পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত দুর্গাপুজো কমিটি একই গান বাজালো কেন
১০,০০০ টাকার মতো, পুজো কমিটিগুলোকে গানের অ্যালবামও কি উপহার দিলেন মুখ্যমন্ত্রী
- Total Shares
এ বছর আপনি যদি পুজো প্যান্ডেলে আপনার প্রিয়ং গায়ক গায়িকার গান শোনা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন তাহলে তার দায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর বর্তাবে। আরও, স্পষ্ট করে বললে এর দায় বর্তাবে মুখ্যমন্ত্রীর নতুন গানের অ্যালবাম রৌদ্রছায়ার উপর।
এই গানের অ্যালবামটি পুজো কমিটিগুলো অবিরত বাজিয়ে চলেছে। এর পিছনে অবশ্য একটি কারণও রয়েছে। স্থানীয় তৃণমূল নেতা ও তাঁর অনুগামীদের নেকনজরে থাকতে পারা। এ ছাড়াও এই অ্যালবাম বাজানোর জন্য একটি অলিখিত, অদৃশ্য ফতোয়াও কাজ করছিল। হাজার হোক স্থানীয় থানার মাধ্যমে এই অ্যালবামগুলো বিলি করা হয়েছে।
I am sharing with all of you the new pujo song, penned and composed by me, and sung by Indranil and Lopamudra. Enjoy listening and Happy Puja >> https://t.co/hr5Ik6slqi
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) October 12, 2018
দক্ষিণ কলকাতার এক পুজো কমিটির সদস্য এই অ্যালবাম পাওয়ার মুহূর্তটির গল্প বলছিলেন।
রাতে এগোরটার পর ওই ভদ্রলোক (যিনি আবার ওই পুজো কমিটির সচিব) যখন ঘুমোতে যাচ্ছিলেন তখন থানা থেকে তাঁকে ফোন করা হয়। থানার ওসি তাঁকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য শীঘ্রই থানায় আসতে বলেন।
মাথায় একগাদা দুশ্চিন্তা নিয়ে এবার সচিব মহাশয় থানার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু গভীর রাতের ওই বৈঠকে যা বলা হল তা তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি।
সচিবের হাতে অ্যালবামের কয়েকটি কপি তুলে দিয়ে ওসির অনুরোধ অ্যালবামটি যেন পুজোর সময় বাজানো হয়। সচিবের প্রশ্ন ছিল এই অ্যালবাম বাজানো বাধ্যতামূলক কি না। উত্তরে ক্লাবের কোর্টে বল ঠেলে দিলেন ওসি: "ইচ্ছে হয় বাজান। না ইচ্ছে হলে ছুড়ে ফেলে দিন। আমাদের বিলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর, আমরা তাই করে চলেছি।"
এই অ্যালবাম বাজানো কি বাধ্যতামূলক। এই প্রশ্ন তোলার সাহস কেউ দেখাতে পারেনি [সৌজন্যে: ইউটিউব]
অ্যালবামে সাতটি গান রয়েছে। কয়েকটি পুজো সম্পর্কিত, কয়েকটি নয়। প্রত্যকেটি গান লিখেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। সুরও দিয়েছেন তিনি। কেউই জানে না গানগুলো বাজানো বাধ্যতামূলক কি না। কিন্তু প্রশ্ন করবে, এমন বুকের পাটা ক'জনের রয়েছে?
এর আগে রাজ্যের ২৮,০০০ পুজো কমিটির হাতে ১০,০০০ টাকা করে তুলে দিয়েছে রাজ্য সরকার। এর পর, আর প্রশ্ন করার ঝুঁকি নেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কেন এই অ্যালবামের প্রচার করতে উঠে পড়ে লেগেছে?
বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মতো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মত, "খুব সম্ভবত, ১০,০০০ টাকার সঙ্গে এই অ্যালবামটিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুজোর উপহার।"
তবে একটা বিষয় নিয়ে সন্দেহ নেই। মাইকে এই গান বাজানো মানে এটাই প্রমাণিত হবে যে ওই অঞ্চলে মুখ্যমন্ত্রীর ও মুখ্যমন্ত্রীর দলের আধিপত্য একেবারে একচেটিয়া।
ভিডিও অ্যালবামটির স্ক্রিনশট
নাম জানাতে অনিচ্ছুক দলের এক বিধায়ক তো বলেই ফেললেন, "অঞ্চলের লোকেরা দলের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ তারও প্রমাণ মিলবে।"
কিন্তু একটা কথা দলীয় নেতারা বুঝতে পারছেন না। জোর করে অ্যালবাম বাজানো মানে এই নয় যে সব ভোটই তাদের ঝুলিতে ঢুকবে। বিশেষ করে যদি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়।
২০০৯ সালে যখন রাজ্য জুড়ে পরিবর্তনের হাওয়া বইছিল তখন বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই স্লোগান তুলেছিলেন - চুপ চাপ ফুলে ছাপ।
সেই সময় বামপন্থীদের চাপ বা গা জোয়ারি কোনও কিছুই কাজে আসেনি। জনগণ নিজেদের ইচ্ছেতেই ভোট দিয়েছেন এবং ২০১১ সালে রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে বাংলায়।
তাই তো মমতার কাট আউট থেকে সরকারি প্রকল্পের বিজ্ঞাপন আলোকিত করেছিল পুজো মণ্ডপগুলো। সর্বোপরি মমতার রৌদ্রছায়ার গান বাজছিল প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। এর কিছুটা অর্ধ সত্য, কিছুটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে আবার অনেকটাই অদেখা রয়ে যাচ্ছে।
কীই বা আর করা যাবে। সরকার এবার বিশ্ব বাংলা শারদ সম্মান পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছে। তাই প্রতিযোগিতার বিচারকদের নজর টানতে মমতার গান তো বাজাতেই হবে। হাজার হোক, তৃণমূল ঘনিষ্ঠ এই বিচারকদের তো সরকারই বাছাই করেছেন।
এই দুর্গাপুজোতে রাজনৈতিক ভেদাভেদ প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে [সৌজন্যে: টুইটার/টিএমসি]
কারণ যাই থাকুক না কেন এই প্রথমবার মমতার লেখা ও সুর দেওয়া গান প্রায় প্রতিটি পুজো প্যান্ডেলে শোনা গেল। কিন্তু কোন কোন গানের বদলে - লতার হিট গানগুলো, কিশোরের সেই অমর প্রেমের গানগুলো, বিসমিল্লা খানের সানাই কিংবা বিশ্বজোড়া খ্যাতি পাওয়া রক গানগুলোর পরিবর্তে।
এ বছর একটা ব্যাপারে সকলেই একই মঞ্চে।
মণ্ডপের থিম ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু প্যান্ডেলগুলোর থিম সং কিন্তু এবার এক ছিল: মমতার রচিত অ্যালবাম। তবে মমতা ছাড়াও অন্যান্য রাজনৌতিক দলগুলোও প্রচারের মধ্যে ছিল। বিভিন্ন প্যান্ডেলে স্টল বসিয়ে।
২০১৯ লোকসভার কথা মাথায় রেখে এবছর কিন্তু রাজনৈতিক ভেদাভেদও চোখে পড়েছে।
তৃণমূল যখন উপহার ও পুরস্কার দিতে বাধ্য, বিজেপি তখন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে স্টল দিয়ে, দর্শক নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বচ্ছাসেবীর ব্যবস্থা করে আর স্বাস্থ্য শিবির আয়োজন করে নিজেদের প্রচার করে গেছে।
বিরোধীদের এক ইঞ্চিও জমি ছাড়তে নারাজ তৃণমূল অবশ্য পুজোতে বিজেপির প্রচারের কথা মানতে নারাজ।
(সৌজন্যে মেল টুডে)
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে