ভ্রমণ বা পর্বতারোহণ সংস্থাগুলো কি কোনও দায়িত্ব নেই পরিবেশ ধ্বংসের কারণ নিয়ে ভাবার?
ডুয়ার্স অঞ্চলে নতুন নতুন অতিথিশালা গড়ে উঠল, হারিয়ে গেল বন্য মহিষের পাল
- Total Shares
ভারতীয় শাস্ত্রে একটি কথা আছে 'চরৈবেতি'। সম্ভবত পরবর্তীকালে রবীন্দ্র সাহিত্যে চরৈবেতি কথাটি স্থান পেয়েছিল নতুন আঙ্গিকে, 'পথ আমারই সাথী, আমি পথের লাগি বৈরাগী'। অজানাকে জানার বিপুল আগ্রহ মানুষকে এক পড়ন্ত থেকে আর এক পপ্রান্তে নিয়ে গেছে। সভ্যতার বিকাশের প্রথম স্তরে খাদ্যের সন্ধানে বা কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে মানব গোষ্ঠীকে এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে যেতে হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে মানব গোষ্ঠী রাষ্ট্র সৃষ্টি করে জনসমষ্টিকে স্থিতিশীল করেছিল। ফলতঃ আদিম ব্যবস্থার মতো মানুষকে আজ আর পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ইচ্ছেমত বিচরণ করতে পারে না। রাষ্ট্রীয় আইন, আন্তর্জাতিক আইন মানুষের চলাচলের উপর গন্ডি কেটে দিয়েছে।
কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে সহজাত ভ্রমণ পিপাসা আজও অব্যাহত। অতীতে পথ ছিল দুর্গম। এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে যাতায়াত করা সহজবোধ্য ছিল না। ফলতঃ সাধু সন্যাসীরাই যত্রতত্র বিপদের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতেন। পরবর্তী ক্ষেত্রে রাস্তাঘাট যানবাহনের উন্নতি সহ অন্যান্য পারিপার্শিক অনুকূল পরিবেশে সাধারণ মানুষও ভ্রমণে অংশগ্রহণ করতে আরম্ভ করে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে মূলতঃ তিন ভাগে ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রথমত ধর্মীয় কারণে, দ্বিতীয়ত নিছক প্রকৃতিকে ভালোবাসার কারণে বা ঐতিহাসিক স্থান দেখার কারণে এবং তৃতীয়ত সম্পূর্ণভাবে অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক স্থান দেখা বা জানার কারণে। ভারতবর্ষের ভ্রমণ পিপাসু মানুষের শতকরা বিরানব্বই ভাগ মানুষই প্রথম ও দ্বিতীয় কারণে বশবর্তী হয়েই ভ্রমণে অংশগ্রহণ করেন। তার মধ্যে বাঙালি ভ্রমণার্থী সম্ভবত ভারতের বুকে সবথেকে বেশি।
প্রবাহিত গঙ্গা সর্বাঙ্গে দূষণের প্রকোপে আক্রান্ত
ভ্রমণকে কেন্দ্র করে পৃথিবীব্যাপী এক বাজার সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেরল, ঝাড়খণ্ড থেকে হিমাচল, রাজস্থান থেকে অসম সমস্ত রাজ্যই আজ ভ্রমণার্থী মানুষদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। কেবলমাত্র দেশীয় স্তরে নয়, আন্তর্জাতিক স্তরে এক নতুন ব্যবসায়িক বাজার তৈরি হয়েছে, ভ্রমণকে কেন্দ্র করে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে সম্বল করে পৃথিবী জুড়ে ভ্রমণার্থীদের জন্য ব্যবসায়িক জগৎ তৈরি হয়েছে। আর, সেই ব্যবসায়িক বাজারকে নতুন মোড়কে বিগত কয়েক বছর ধরে মানুষের কাছে পেশ করা হচ্ছে সবুজ ভ্রমণের নামে। টিভি খুললেই মালয়েশিয়া থেকে আফ্রিকার মোহময়ী দৃশ্যে মানুষকে বোঝানোর হচ্ছে স্বর্গসুখ পেতে হলে বা প্রাকৃতিক নির্জনতা উপভোগ করতে চলে আসুন আফ্রিকার গহন জঙ্গলে বা অ্যামাজনের উপত্যকায় বা মালয়েশিয়ার নৈশ্য ক্লাবে। কিন্তু এই ছবির অবাক কিছুই হয়ত পরিবেশগতভাবে বিশ্লেষিত হচ্ছে না। মালয়েশিয়া, আফ্রিকা বা অ্যামাজনের বুকে অরণ্য ধ্বংসের কথা সর্বজনবিদিত। প্রতি মুহূর্তে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে বা বহু প্রজাতি মুছে যাচ্ছে, সেখানে সবুজ ভ্রমণের হাতছানি কতটা সবুজ এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চলে নতুন নতুন অতিথিশালা গড়ে উঠল ভ্রমণার্থীদের জন্য কিন্তু হারিয়ে গেল বন্য মহিষের পাল।
এই সমস্ত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন কি স্বেচ্ছাসেবী ভ্রমণ সংস্থাগুলোর প্রয়োজন নেই। স্বেচ্ছাসেবী ভ্রমণ সংস্থা বা পাহাড়ে চড়ার ক্লাবগুলোর কি কোনও দায়িত্ব নেই পরিবেশ ধ্বংসের কারণ নিয়ে ভাবার? পশ্চিমবঙ্গে কয়েকশো 'পাহাড়ে চড়ার' সংস্থা আছে যারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পাহাড়ে বা সমুদ্রে প্রকৃতি দর্শনে যান। শুশুনিয়া পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিতে যাননি এমনও পর্বতারোহণ সংস্থা খুব কমই আছে। কিন্তু শুশুনিয়া পাহাড় যখন বৃক্ষশূন্য হচ্ছিল তখন কিন্তু কোনও পর্বতারোহণ সংস্থাকে বিশেষ প্রতিবাদ করতে শুনিনি। পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য এলাকা বা সুন্দরবন এলাকায় প্লাস্টিকের দাপটে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু একটি ভ্রমণ সংস্থা বা পর্বতারোহণ সংস্থাকে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখিনি।
ডুয়ার্স অঞ্চলে নতুন নতুন অতিথিশালা গড়ে উঠল ভ্রমণার্থীদের জন্য কিন্তু হারিয়ে গেল বন্য মহিষের পাল
তাহলে কি ভ্রমণ সংস্থা বা পর্বতারোহণ সংস্থাগুলো কেবলমাত্র ভ্রমণের আত্মসুখ উপলব্ধি করতেই জন্ম নিয়েছেন? তাদের কি বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধতা নেই পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে। এই পশ্চিমবঙ্গের মানুষই ভারতের ভ্রমণ বাজারের অন্যতম ক্রেতা। অথচ পশ্চিমবঙ্গের বুকেই সোনালী নদী হারিয়ে গেছে। হুগলির সরস্বতী নদী মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আর প্রবাহিত গঙ্গা সর্বাঙ্গে দূষণের প্রকোপে আক্রান্ত। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া সহ বিভিন্ন জায়গাতেই অরণ্যের হাতছানি কমছে আর বন্যা প্রাণী ধ্বংসের ভয় তটস্থ।
অবশ্য শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সমগ্র ভারতবর্ষ তথা পৃথিবী জুড়ে ভোগবাদের দাপটে সুস্থ নির্মল পরিবেশের নাভিশ্বাস উঠেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধবাজ কয়েকটি দেশের প্রতিনিয়ত পরিবেশ ধ্বংসের সংহার চিত্র। উপসাগরীয় যুদ্ধে জীববৈচিত্র চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল কিন্তু সবুজ ভ্রমণের ক্রেতারা কেউই প্রতিবাদ করলেন না। স্বভাবতই পৃথিবীর সবুজ ভ্রমণের দর্শন আজ জিজ্ঞাসার মুখোমুখি।
সবুজ ভ্রমণ কি আজ ভোগবাদের ওপর নাম? ভ্রমণের আত্মসুখের সঙ্গে ভ্রমণ পিপাসুদের আজ ভাববার সময় এসেছে আগামী দিনে ভ্রমণ করার মতো স্থান আর থাকবে কিনা। তাই রবীন্দ্রনাথের কথাতেই মনে হয় অনেক দূরের পর্বত আর সমুদ্র আমরা দেখতে গেছি সম্ভবত দেখা হয়নি বাড়ির পাশে ঘাসের উপর নির্মল শিশির বিন্দুর অবস্থান।