অষ্টম-উত্তীর্ণদের প্যারামেডিক্স করার সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার সার্বিক মান খারাপ করবে
অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাস-ফেল নেই, অজ্ঞদের হাতে থাকবে রোগ নির্ণয়ের চাবিকাঠি
- Total Shares
আমরা এমন এক সংকটময় অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম যেখানে প্যারামেডিকেল কোর্সের ছাত্ররা হাসপাতালগুলিতে বেগার খাটতে বাধ্য হয়, গ্র্যাজুয়েশনের সুযোগ নেই, ইন্টার্নশিপে স্টাইপেন্ড নগন্য (২০০০ টাকা), সরকারি হাসপাতালে পরিকাঠামো ভগ্নপ্রায়, নিয়োগ অনিয়মিত, সেখানে হঠাৎ নবগঠিত ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যালায়েড মেডিক্যাল অ্যান্ড প্যারামেডিক্যাল কাউন্সিল পরিকাঠামোগত সমস্ত উন্নতির দায়কে অগ্রাহ্য করে একটি কালা সার্কুলার আনল । যেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে অষ্টম ও দশম শ্রেণী পাশ করে এক বা দু’মাসের কয়েকটি ন্যাশনাল ভোকেশনাল কোর্সের (যেমন এনসিভিটি) সার্টিফিকেট দেখিয়ে যে কেউ এই কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশন পেয়ে যাবে।
অর্থাৎ যে রাজ্যে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাশ ফেল নেই, সেখানকার সরকারি হাসপাতালগুলিতে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার সমস্ত দায়িত্ব বর্তাবে সেকেন্ড স্ট্যান্ডার্ড এই সব প্যারামেডিকসদের উপর। বিশেষত চিকিৎসা পরিষেবার মতো একটা পেশায় যেখানে মানুষের জীবন মরন ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকার এমন একটি অবৈজ্ঞানিক ও অনৈতিক সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দেয় কী করে? এই সার্কুলার দেখে শুধু প্যারামেডক্সরাই নন, বৃহত্তর চিকিৎসকসমাজ ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সমস্ত মানুষ আঁতকে উঠেছেন এবং এর বিরোধিতা করেছেন।
প্যারামেডিক্সদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে এবং এআইডিএসও নেতৃত্বের আন্দোলনের চাপে বর্তমান রাজ্য সরকার ২০১৫ সালে বিধানসভা ভোটের ঠিক পূর্বে এই কাউন্সিল বিল (ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যালায়েড মেডিক্যাল অ্যান্ড প্যারামেডিক্যাল কাউন্সিল বিল ২০১৫) পাস করাতে বাধ্য হয়েছিল। তা হলে প্রায় তিন বছর পর কাউন্সিল এমন একটি ছাত্রস্বার্থবিরোধী এবং জন বিরোধী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কেন? এ কি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা?
এমতাবস্থায় আমরা অল ইন্ডিয়া ডিএসও ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে আপনাদের কয়েকটি বিষয় ভেবে দেখতে বলব। প্রথমত, প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গে কয়েক হাজার প্যারামেডিক্যাল স্টাফ তৈরি হচ্ছেন ডিপ্লোমা অথবা ডিগ্রি করে। কিন্তু এর সিংহভাগেরই কোনো রিক্রুটমেন্ট হয় না। যতটুকু কাজ পাওয়া যায় তাও অত্যন্ত কম বেতনে বেসরকারি ক্ষেত্রে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে এই সার্কুলার বাস্তবে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেসরকারীকরণ নীতির প্রতিফলন মাত্র। এমবিবিএসের ক্ষেত্রে যে ভাবে এনএমসি বিল এসেছে, বিডিএস এবং নার্সিং কমিটি ভাঙার জন্য সংসদের স্থায়ী কমিটি যে পরামর্শ দিয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যাপারে বেসরকারিকরণের দিকে এগোচ্ছে বহু সরকারি সংস্থা।
অষ্টম ও দশম শ্রেণী পাশ করে একটা ভোকেশনাল কোর্স করে কেউ এই কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশন পেয়ে যাবে
প্যারামেডিক্যাল শিক্ষাও সেই দিকেই এগোচ্ছে। তাই প্রতি বছর বহু বেসরকারি সংস্থা প্যারামেডিক্যাল পড়ানোর সরকারি পরোয়ানা আদায় করেছে। আর পরিকাঠামোহীন এই প্রাইভেট সংস্থাগুলিতে পড়ানোর নামে ছাত্রদের থেকে হাজার হাজার টাকা আদায় করে তাদের দিয়ে টেকনোলজিস্টদের কাজ করিয়ে নিচ্ছে । দ্বিতীয়ত, নার্সিংহোমগুলোতে নন-টেক অর্থাৎ শিক্ষাগত মান নেই যাদের, তাদের দিয়েই কম বেতনে ডায়াগনস্টিকের সমস্ত কাজ করিয়ে নেয়। এই সারকুলারের মধ্য দিয়ে ডব্লিউবিএএম অ্যান্ড পিএম কাউন্সিল এদেরই সরকারি স্বীকৃতি দিতে চাইছে।
