ট্রাম চালু রাখতে প্রথম আন্দোলন, কেমন ভাবে বন্ধ হল হাওড়ার ট্রাম

গণেশ পাইন বললেন ওই ট্রামে চেপে আমাদের বাড়িতে আসবেন

 |  4-minute read |   28-08-2018
  • Total Shares

হাওড়ার ট্রাম নিয়ে কিছু বলার আগেই রাধারমণ মিত্র মহাশয়ের কলিকাতা দর্পনে যোগাযোগ ব্যবস্থায় হাওড়ার ট্রাম সংক্রান্ত অধ্যায়টি পড়ে ফেলা উচিত। সেখানে উনি বলছেন: হাওড়া মিউনিসিপ্যালিটি কলকাতার ট্রাম কোম্পানিকে ২৬.১১.১৯০৭ সালে ট্রামলাইন খোলার অনুমতি দেন (যদিও যদিও সুবর্ণরেখা পাবলিকেশনের এই বইটিতে ছাপা হয়েছে ২৬.১১.১৮০৭, কিন্তু এটি ছাপার ভুল বলে মনে হয়)।

tram-1_082818025516.jpgহাওড়ার এক কামরা ট্রাম (ছবি সৌজন্য: লেখক)

যাই হোক ২৭.১১.১৯০৭ সালে এই অনুমতির ফলে হাওড়ার ডবসন রোড ও গোলাবাড়ি রোডের মোড়ে একটা কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন স্টেশন স্থাপন করে এবং উত্তর বিভাগের দুই পথে ৪ ফুট সাড়ে ৮ ইঞ্চি মাপের দুটি ট্রাম লাইন ও দক্ষিণ বিভাগে ওই মাপেরই একটা লাইন পাতা হয়। দক্ষিণের লাইন খোলা হয় ১০.০৬.১৯০৮ সালে। এই লাইনটি হাওড়া পুল থেকে শুরু হয়ে বাকল্যান্ড ব্রিজের উপর দিয়ে হাওড়া কোর্টের ও ময়দানের ধার দিয়ে কেওড়াপাড়া ঘাট পর্যন্ত ২ মাইল গিয়ে শেষ হয়। এটা শিবপুর লাইন। তখন থেকেই এই স্টপেজের নাম শিবপুর ট্রাম ডিপো।

উত্তর বিভাগের দু’টি লাইনও হাওড়া পুল থেকে আরম্ভ করে সালকিয়া বাঁধাঘাটের কাছে ঘুসুড়ি রোডের (এখন যোগেন মুখার্জি রোড) কাছে শেষ হয়। আর একটা লাইন যায় ডবসন রোড, পূর্ব গোলাবাড়ি রোড, হাওড়া রোড (এখন শালকিয়া স্কুল রোড) দিয়ে আর দ্বিতীয় লাইনটা যায় ডবসন রোড, পশ্চিমে গোলাবাড়ি রোড, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড, হরগঞ্জ রোড তারপর পূর্বদিকে শ্রীঅরবিন্দ রোড ধরে উত্তর বিভাগের দুটি লাইন খোলা হয় ১৯০৮ সালে, যদিও রাধারমণ মিত্র বলছেন: বর্তমান কর্তৃপক্ষ বলছেন উত্তর বিভাগের ডবসন রোড-হাওড়া রোড ধরে ট্রাম চলে ১৯০৫ সালে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এর কোনও ভিত্তি পাইনি।

tram-2_082818025736.jpgশিবপুর ট্রামডিপোয় জায়গা কম, তাই ইঞ্জিন থাকত কামরার দু'দিকেই (ছবি সৌজন্য: লেখক)

হাওড়ার ট্রাম সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ও খবর ১৯০৮ সালের পরেই পাওয়া যায়। হাওড়ায় মোট পৌনে পাঁচ মাইল ট্রামলাইন ছিল। এই দুটো লাইন যথাক্রমে ১৯৭০ সালের অক্টোবর ও ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বন্ধ হয়। তবে এটা তো রাধারমণ মিত্রের বই থেকে নেওয়া শুষ্কং কাষ্ঠং তথ্য মাত্র। আসল গল্পগুলো পাওয়া যায় ট্রামের পেটে চড়ে বেড়ানো মানুষজনের কাছ থেকে। যে সব মানুষ ট্রামকে শুধুমাত্র একটা যানবাহনের মাধ্যম না মনে করে নিজেদের মননের কথা বলার মাধ্যম বলেও মনে করতেন।

এই রকমই একটা গল্প শুনেছিলাম শিবপুরনিবাসী অরণি বসুর কাছ থেকে। বিখ্যাত চিত্রশল্পী গণেশ পাইনের সম্পর্কে বলতে গিয়ে উনি সেই সময়ের ট্রামে-মানুষের সম্পর্কের কথা বলেছেন বারবার। তখন তিনি উলুখড় নামে ছোট একটি পত্রিকা চালাতেন। তখনও শিবপুর ট্রামডিপোর ট্রাম চলত। সাধারণত শিবপুর থেকে হাওড়া, শুধুমাত্র অফিসটাইমে ডালহৌসি পর্যন্ত। সে এক আশ্চর্য ট্রাম যার দু’দিকেই ড্রাইভার কেবিন।

tram-3_082818025832.jpgহাওড়ায় ট্রাম বন্ধ হয়ে যায় ১৯৭২ সালে (ছবি সৌজন্য: লেখক)

