তেলের যা দাম বাড়ছে তাতে ভবিষ্যতে ধনতেরসের মতো তেলেতরসও হতে পারে
তেলের দাম কমলে কোনও সংগঠন ভাড়া কমাতে চায় না
- Total Shares
সবার বাড়িতে জলের ট্যাঙ্কের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে বায়ুনিরোধক এক ট্যাঙ্ক। বছরে দুবার এই ট্যাঙ্ক পরিষ্কার ও রং করা হয়। বায়ুরোধী এই ট্যাঙ্কে যা রাখা হয়, বছরে দু’বার তার উপর থাকে বিশেষ ছাড়। থাকে ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির প্যাকেট প্রদান, সঙ্গে ঠান্ডা পানীয়ের ব্যাবস্থা। বছরের এই সময় মানুষ প্রচুর পরিমাণে এই তরল দ্রব্য কিনে জমিয়ে রাখে নিজেদের বাড়ি লাগোয়া এই ট্যাঙ্কে। এই নতুন উৎসবের প্রস্তুতি নিতে ব্যাস্ত থাকেন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আপামর সাধারণ মানুষ। অনেকটা ধনতেরসের মতো এই উৎসবের নাম – তেলতেরস। আর কিছু বছর পরের এই সাধারণ দৃশ্যই হল আজকের ‘ফিরে দেখা ভবিষ্যৎ’ (back to the future) ।
ধনতেরসের সময় যেমন মাঝ রাত থেকে বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, রাসবিহারি আর গড়িয়াহাটের সব সোনার দোকানে ভিড় করেন ক্রেতারা, ঠিক সেরকম দৃশ্যই দেখা যাবে পেট্রল পাম্পের সামনে। সাধারণ মানুষ নিজেদের সঞ্চয় আর বড় বড় বায়ুনিরোধক বোতল বা ট্যাঙ্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এই অপেক্ষায় যে শুধু মাত্র সেইদিন বেশ কয়েক লিটার পেট্রল বা ডিজেল যদি তাঁরা তুলে রাখতে পারেন তবে সারা বছরের তেল খরচা থেকে কিছুটা অন্তত বাঁচানো যাবে। উল্টো দিকে পাম্প মালিকরা তাঁদের গ্রাহকদের আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি রাখছেন না। মিষ্টির প্যাকেট, ঠান্ডা পাণীয় থেকে বেশি লিটার তেল কেনার উপর থাকছে বিশেষ পুরস্কার বা লটারির মাধ্যমে গাড়ি বা বাইক জেতার সুযোগও।
যে হারে তেলের দাম বেড়েছে তাতে ‘আধার’ কার্ডধারী মানুষের ‘ধার’-দেনায় ডুবে মরার অবস্থা
আসলে লটারিতে জেতা গাড়ি বা বাইক তো আর জল দিয়ে চলবে না, তার জন্যও লাগবে তেল। তাই এটা এক ধরনের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি হতেই পারে। তবে এই উৎসব তখনই সম্ভব যদি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার বছরে অন্তত এক দিনের জন্য তেলের উপর চাপানো ট্যাক্স তুলে নেয়।
কলকাতায় সবকিছুরই একটা করে ইউনিয়ন তৈরি হয়ে যায়, শুধু সাধারণ মানুষ ‘ইউনাইটেড’ হতে পারে না [ছবি: সুবীর হালদার]
গত বেশ কয়েক বছরে যে হারে তেলের দাম বেড়েছে তাতে ‘আধার’ কার্ডধারী মানুষের ‘ধার’-দেনায় ডুবে মরার অবস্থা। তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে চাল, আলু থেকে জীবনের সব ক্ষেত্রেই। দাম বৃদ্ধির বেশ অনেকটা জুড়েই রয়েছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারে চাপানো ট্যাক্স। এই দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে যতই রাজ্য সরকার কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মিছিল করুক না কেন, তাদের যদি সত্যিই কিছু করার ইচ্ছে থাকতো তাহলে তেলের উপর রাজ্য সরকারের চাপানো কর মকুব করত। কিন্তু মানুষ যে রাজ্যে বাস করছে সেখানে তো ‘বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না।’ তাই ভর পেট না খেয়েও মানুষ মুখ বুজে রাজকর দিয়ে চলেছে। কারণ সরকারের কাছে ‘রাজস্ব দানে যেখানেই গাফিলতি, সেখানেই ক্ষতি’।
কলকাতাবাসী ঐতিহ্যের ধারা বজায় রাখতে চিরকালই অন্যদের থেকে এগিয়ে। তাই সেই ৩৫ বছরের ধারা বজায় রেখে কলকাতায় সবকিছুরই অন্তত একটা করে ইউনিয়ন তৈরি হয়ে যায় শুধু সাধারণ মানুষ ‘ইউনাইটেড’ হতে পারে না। বাস, অটো, ট্যাক্সি এমন কী ওলা/উবের-এর ইউনিয়নগুলি তেলের দাম বাড়লেই হই-হই রব তোলে ভাড়া বাড়ানোর জন্য। কিন্তু কোনও ইউনিয়ন তেলের দাম কমানোর উপর বেশি জোর দেয় না, তাহলে যে শীর্ষ নেতারা চটে যাবে।
ধনতেরসের মতো এবার কি তেলতেরস
আর সাধারণ মানুষের যে বোতাম টেপা ছাড়া আর কিছু করার নেই, অনেক ক্ষেত্রে তো বোতাম টেপাও ভাগ্যে জটে না। তাই সব মুখ বুজে মেনে নেয় আর বাড়িতে বউ ছেলের উপর এইসবের প্রভাব পড়ে। ছেলের মাধ্যমিকে দু-পাঁচ নম্বর কম পাওয়ার রাগের উপর চড়ে বসে মূল্যবৃদ্ধি ও বেতন না বাড়ার ক্ষোভ।
এখনকার পরিস্থিতি দেখে যেটা সবার আগে মনে হচ্ছে সেটা হল সাধারণ মানুষকে বেশ কয়েকটি ব্যাপারে প্রস্তুত থাকতে হবে। আগে যেমন গ্রামের দিকের লোকেরা প্রচুর হাঁটতে পারত কিন্তু বাইক আসার পর তারা হাঁটা ভুলে গেছেন, তেমনই শহুরে মানুষ অটো নির্ভর হয়ে হাঁটতে ভুলে গেছে। এই সব মানুষের মাথায় একটাই বাণী গেঁথে দিতে হবে ‘হাঁটো হাঁটো, হাঁটা প্র্যাকটিস করো।’ আর একান্তই যদি সেটা না পারও তবে বাড়ির ছাদে বায়ুনিরোধক ট্যাঙ্ক বানিয়ে অপেক্ষা করও কবে হবে তেলতেরস।