জোশ নিয়ে তো প্রচুর কথা হল, নেতা ও আমলারা এবার প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোকে পুন:সংস্কার করুক
ভারতের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর মতো অভাবের সংসার বিশ্বের আর কোনও দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর নেই
- Total Shares
"হাউস দ্য জোশ?" - অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারতীয় দলের দুরন্ত জয়ের ক্ষেত্রে কিংবা নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সেনাবাহিনীর অদম্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রে, এই ট্যাগলাইনটির অনুরণন ক্ষমতা কিন্তু প্রখর।
কিন্তু যখন শাসক দলের মুখপাত্র প্রতিরক্ষা বাজেটের ক্ষেত্রেও এই একই ট্যাগলাইন ব্যবহার করেন তখন এই ট্যাগলাইনটিকে কেমন জানি বেমানান দেখায়।
এর কারণ ভারতের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর মধ্যে 'জোশের' কোনও অন্ত নেই, কিন্তু আধুনিক যুদ্ধে শুধুমাত্র 'জোশ' দিয়েই জয়লাভ করা সম্ভব নয়। যদিও জোশ বা মনোবল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও একান্ত প্রয়োজনীয়, কিন্তু শুধুই তার উপর নির্ভর করে যুদ্ধ করা বা যুদ্ধ জয় সম্ভবপর নয়।
ইতিহাস থেকে আমরা একটা শিক্ষা পেয়ে থাকি - শুধুমাত্র সাহসী কিংবা বীর যোদ্ধারাই যুদ্ধ জয় করেন না, সঠিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত, সুসজ্জিত ও শৃঙ্খলা পরায়ণ যোদ্ধারাই যুদ্ধে জয়লাভ করেন। 'জোশের' মতই রণনীতি ও অস্ত্রভাণ্ডার শত্রুনাশের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।
জোশ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু শুধুমাত্র জোশ দিয়ে যুদ্ধজয় সম্ভব নয় [ছবি: রয়টার্স]
২০১৯ সালের অন্তর্বতী বাজেটে আবার সেই দৃশ্য ধরা পড়ল যা দেখলে অনুসূচনা হতে বাধ্য। প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোকে অর্থের জন্য অনাহারী করে রেখে দেওয়া হল যাতে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে পারে - শুধুমাত্র আগামীদিনের যুদ্ধগুলোর জন্য নয়, বর্তমানের লড়াইগুলোর জন্যেও। প্রতিটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী দাবি করে থাকেন যে তাঁরা প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর জন্য অনেক কিছুই করেছেন। কিন্তু তাঁদের বাজেট বক্তৃতায় তাঁরা শুধু একটি কথাই বলে দায়ে সারেন - 'প্রয়োজন পড়লে আরও বরাদ্দ করা হবে'। এই লাইনটির থেকে একটি বিষয়ে পরিষ্কার হয়ে যায় - প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানেন যে সশস্ত্র বাহিনীগুলোর যতটা অর্থের প্রয়োজন ছিল তা তিনি সত্যিই বরাদ্দ করেননি।
এর চাইতেও দুর্ভাগ্যজনক, স্বয়ং রাজনৈতিক নেতারা কিংবা আমলারাদেরই প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রস্তুতি নিয়ে স্বচ্ছ কোনও ধারণা নেই। তাঁরা মনে করেন "প্রয়োজন পড়লে" মানে কোনও আপৎকালীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ফাইটার বিমান, সাবমেরিন কিংবা বন্দুক ও অন্যান্য সামরিক সম্ভার ক্রয় করা যাবে। ঠিক যেমন, কম পড়লে পাড়ার মুদির দোকান থেকে দুধ বা পাউরুটি কিনে আনা হয়। ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের সময়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান ভি পি মল্লিক যেমন বলেছিলেন, "যা আছে তাই দিয়েই যুদ্ধে নামবে সেনাবাহিনী"।
'জোশের' উপর নির্ভর করেই সেই যুদ্ধজয় সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সেই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তির আশা করে থাকা মানে নিজের ভাগ্য নিয়ে খেলা করা।
এ বছরের প্রতিরক্ষা বাজেট নাকি সর্ববৃহৎ এবং এই প্রথমবার প্রতিরক্ষা বাজেটে তিন লক্ষ কোটির বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে - এমন একটা আলোচনা বাজারে বেশ চাউর হয়েছে। কিন্তু এই আলোচনার সিংভাগই ভিত্তিহীন।
প্রতি বছরের প্রতিরক্ষা বাজেটই 'সর্ববৃহৎ' হয়ে থাকে। কারণ, প্রতি বছরই আগের বছরের বাজেটের থেকে সে বছরের বাজেটে কিছুটা বেশি অর্থ বরাদ্দ করে হয়ে থাকে। তিন লক্ষ কোটি টাকা ছাপিয়ে যাওয়ার বলা হচ্ছে। তা তো স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটেছে, কোনও পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে নয়। এই ভাবে অঙ্ক কষে প্রতিরক্ষা বাজেটের মূল্যায়ন না করে আমাদের আপেক্ষিকতা দিয়ে এই বাজেটের মূল্যায়ন করা উচিত। অর্থাৎ, জিডিপির কত শতাংশ বা ব্যয়ের কত শতাংশ কিংবা রাজস্বের কত শতাংশ। এর থেকে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে দেশের সুরক্ষা ব্যবস্থা সুসংহত করার জন্য সরকার ঠিক কতটা সম্পদ ব্যবহার করছে এবং সুসজ্জিত বাহিনী তৈরি করতে সরকার কতটা আগ্রহী।
কার্গিল যুদ্ধের সময়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান বলেছিলেন 'যা আছে তাই দিয়েই লড়ব' [সৌজন্যে: ইন্ডিয়া টুডে]
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে জিডিপির তিন শতাংশ প্রতিরক্ষার পিছনে খরচ করাটাই বাঞ্চনীয়। কিন্তু এই হিসেব যথাযথ নয়। কারণ, বাস্তবে, একটি দেশ কী ধরণের হুমকি ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে এবং তা মোকাবিলা করতে দেশের সেনাবাহিনীকে কতটা সজ্জিত হতে হবে তার উপর সেই দেশের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ব্যয় নির্ভর করবে। ভারত সেখানে জিডিপির ১.৫ থেকে ১.৬ শতাংশ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে বরাদ্দ করেছে - যা ১৯৬২ সালের বিপর্যয়ের পরে সর্বনিম্ন।
এর চাইতেও চিন্তার বিষয় - প্রতি বছরই এই সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সরকারের সমর্থকরা অবশ্য দাবি করে থাকে যে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে যা ব্যয় করা হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না বা বুঝতে চায় না যে বরাদ্দ অর্থের সিংহভাগটাই কর্মচারীদের বেতনের জন্য খরচ করা হয়ে থাকে। অথচ, আধুনিকীকরণ বা অস্ত্র ভাণ্ডারের উন্নতির জন্য যৎসামান্য টাকাই খরচ করা হয়।
আরও ভয়াবহ বিষয় হল, কেউই হুমকির ধরণটা বুঝতে চায়না যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। হুমকির ধরণগুলো কিন্তু নিরন্তর পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। ভারত পাকিস্তনের সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ এবং যে কোনও সময়তেই পাকিস্তান কাশ্মীর বা পাঞ্জাবে মাথা চারা দিতে পারে। চিন যেভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সখ্যতা রেখে চলেছে তাতে চিনের প্রতি সাবধানতা অবলম্বনের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ভারত মহাসাগরেও প্রবেশ করে ফেলেছে চিন। যদি অনতিবিলম্বে এই পরিস্থিতির প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে ভারতের কপালে দুঃখ রয়েছে।
আফগানিস্তানের অবস্থা একেবারে স্থিতিশীল নয় এবং আবার ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের উপকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। যার রেশ কিন্তু পাকিস্তানের মাধম্যে ভারতকে সামলাতে হবে। আর, এই সব কিছুর মধ্যেই, ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কি এই চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত?
