দাঁত মাজলে, সাবান মাখলেও দূষিত হয় মহাসাগর, এখন করণীয় কী
বিশ্বের কোনও একপ্রান্ত দূষিত হলেই স্রোতের টানে দূষণ ছড়ায় সারা বিশ্বে
- Total Shares
আমরা দাঁত মাজলেও ক্ষতি নাকি দূষিত হয় মহাসাগর! সম্প্রতি একটি বক্তৃতায় এ কথা বলেছেন ভারতীয় প্রাণিবিজ্ঞান সর্বেক্ষণের এক বিজ্ঞানী। আশ্চর্যজনক হলেও এটিই বাস্তব। তবে শুধু মাজন নয়, প্রসাধনী হিসাবে আমরা যে সব জিনিস নিত্য ব্যবহার করে থাকি, তাতেও ক্ষতি হয় মহাসাগরের। কিন্তু তাতে আমার কী! আমি তো আর সাগর পাড়ি দিচ্ছি না।
ফিরে দেখা
একটু পিছন থেকে ভাবা যাক। ২০০৯ সালে আমাদেরই প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ তাদের মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছিল ভারত মহাসাগরের নীচে। এই বৈঠকের মাধ্যমে তাদের বার্তা ছিল, সমুদ্রের জলস্তর যে ভাবে বাড়ছে তাতে অচিরেই জলের নীচে চলে যাবে মালদ্বীপ। তারও বেশ কয়েক বছর আগে, অর্থাৎ ২০০২ সালে একই রকম আশঙ্কা প্রকাশ করে, কার্বন নির্গমন নিয়ে একেবারে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছিল টুভ্যালু নামে ছোট্ট এক দ্বীপরাষ্ট্র। কার্বন নির্গমন বাড়লে বাড়ে পৃথিবীর উষ্ণতা, গলতে শুরু করে মেরুদেশের ও পাহাড় চূড়ার বরফ। বেড়ে যায় সমুদ্রের জলস্তর। তাতেই চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয় ছোট ছোট বহু দ্বীপের।
ভারত মহাসাগরের নীচে মালদ্বীপের মন্ত্রিসভার বৈঠক
দাঁত মাজলেও দূষণ
এখন সমস্যা অন্য। প্লাস্টিক। সর্বত্র প্লাস্টিক। সকালবেলায় যে মাজনে দাঁত মাজছি, যে সব প্রসাধনী জিনিস ব্যবহার করছি, সে সবের মধ্যেই রয়েছে অতি সূক্ষ্ম প্লাস্টিকের বল, যা আনুবীক্ষণিক। সাবানেও তাই। সেই সব জল বাড়ির নর্দমা হয়ে নদী, সেখান থেকে মহাসাগরে পড়ছে। তাতেই দূষিত হচ্ছে সমুদ্র, মহাসমুদ্র। এ ছাড়া প্লাস্টিকের বোতল আর ব্যাগ তো আছেই।
বিভিন্ন রংও জলে মিশছে, সহজ উদাহরণ হল ঠাকুর বিসর্জন। এখনও পুরোপুরি প্লাস্টিকমুক্ত রং বা শিশাবিহীন রং ব্যবহার করা শুরু হয়নি। নদীর মাধ্যমে এই রংও মিশছে সাগরে, সেখান থেকে মহাসাগরে।
বিশ্বের যে প্রান্তেই দূষণ হোক না কেন, সমুদ্রের স্রোতের টানে তা পৌঁছে যায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। যেমন ধরুন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে প্লাস্টিক-বর্জিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে, সা সত্ত্বেও সেখানে প্লাস্টিক মিলছে। সেই সব বোতলের গায়ে যে সব সংস্থার লেবেল সাঁটা রয়েছে, তা দেখে ধারনা এগুলি ভেসে এসেছে বিশ্বের অন্য কোনও প্রান্ত থেকে।
91% of plastics are not recycled.Plastics use as much as fossil fuel as airlines.99% of plastics cause climate change.We are eating plastic.We are drinking plastic.We are breathing plastic.#WorldEnvironmentDay2018 #BeatPlasticPollution https://t.co/rvgnunlelz
— Plan Int'l Asia (@PlanAsia) June 4, 2018
পেটে খাদ্য নেই, প্লাস্টিক
দিন কয়েক আগে একটি মৃতপ্রায় তিমি ভেসে এসেছিল থাইল্যান্ডের সমুদ্রসৈকতে। তাকে বাঁচানো যায়নি। তার ময়নাতদন্ত করে দেখা যায় যে পাকস্থলির মধ্যে প্লাস্টিক ভর্তি। পাকস্থলি প্লাস্টিকে ভরে যাওয়ায় সে খেতে পারছিল না। অনাহারে তার মৃত্যু হয়েছে। একই কারণে মৃত্যু হয় সামুদ্রিক কচ্ছপেরও, কারণ তারা প্লাস্টিকের ব্যাগ খেয়ে ফেলে জেলিফিশ ভেবে। জেলিফিশ হল অনেক সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রিয় খাদ্য।
