কী ভাবে তীর্থক্ষেত্র থেকে দ্রুত পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠছে গঙ্গাসাগর
মকর সংক্রান্ত্রির সময় ছাড়া বাকি সময় পর্যটনকেন্দ্র, কিন্তু সমস্যা গুণ্ডামি
- Total Shares
গঙ্গাসাগর বলতে এক সময় ধারনা ছিল মকর সংক্রান্তির সময়ে পূণ্যস্নান। কপিলমুনির আশ্রম ঘিরে ভিড়। তিন দিন পরে আবার নিশুতি হয়ে যেত সাগরদ্বীপ। মকরসংক্রান্তির স্নান ছাড়া অন্য কোনও সময় সাগরদ্বীপে কেউ যেতেন না। এখানে থাকার জায়গা বলতে ছিল একমাত্র ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের ধর্মশালা।
সাগরমেলা ঘিরে এখনও সেই একই উন্মাদনা আছে ঠিকই, তবে তীর্থযাত্রা বলতে আমরা যে পরিশ্রম করে কোনও জায়গায় যাওয়ার কথা ভাবি এখান আর আর সেই পরিশ্রম করতে হয় না সাগরদ্বীপে। অবশ্য বৈষ্ণোদেবী থেকে অমরনাথ – সর্বত্রই বিকল্প ব্যবস্থা হয়েছে। তাতে পূণ্যলাভ কমেছে কিনা বলতে পারব না।
সাগরদ্বীপে মকর সংক্রান্তির সময় যাঁরা পূণ্যস্নান করেন তাঁরা মূলত আসেন অন্য রাজ্য থেকে এবং এই রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে – শহুরে লোকজনকে এই সময় একেবারেই দেখা যায় না। তবে বছরের অন্য সময় এখানে লোকে বেড়াতে আসছেন। তাই সাগরদ্বীপ দ্রুত তীর্থক্ষেত্র থেকে পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠছে। অন্য পর্যটন কেন্দ্রের সঙ্গে অবশ্য এখনও বেশ কয়েকটি পার্থক্য আছে সাগরদ্বীপের।
প্রথমে আসা যাক সাগরমেলার কথায়।
আগে সাগরমেলা মানেই ছিল মারাত্মক পরিশ্রমসাধ্য, বিশেষ করে পৌঁছানো ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এখন যাতায়াতের অনেক সুবিধা হয়েছে। আগের চেয়ে আরও বেশি জায়গা থেকে লঞ্চ ছাড়ছে। মূল ভূখণ্ড থেকে সাগর পর্যন্ত একটি সেতু তৈরি করা হচ্ছে। ফলে কিছুদিন পরে আর লঞ্চ পারাপারের দরকারও হবে না সাগরদ্বীপে যাওয়ার জন্য।
এখানে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের হাজারখানেক স্বেচ্ছাসেবক থাকতেন পূণ্যার্থীদের সেবা করার জন্য। এখন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। পুরো এলাকা আলোকময় হয়ে ওঠে সরকারের উদ্যোগে। এখানে রামকৃষ্ণ মিশন এবং বেশ কয়েকটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও এখন পরিষেবা দিচ্ছে। থাকারও অনেক জায়গা হয়েছে।
সবচেয়ে ভালো যে ব্যবস্থা হয়েছে তা হল পরিচ্ছন্নতা।
সাগরদ্বীপে কপিলমুনির আশ্রম (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
সাগরমেলা মানেই যত্রতত্র প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া যেন দস্তুর হয়ে গিয়েছিল। এই সমস্যা দূর করতে প্রথমে অস্থায়ী শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এখানে যাঁরা আসতেন তাঁদের বড় অংশ শৌচাগারের ব্যবহার জানতেন না, ফলে শৌচাগার থাকলেও কাজের কাজ কিছুই হত না। এখন লোকে শৌচাগারের ব্যবহার শিখছেন, একই সঙ্গে বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। তাতে দুর্গন্ধ ও দূষণ থেকে অনেকাংশে মুক্ত হয়েছে গঙ্গাসাগর।
