ঋণ মকুবের রাজনীতি কৃষকদের কী ভাবে বিপদে ফেলে

আজ পর্যন্ত কোনও ঋণ মকুব প্রকল্পেই কৃষকরা লাভবান হননি

 |  4-minute read |   23-12-2018
  • Total Shares

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারই কি কৃষিক্ষেত্রের বর্তমান করুণ পরিস্থিতির জন্য দায়ী?

মনে তো হয় না।

গত দু'দশক ধরে বইতে থাকা ভারতীয় অর্থনীতির উত্তাল তরঙ্গে প্রভাবিত হয়েছে কৃষিশিল্পের দৈন্য। বর্তমান অচলাবস্থার পিছনে অবশ্য বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন বিশ্ব জুড়ে তেলের দাম বৃদ্ধি এবং নোটবন্দি ও জিএসটি রূপায়ণের মতো অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত।

এই সিদ্ধান্তগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ না করে ধরে নেওয়া যাক যে অর্থনীতির উপর এই সিদ্ধান্তগুলোর প্রভাব বেশ দীর্ঘস্থায়ী।

body_122318060111.jpg[ছবি: রয়টার্স]

কৃষি ক্ষেত্রের এই পরিস্থিতি অবশ্য রাজনীতিতে বেশ গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কৃষিক্ষেত্র উপর সর্বদাই এনডিএর পাখির চোখ ছিল। উল্টোদিকে, রাহুল গান্ধী ও কংগ্রেস আগাগোড়াই কৃষক ও কৃষি শিল্পের দুঃখ দুর্দশার কথা প্রচার করে গিয়েছেন। অন্যান্য বিরোধী দলগুলোও এই ইস্যু নিয়ে সরব হয়েছে।

এই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক প্রচার হলে তা অন্যায় নয়। শাসন ব্যবস্থা বা রাজনীতি সর্বদাই উপলব্ধির উপর নির্ভরশীল। আর, বিরোধীরা স্বাভাবিক ভাবে নেতিবাচক উপলব্ধির উপরই জোর দেবে।

মনে পড়ে, ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে কংগ্রেসকেও 'দুর্নীতি পরায়ণ' সরকার হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল।

body1_122318060123.jpg[ছবি: রয়টার্স]

কিন্তু এবার রাহুল গান্ধী ও কংগ্রেস বিষয়টির রাজনীতিকরণ করতে গিয়ে কৃষকদের ঋণ মকুব করার কথা ঘোষণা করে বড় ভুল করলেন।

গত দু'দশক ধরে কৃষকদের ঋণ মকুবের কথা ঘোষণা করা যেন একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই ধরণের কোনও ঋণ মকুব প্রকল্প আজ পর্যন্ত কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশার থেকে মুক্তি দেয়নি।

এর আগে ইউপিএ সরকার ৬০,০০০ কোটি টাকা মকুব প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিল। এই ধরণের প্রকল্প যদি কার্যকরী হত তা হলে ইউপিএর ওই প্ৰকল্পটির থেকে অন্তত কয়েকজন কৃষক লাভবান হত।

এছাড়া পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র বা কর্নাটকের মতো কয়েকটি রাজ্যও কৃষিক্ষেত্রে ঋণ মকুবের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তাতে কৃষকরা কোনও ভাবেই লাভবান হয়নি।

তা সত্ত্বেও, ভারতীয় রাজনীতিবিদরা কৃষিশিল্পের ঋণ মকুবের কথা ঘোষণা করে থাকেন, ঠিক যেমন উৎসব বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেই কর মকুবের কথাও ঘোষণা হয়ে থাকে।

body2_122318060140.jpg[ছবি: রয়টার্স]

স্বাধীনতার ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা কিন্তু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদল করতে পারলাম না।