পাকস্থলিতে প্লাস্টিক ভর্তি হয়ে যাওয়ায় খেতেই পারছিল না, তাই অনাহারে মৃত্যু হয় এই তিমির
কৃতঘ্ন মৎস্যজীবীরাও
সমুদ্রের এই দূষেণর জন্য কিন্তু সমুদ্রকে দায়ী করা যায় না, মানুষের জন্যই সমুদ্র দূষিত হচ্ছে। যে মৎস্যজীবীরা সাগরে মাছ ধরতে যান, জাল নষ্ট হয়ে গেলে তাঁরা আবার সেই জাল ফেলে দেন সমুদ্রেই। তাতে জড়িয়ে যায় বহু সামুদ্রিক প্রাণী। তারা তো মরেই, তাদের যারা খাদক, খেতে এসে মৃত্যু হয় তাদেরও। অর্থাৎ সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র বা খাদ্যশৃঙ্খলে এর ভীষণ প্রভাব পড়ে। প্লাস্টিকের প্রভাবে নষ্ট হয় প্রবালপ্রাচীর বা কোরাল রিফ। শুধু সৌন্দর্যের জন্যই নয়, সমুদ্রের স্বাভাবিক জীবন বজায় রাখতে গেলে এদেরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে।
যে গাছ ছায়া দেয়, রোদ-জল থেকে বাঁচায় সেই গাছকে যেমন মানুষ কেটে ফেলে তেমন ভাবে যে সমুদ্র থেকে বহু মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়, সেই মানুষই দূষিত করছে সমুদ্রকে।
প্লাস্টিক কমানোর উপায়
এ ব্যাপারে সবার আগে সরকারকে পদক্ষেপ করতে হবে যাতে বায়ো-ডিগ্রেডেবল বা জীবাণু নষ্ট করে ফেলতে পারে এমন, আরও সহজ ভাষায মাটিতে মিশে যায় এমন প্লাস্টিকই শুধুমাত্র বানাতে হবে।
দ্বিতায় আরেকটি উপায় রয়েছে, সেটি খুব একটা খরচসাপেক্ষ নয়। এমন অনেক আইসক্রিম বাজারে রয়েছে যেগুলির ধারকপাত্রটাও আমরা খেয়ে নিই। যেমন কোন (cone) আইসক্রিম। অন্য খাবারের ক্ষেত্রেও যদি এমন ব্যবস্থা আরও বেশি করে চালু করা যায়, তা হলেও আমরা খুব সহজেই প্লাস্টিক অনেকটা এড়িয়ে যেতে পারব।
বছর কুড়ি আগেও লোকে বাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে বাজারে যেতেন। তাই লোকে সচেতন হলেও অনেকটাই এড়ানো যাবে এই সমস্যা। তা ছাড়া যেখানে সম্ভব সেখানে প্লাস্টিকের বোতলে জল না কিনে বাড়ি থেকে জল নিয়েও যেতে পারেন। তাতেও প্লাস্টিকের ব্যবহার কিছুটা কমল।
অন্য ভাবে দূষণ ও প্রতিকার
প্লাস্টিক ছাড়া অন্য ভাবেও দূষণ হয়। যেমন কলকারখানার তেল-কালি, গরম জল, বর্জ্য সবই মিশছে জলে। এই সমস্যা বিশ্বের কোনও এক প্রান্তে হলেই তার প্রভাব পড়ছে বিশ্বজুড়ে। পচাগলা প্রাণী, বাতিল পোশাক এমন আরও অনেককিছুই মিশছে সাগরের জলে। এ সব ক্ষেত্রে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থাকা আবশ্যিক। বায়ু দূষণ রোধে ভারতে যে ভাবে নানা পদক্ষেপ করা হয়ছে, এক্ষেত্রেও সেই ভাবেই পদক্ষেপ করতে হবে।
রং মিশছে জলে, এ ভাবেও দূষিত হয়, সাগর থেকে মহাসাগর
সমুদ্রে পণ্যবাহী, বিশেষ করে তেলবাহী জাহাজ ভেঙে গেলে সমুদ্রে সেই তেল ছড়িয়ে পড়ে। জলে তেল মিশতে পারে নে, ভেসে থাকে। ফলে প্রাথমিক ভাবে অক্সিজেনের অভাব হয়, সমস্যা হয় জলজ প্রাণীদের। তারপরে সেই তেল পাড়ে এলে পাড় দূষিত হয়। তাতে সমুদ্রের পাড়ের উপরে নির্ভরশীল জীবের ক্ষতি হয়। যেমন পাড়ে ডিম পাড়তে আসা কচ্ছপ, কুমীর, কাঁকড়া প্রভৃতি। এ ছাড়া ক্ষতি হয় পাড়ের গাছগাছালি ও কাছাকাছি বাস করা পাখির। তাই সমুদ্রে জাহাজ ভেঙে গেলে সেই ভাসমান তেল অপসারণ করাও অত্যন্ত জরুরি।
পারমাণবিক চুল্লির বর্জ্য ও গরম জলও যাতে সমুদ্রে না মেশে সে দিকেও নজর দেওয়া উচিৎ সরকারের। মনে রাখতে হবে, সমুদ্র কোনও ভাবেই বর্জ্য ফেলার জায়গা নয়।