আরও একটি বিষয় সকলের দৃষ্টিগোচরে আনতে চাই, বহুদিন পর এআইডিএসও-র আন্দোলনের চাপে গত বছর কিছু স্থায়ী নিয়োগ হয়েছিল। এই নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও বড় মাপের দুর্নীতি খবরের কাগজে এসেছিল। জানা যায়, এমন ও কিছু সংখ্যক টেকনোলজিস্ট নিযুক্ত আছেন যাঁরা ডিপ্লোমা তো দূর অস্ত্, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকও হয়তো পাস করেননি।
একটু দেখে নেওয়া যাক, কি হতে পারে এই সার্কুলারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে। প্রথমত, প্রযুক্তি নির্ভর ও পরীক্ষামূলক জটিল রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ের যুগে প্যারামেডিক্যাল স্টাফ ছাড়া চিকিৎসা অসম্ভব। রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা বা ডায়াগনোসিস করার ক্ষেত্রে এই উন্নত হাতিয়ারগুলোর অপব্যবহার বা ভুল ব্যবহার হলে মানুষ সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবেন। একই সঙ্গে চিকিৎসা ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত সকলের (ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক্যাল স্টাফ) সঙ্গে রোগীদের সম্পর্ক তিক্ত হবে।
দ্বিতীয়ত, একবার ভাবুন নিজেদের পিতা, মাতা, ভাই, বোন, বাড়ির লোকের ডায়ালিসিস করবে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই, ইসিসি, ক্যাথেটার করবে অষ্টম শ্রেণী পাস করে প্যারামেডিক্যাল পড়া ছেলে; যার বয়স ১৫ বছর, যে নাবালক! যার পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীবনবিজ্ঞানের কোনও জ্ঞান নেই। এটা মেনে নিবেন কি? এই গুরুত্বপূর্ণ পেশাগুলো শুধুমাত্র কালিমালিপ্ত হবে তাই নয়, বাস্তবে সকলে ব্যবসায়ী হয়ে যাবেন।
এই সার্কুলার দেখে শুধু প্যারামেডক্সরাই নন, বৃহত্তর চিকিৎসকসমাজ ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সমস্ত মানুষ আঁতকে উঠেছেন এবং এর বিরোধিতা করেছেন
এই ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি আবিষ্কারের নেপথ্যে রয়েছে অনেক বিজ্ঞানীর চোখের জল, বুকের রক্ত। যাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন মানুষকে রোগমুক্ত করার। যে পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তা স্বাস্থ্য বিরোধী, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে সেই সব মানুষের স্বপ্ন ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে।
তৃতীয়ত, এই সার্কুলারের মাধ্যমে বেসরকারি মেডিক্যাল সংস্থাগুলো ঢালাও প্যারামেডিক্যাল পড়ানোর লাইসেন্স পেয়ে যাবে। এর ফলে তারা তাদের মর্জি মাফিক কোর্স ফি নির্ধারণ করবে, তাই গরিব, সাধারণ মেধাবী ছাএদের বঞ্চিত করে, যাঁদের অর্থবল আছে তাঁরাই প্যারামেডিক্যাল পড়ার সুযোগ পাবে।
এই অবস্থায় অবিলম্বে রাজ্য সরকারকে এই অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে এআইডিএসও প্যারামেডিক্যাল ইউনিট লাগাতার কলেজগুলোতে ও রাজ্যগত ভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আন্দোলনের চাপে সরকার প্যারামেডিকসদের ছাত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়, স্টাইপেন্ড বৃদ্ধি ও রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করে। সরকারি দলের পেটোয়া ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি ছাত্রদের বিভ্রান্ত করে, সরকারি বিলগুলি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিভিন্ন ভাবে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। তাই বিভ্রান্ত না হয়ে এআইডিএসও-এর ডাকে দুর্বার ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে এবং এই সার্কুলার রুখে দেওয়ার শপথ নিতে হবে।