কৃষিশিল্পের ঋণ মকুবের বিরোধিতা করার হাজারও কারণ রয়েছে। প্রথমত কৃষি ক্ষেত্রে কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে যত ঋণ নেওয়া হয় তার চেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হয় মহাজনের থেকে। তাই কৃষিঋণ মকুম করলে কাজেরকাজ তেমন কিছু হয় না। তাই ঋণের পরিমাণ মকুব করে কোনও সুরাহা হয় না। দ্বিতীয়ত, বার্ষিক ফসলচক্রের একেবারে শেষে এই মকুব কার্যকর হয়। এর ফলে জাতীয় জাতীয় ব্যয়ের হার কমে যায়।

রাজ্যের উচিত কৃষকদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং ফসলচক্রের শুরুতে, শেষের দিকে নয়।

বীজ বা কীটনাশক ক্রয়, জমি ঠিক রাখা, ট্র্যাক্টর বা পাম্প ব্যবস্থা করে দেওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে রাজ্যের সাহায্য করা উচিত। সে ক্ষেত্রে। কৃষি ক্ষেত্রের খরচ সত্যি সত্যিই বিনিয়োগের রূপ নেবে।

বিনিয়োগের পরিবর্তে আয়েও বাড়বে। যা ঋণ মকুবের চেয়ে তা অনেক বেশি শ্রেয়।

বর্তমানে, প্রায় ১.৭ লক্ষ কোটি টাকা মতো কৃষি ঋণ মকুব প্রকল্প ভারতে চালু রয়েছে। এই টাকাটাই যদি ফসলচক্রের শুরুতে বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার করা যেত তা হলে আয়ের পরিমাণটা একবার কল্পনা করে দেখুন!

body3_122318060153.jpg[ছবি: রয়টার্স]

এই সময়েই কৃষকদের সবচেয়ে বেশি অর্থের প্ৰয়োজন পরে। যা ভর্তুকি মারফত বা প্রত্যক্ষ ট্রান্সফারের মাধ্যমে মেটানো যেতে পারে। এই সময় সাহায্য করতে পারলে ঋণের বোঝা সত্যিই অনেকটা কমে যাবে।

ঋতুবন্ধু প্রকল্প যেমন এই ধরণের সময়োপযোগী একটি প্রকল্প। কৃষকরা উপহার চান না, তাঁরা সেচ ব্যবস্থা চান, বিমা চান আর তাঁদের উৎপাদনের জন্যে প্রতিযোগিতামূলক ব্যাজার চান। যে বাজারে কোনও ফড়ের উপস্থিতিতে থাকবে না।

কৃষি ঋণ মকুবকে আর্থিক সংস্থাগুলোর ফাঁদ হিসেবেও গণ্য করা যেতে পারে। ঋণ মকুব মানেই ধার ফেরত দেওয়ার অক্ষমতা প্রকাশ পাওয়া। এর ফলে কৃষকরা আরও বেশি করে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন। 

রাজনৈতিক দলগুলো যখন একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার জন্য এই প্রকল্পগুলো ঘোষণা করেন তখন দেশের অর্থনীতি এর কুফল সবচেয়ে বেশি ভোগ করে। কৃষকরাও ধরে নেন যে ঋণ নেওয়া মানে তাঁকে আর ফেরত দিতে হবে না। যে মানসিকতার প্রভাব ঋণদাতাদের উপরেও পড়ে।

এর ফলে দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে ঋণ নেওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। অথচ, অর্থবান কৃষকরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণ নিয়ে আবার ঋণ মকুবের সুবিধাও ভোগ করে চলে। যে কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতা কম তাঁরা মহাজনদের কাছে বেশি সুদে টাকা ধার নেন। আর তা ফেরত দিতে গিয়ে আরও দরিদ্র হয়ে পড়েন।

কৃষক, রাজনীতিবিদ আর অর্থনীতির মধ্যে চলতে থাকা এই দুষ্টচক্র কোনও শেষ নেই যেন।

রাজনীতিবিদদের উচিত জনপ্রিয়তা পাওয়ার আগে কৃষকদের স্বার্থ দেখা।

রাহুল গান্ধী কি আমাদের সেই পথটা দেখাবেন?

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000
Comment