হামি: শিশু অভিনেতাদের নিয়ে আসলে বড়দেরই বার্তা দিয়েছেন দুই পরিচালক
ইগোর জেরে বড়রা ঢুকে পড়েন শিশুদের অন্দরমহলে, নষ্ট হয় তাদের নিজের জগৎ
- Total Shares
“ইচ্ছা হয়ে ছিলি তুই মনের মাঝারে”
এখন অবশ্য এত সহজ ভাবে মায়েরা ব্যাখ্যা করতে পারেন না সন্তানের জন্মবৃত্তান্ত। ছোট ঘরে অনেক সময় বেআব্রু হয়ে যায় বড়দের কথাবার্তা, তাঁদের আচরণ। শিশুমন সে সব না বুঝে ব্যাখ্যা খুঁজতে যায়। আর বড়রাও হিমসিম খেয়ে যান অনেক সময় ঘরোয়া আলোচনায় উঠে আসা প্রেগনেন্ট বা টেলিভিশনের খবরে শোনা শ্লীলতাহানি শব্দের অর্থ ওই শিশুদের বোঝাতে গিয়ে। নিজেদের ইগো বজায় রাখতে তাঁরা ঢুকে পড়েন শিশুদের অন্দরমহলে, যাতে ভেঙে যায় শিশুদের নিজের জগৎ। হামি ছবি তাই অভিভাবকদের কাছে একটা বার্তা। কী করবেন না, তার বার্তা।
অতি-সক্রিয় এবং একই সঙ্গে প্রভাবশালী অভিভাবকদের জন্য স্কুলের পরিবেশ কী ভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে হামি গল্পের মধ্য দিয়ে তা ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। গুজব বা ভিত্তিহীন ঘটনা কী ভাবে সংবাদ-শিরোনামে উঠে আসে এবং তার প্রভাবে কী ভাবে জীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তা প্রাঞ্জল ভাবে দেখানো হয়েছে। হাস্যরসের উপাদান রয়েছে অনেক, তবে তার গভীরে ঢুকলে ভয় পেয়ে যেতে হয়। কোন পথে চলেছি আমরা!
বিভিন্ন আর্থসামাজিক পরিবেশ থেকে আসা শিশুদের কী ভাবে স্কুলগুলি সামলায়, তা দেখানো হয়েছে এই ছবিতে। কেউ স্কুলে এসে নকল করছে আগের রাতে মদ্যপান করা বাবার চরিত্র, কেউ আবার একটু বেশি পাকা, সেটিতে স্কুলের কতটা ভূমিকা আছে বলা মুশকিল। তাই ছবিটি মোটেই ছোটদের ছবি নয়, বরং শিশু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়ে বানানো বড়দের ছবি, যা অবশ্যই দেখা উচিৎ প্রতিটি অভিভাবকের।
বড়দের ছবি, যা অবশ্যই দেখা উচিৎ প্রতিটি অভিভাবকের
ভিত্তিহীন একটা অভিযোগ কী মারাত্মক জায়গায় যেতে পারে, তা দেখানো হয়েছে হামি ছবিতে। এই ছবিটি দেখার পরে স্কুলের ব্যাপারে বা স্কুলের সঙ্গে জড়িত কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানর আগে অভিভাবকদের একটু ধৈর্যশীল হতে হবে। যে স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করেছেন, সেই স্কুলের উপরে বিশ্বাস রাখতে হবে। একবার কারও নামে অপবাদ রটে গেলে নিরপরাধ ব্যক্তির জীবন যে বড় বিড়ম্বনাময় হয়ে ওঠে! এক শিশুর কান্নার কারণ জানতে গিয়ে স্নেহশীল চাচাকে শ্লীলতাহানিতে অভিযুক্ত হতে হয়েছে। চাচার বিদায়বেলা হঠাৎ মনে করিয়ে দেয় দুষ্টু মিষ্টি ছবিতে প্রধান শিক্ষিকার বিদায়বেলায় সেই গান – লম্বাদাড়ি চৌকিদার, বলছে হেঁকে খবরদার। তবে এখানে সেই শিশুদের ভালোবাসা তখনকার মতো অন্তত বেঁধে রাখতে পারল না চাচাকে। পুরোনো মানুষের কাছে বিশ্বাসটাই সম্বল। একবার সেই বিশ্বাস ভেঙে গেলে তাঁদের পক্ষে কাজ করাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে।
পেশাগত ও পারিবারিক কারণে অনেকের হয়ত ‘উপর মহলে’ অনেক যোগাযোগ থাকে, কিন্তু নিজের ইগোর সন্তুষ্টির জন্য সেই ক্ষমতার আস্ফালন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কতটা সমস্যা ফেলে দেয়, তা সুন্দর ভাবে দেখিয়েছেন দুই পরিচালক।
শিশুদের নিজের জগৎ আছে। আগেও ছিল। তবে তখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন সেট ছিল না। আবার বড়রাও সন্তানদের সামনে নিজেদের ব্যক্তিজীবন আড়াল করে রাখতেন। কিন্তু এখন অনেক কথাই আলোচনা হয় শিশুদের সামনে। শৈশবের কথা নয়, বরং সমাজের কথাই বেশি করে দেখিয়েছে নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি হামি। গুজব বা ভিত্তিহীন ঘটনা কী ভাবে সংবাদ-শিরোনামে উঠে আসে সেটা খুবই আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে।
ছবিতে হাস্যরসও ছিল। দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজনৈতিক নেতা পরিবারে কতটা কুঁকড়ে থাকেন, মধ্যবিত্তের মধ্যে অজানা আশঙ্কায় অসুস্থতা, রাজনৈতিক দলের দাদাগিরি এমন অেনক কিছুই দেখানো হয়েছে ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে। দেখানো হয়েছে শিশুকে নিয়ে দাম্পত্যকলহ।
শৈশবের কথা নয়, বরং সমাজের কথাই বেশি করে দেখিয়েছে নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি হামি
ছবি শেষ হয়েছে পোয়েটিক জাস্টিস দিয়ে। তবে বাস্তবে তা কতদূর হয় বলা মুশকিল। ইগোর লড়াই বাড়তেই থাকে। সামাজিক বিভেদটাও শিশুমনে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়, যা পরবর্তীকালে মহীরূহের আকার ধারণ করার আশঙ্কা তৈরি করে। উচ্চশিক্ষা হয়ত মার্জিত ও স্মার্ট তৈরি করে, কিন্তু অল্পশিক্ষিতা মহিলার সঙ্গে উচ্চশিক্ষিতা মহিলা এবং তাঁর গবেষক-অধ্যাপক স্বামীর মানসিকতার যে এতটুকু তফাৎ নেই সেটা দেখানোর পাশাপাশি আগের প্রজন্মের সেই খোলামেলা দিনগুলো, স্কুলকে ভালোবাসার কথা একটামাত্র সংলাপে তুলে ধরেছেন শিবপ্রসাদ। ছবিটি অন্তেমিল হলেও বাস্তবটা অবশ্য তেমন নয়।
হামি – একটা শব্দ দিয়েই দুই প্রজন্মের পার্থক্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন পরিচালকদ্বয়।