এখানে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়, তাই আগের মতো সন্ধ্যা নামলেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসে না। মোবাইল ফোনের টাওয়ারের ব্যবস্থা করে বিএসএনএল, ইন্টারনেট টাওয়ারেরও তারা ব্যবস্থা করে। তবে কয়েকদিন এত লোকের চাহিদা মেটানোর পক্ষে সেই ইন্টারনেট ব্যবস্থা যথেষ্ট হচ্ছে না – এখন তো লোকের হাতে হাতে স্মার্টফোন, তাতে ইন্টারনেটও রয়েছে। তাই নেট স্লো চলে।
পূণ্যস্নানে সাধাুসন্তরা (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
সারা বছর সাগরদ্বীপে দোকান-পসার প্রায় থাকে না, কেউ যদি বেড়াতে যান এখানে ভরসা সেই হোটেলের খাবারই। পর্যটকের সংখ্যাও হাতেগোনা। তাই বকখালি-দীঘার বদলে অনেকে এখন সাগরদ্বীপে উইকএন্ড ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন। এখনও পুরোপুরি পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি বলে এখানে দু’টি বড় সমস্যার মুখে পড়েন পর্যটকরা। প্রথম সমস্যা হল নদী পার হওয়ার পরে হোটেলে যাওয়া। একটি গোষ্ঠীই সেখানে আছে এবং তারা যে ভাড়া হাঁকবে তাতেই যেতে হবে। সরকারি বাসের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়, তা ছাড়া সেই গুন্ডাবাহিনী তাতে উঠতেই দেবে না। বেশ বড় দল হলে তার খুব একটা ঝামেলা করে না, না হলে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। কারণ আপনি হেঁটে যেতে চাইলে সঙ্গের মহিলাদের কটূক্তি সহ্য করতে হবে এবং তারা আপনার সর্বস্ব কেড়েও নিতে পারে।
দ্বিতীয় এবং আরও বড় সমস্যা হল, এখানে পুলিশকর্মীরা তো থাকেনই না, আর থানা এত দূরে যে সেখানে যেতে হলে ওই দলটির থেকেই আপনাকে গাড়ি নিতে হবে, অন্য উপায় নেই। তারপরেও অভিযোগ আদৌ দায়ের করা যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অভিযোগ জমা পড়ে না, তাই সকলেই জানলেও কেউ কোনও পদক্ষেপ করে না। গঙ্গাসাগর মেলার সময় পুলিশ-প্রশাসনের বড়কর্তাদের আনাগোনা থাকায় এই দলটি এক সপ্তাহের জন্য হম্বিতম্বি বন্ধ রাখে।
বেশিরভাগ পর্যটকই উটকো ঝামেলা মেনে নেন কিছুক্ষণের জন্য। মেনে নিলে সমস্যা নেই।
একবার হোটেলে ঢুকে পড়তে পারলে নিশ্চিন্ত। নিরালায় অবসর কাটানোর পক্ষে সাগরদ্বীপ একেবারে আদর্শ জায়গা। চুপচাপ সময় কাটাতে পারবেন একেবারে নিজের মতো করে। দীঘার মতো ভিড় নেই, কিন্তু সুন্দর সমুদ্রসৈকত আছে। ডায়মন্ড হারবার ও কাকদ্বীপ হল গঙ্গার মোহনা, তবে সাগরদ্বীপের দক্ষিণপ্রান্তে আপনি সাগর দেখতে পাবেন।
সাগরমেলার সময় আসেন মূলত গ্রামের মানুষজন, বছরের অন্যসময় অবশ্য আসেন একেবারে শহুরেরা। দূরত্বটাও দীঘার চেয়ে কম, আর অনেক বেশি নিরিবিলি। তাই ক্রমেই শহুরে বাঙালির কাছে মকর সংক্রান্ত্রির সময় ছাড়া বছরের অন্য সময় এই জায়গার আকর্ষণ বাড়ছে।
পুণ্যতীর্থ সাগর ক্রমেই হয়ে উঠছে পর্যটকদের সপ্তাহান্তের ছুটি কাটানোর জায়গা।