মধ্যে যে ঘৃণা সঞ্চয় হতে দেখেছি তা কিন্তু তাঁর কাছে 'জাতীয় স্বার্থ'।
এই নিয়ে তর্ক শুরু হলে সেই তর্কের কোনও শেষ থাকবে না। কিন্তু তর্কটা শুরুই বা হচ্ছে কোথায়? আমরা কি তাহলে আমাদের বিশ্বাসটাকেই ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিয়েছি?
এই স্বধীনতা দিবসে আমাদের উপলব্ধি করবার সময় এসেছে সংখ্যাগরিষ্ঠরা কখনই ঘৃনায় বিশ্বাসী নয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদেশ্য প্রনোদিত কিছু লোক এই ঘৃনাকে দেশের অধিকাংশ জনগণের মধ্যে সঞ্চার করবার চেষ্টা করে চলছেন।
এই ভুল বোঝাবুঝি সাঙ্গ করতে আমাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনাটা অত্যন্ত জরুরি। এর জন্যে লড়াই নয়, যাঁরা এই ধরণের ঘৃণার জন্ম দেয় তাঁদের থেকে শত হস্ত দূরে সরে যাওয়াটাই শ্রেয়। আসুন, সকলে মিলে অহেতুক লড়াই না করে নিজেদের স্বাধীনতাটাকে উপভোগ করি।