গন্তব্যে পৌঁছে সামনের কেবিন থেকে বেরিয়ে চালক চলে যেতেন পিছনের কেবিনে আর তখন সেটাই হয়ে যেন সামনের কেবিন। সেই ট্রাম নিয়ে যে কোনও দিক দিয়েই যাত্রা শুরু করা যায়। গণেশদা (গণেশ পাইন) একদিন বললেন ওই ট্রামে চেপে আমাদের বাড়িতে আসবেন। তখন আমরা উলুখড় সবেমাত্র প্রকাশ করতে শুরু করেছি... ট্রামের কথা উঠতেই গণেশদার সঙ্গে ঠিক হল সঙ্গে এক রবিরার ৪টের সময় উনি শিবপুর ট্রামডিপোয় উনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন।

আমরা ৪টের একটু আগেই যাই ট্রামডিপোয় আর গণেশদা তার পরপরই গণেশদা হাসি হাসি মুখে ট্রাম থেকে নেমে এলেন। বোঝা গেল ট্রামযাত্রায় তিনি সবিশেষ আনন্দ পেয়েছেন। আমার বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে গণেশদা জানালেন, সময়ের আন্দাজে ভুল করার জন্য তিনি বার তিনেক শিবপুর-হাওড়া-শিবপুর করেছেন। বললেন, কী যে ভালো লাগল!

শিবপুরের ট্রামলাইন তো উঠে গেছে কবেই, ট্রামলাইনও ডুবে গেছে কংক্রিটের গভীরে। অরণিবাবুর এই গল্পগুলোও রয়ে গেছে উলুখড়ের পাতায়। আর স্মৃতির পাতায় রয়ে গেল হাওড়ার ট্রাম, রয়ে গেল স্মৃতিতে ৪১ নম্বর আর ৪২ নম্বর ট্রাম।

tram-5_082818025918.jpgট্রামের টিকিট (ছবি সৌজন্য: লেখক)

এক সময়ে হাওড়া ও কলকাতায় আলাদা ভাবে ট্রাম চলত। পরে হাওড়ায় নতুন ব্রিজ তৈরি হওয়ার পরে হাওড়া ও কলকাতার মধ্যে ট্রাম চলাচল শুরু হয়

৪০ নম্বর রুটের ট্রামগুলো ছিল এক কামরার, কেবল দ্বিতীয় শ্রেণী এবং সামনে ও পিছনে মিলিয়ে একটি করে মোট দুটি ইঞ্চিন ছিল। শিবপুর ট্রামডিপোতে গাড়ি ঘোরানোর জায়গা না থাকার জন্যই দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট গাড়ি বরাদ্দ ছিল দুই মাইল বিশিষ্ট এই পথটির জন্য।

৮১ ও ৮২ নম্বর রুটের এক কামরা ও দুই কামরার ট্রামগুলি হাওড়া স্টেশন থেকে বাঁধাঘাট পর্যন্ত যেত। ঘাসবাগানে ছিল ওই ট্রামগুলির ডিপো।

একসময় শিবপুর-সালকিয়া সংযোগকারী ট্রামের চলাচলও ছিল। বাঙালবাবুর ব্রিজের নীচে একটি মাত্র জায়গায় একই সঙ্গে ছিল ট্রাম ও ট্রেনের লাইন। এখন সে সব ইতিহাস। ১৯৫৭ সালের ২৯ জুলাই বাঁধাঘাট ও শিবপুর থেকে ডালহৌসি পর্যন্ত ট্রাম চলাচল শুরু হয়।

tram-6_082818030240.jpg

ট্রামের টিকিট (ছবি সৌজন্য: লেখক)

১৯৭০ সালের ২৫ অক্টোবর ট্রাম কোম্পানি বাঁধাঘাট লাইনের ট্রাম বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। বাঁধাঘাট পর্যন্ত লাইন তুলে দেওয়ার প্রতিবা ট্রাম কর্মচারীরা সংগঠিত হন। তাঁরা ঠিক করেন যে হাওড়া থেকে যদি কোনও ট্রাম না ছাড়তে দেওয়া হয়, তা হলে তাঁরা ঘর্মঘট করবেন। এই প্রথম ট্রাম চালু রাখার জন্য আন্দোলন সংগঠিত হয়। বাঁধাঘাট লাইনের ট্রাম তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে ২৭ অক্টোবর থেকে দু’দিনের জন্য কলকাতার সমস্ত ট্রাম চলাচল বন্ধ থাকে। তৃতীয় দিন ন’টা অবধি কন্ডাক্টরদের ব্যাগ না দেওয়ায় আবার সমস্ত কলকাতার ট্রাম বন্ধ রাখতে যখন সমস্ত কর্মীরা উদ্যত হন তখন কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে তাঁদের ব্যাগ দেন ও কাজ শুরুর অনুমতি দেন। হাওড়া থেকে সেদিন সকাল ন’টায় প্রথম ট্রামটি ছাড়ে এবং সেই দিনের মতো ধর্মঘট উঠে যায়। কলকাতায় ট্রাম চলতে শুরু করে।

তবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন আর পাঁচটা আন্দোলনের মতোই মুছে ফেলা হয়। বন্ধ হয়ে যায় বাঁধাঘাট লাইন। এক বছর পরে ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর বাঁধাঘাটের মতো শিবপুরের ট্রামও উঠে যায়। ১৯৭২ সালে হাওড়ার ট্রাম চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় বলে ঘোষণা করা হয়।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SOUVIK MUKHERJEE SOUVIK MUKHERJEE

One of the Architects of Tram Museum, Kolkata and Collector

Comment