উত্তরটা একেবারেই নেতিবাচক। বিশেষ করে ভারত যখন নিজেকে এই অঞ্চলের নিরাপত্তারক্ষক হিসেবে মনে করে।
যেটা আরও ভয়াবহ, বছরের পর বছর ধরে সশস্ত্র বাহিনীগুলোকে অবহেলা করে আজ আমরা যে জায়গায় পৌছিয়েছি তাতে এই ধরণের চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবলি করার মতো ক্ষমতা আমাদের নেই। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন সরঞ্জাম ইতিমধ্যেই অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে। যথোপযুক্ত সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। মোদী সরকার নতুন সরঞ্জাম ক্রয় করে অভাব কিছুটা পূরণ করেছে, কিন্তু এখনও অনেক কিছু করার বাকি রয়েছে। খুব সম্ভবত, ভারত যদি একটি বিশাল প্রতিরক্ষা শিল্প তৈরি করতে পারে তাহলে এই সমস্যাগুলোর অনেকটাই সুরাহা হবে।
পাকিস্তান আবার সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে [সৌজন্যে: টুইটার]
বর্তমানে বহু প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত রাষ্ট্রায়াত্ব সংস্থা ও অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে রয়েছে। যেহেতু দেশীয় অস্ত্র আমরা সরবারহ করতে পারিনা আমাদের বাহিনীগুলো বিদেশী অস্ত্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। কিন্তু আমদানি করতে গেলে শুধুমাত্র যে খরচ বেশি হয় তা নয়, অস্ত্রের গুনগত মানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে দিয়েছে - সত্তর বা আশির দশকের মতো রুশদের আজ আর বিশ্বাস করা চলে না। মার্কিনদের উপর কোনও আস্থা নেই, ব্রিটিশরা অপ্রয়োজনীয় আর ফরাসিদের নিয়ে আমাদের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। একমাত্র ইজরাইলিদের উপর ভরসা করা যায় কিন্তু আমাদের সমস্ত প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
এর পর আবার 'প্রযুক্তি বদলের' মতো বিষয় রয়েছে। প্রযুক্তি এক হয় চুরি করা হয় না হয় উন্নয়ন করা হয়। কিন্তু আমরা দু'টোর একটাও করিনা। আমরা চাই প্রযুক্তি আমাদের পাতে সাজিয়ে দেওয়া হোক। তা এক হয় সম্ভব নয়। আর, যদি হয়েও থাকে তাহলে সেই প্রযুক্তি দিয়ে লাভের লাভ কিছুই হবে না।
আমদের উচিত, গবেষণা ক্ষমতা বৃদ্ধি করার যাতে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগ বন্ধ করা যায়। এর ফলেই আমরা দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য প্রশিক্ষিত লোকবল জোগাড় করতে পারব।
সমস্যা হল, আমরা এখন ষাটের দশকের মিগ ২১-এর উপর ভরসা করি। এফ ১৬-এর মতো যুদ্ধবিমান, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধান যুদ্ধবিমান হয়ে উঠেছে, ক্রয় করতে রাজি নয় এবং পরবর্তী দু'দশক ধরে অরাজি থাকব। চিন যেভাবে প্রযুক্তিতে উন্নতি করেছে তা দেখে আমরা মুহ্যমান হয়ে পড়ি কিন্তু আমরা সেই পথের পথিক হতে ভুলে যাই। চিন নিজেদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাতিল হওয়া বিমানও উড়িয়েছে, নিজেদের আরএন্ডডি ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন করেছে এবং সময় বিশেষে অন্যের থেকে প্রযুক্তি চুরিও করেছে।
মিগ ২১ বিমান ভেঙে পড়েছে যারও বিশ্বাস রাখে সেনাবাহিনী [ছবি: পিটিআই]
বর্তমানে যখন প্রতিনিয়ত যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটে চলেছে ভারত তখন ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়কার প্রযুক্তি আঁকড়ে পড়ে রয়েছে। অন্যদিকে চিন প্রযুক্তি-নির্ভর-যুদ্ধের উপর জোর দিচ্ছে তা মাঠে নেমে লড়াইয়ের চাইতে অনেক বেশি ভয়াবহ ও কার্যকরী।
আসলে, প্রযুক্তি কিন্তু জওয়ানদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে যা তাদের আরও বেশি কার্যকর করে তোলে। কিন্তু প্রতিরক্ষার জন্যে আমরা যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকি তার সিংহভাগই তো বেতন দিতে খরচ হয়ে যায়।
কিছু আলোচনা হলেও এখন সেরকম কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে ওঠেনি যাতে আমরা লোকবলের থেকে বেশি অর্থ অস্ত্র জোগাড় করতে খরচ করি। সশস্ত্র বাহিনীগুলো কোনও চাকুরী পাইয়ে দেওয়ার সংস্থা নয় এবং কর্মসংস্থান সশস্ত্র বাহিনীগুলোর প্রধান কর্তব্য নয়। এর কোনওটাই কিন্তু রকেট বিজ্ঞান নয়। দেশের সামরিক অবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে গেলে বড় বিশ্লেষক হওয়ার প্ৰয়োজন পড়ে না। চোখের সামনেই বাস্তবটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতা ও আমলারা পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু তাঁরা খুব একটা পাত্তা দেননা এবং যদি দেনও তাহলেও তাঁদের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো একেবারেই ভিন্ন।
এটা সত্যি, গোটা বিশ্ব জুড়েই সেনাবাহিনী যা চায় তা পায় না। পাশাপাশি এটাও সত্যি যে বিশ্বের আর কোনও দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সংসারে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর মতো অভাব নেই।
সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ও সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের উপর তৈরি হওয়া সিনেমাগুলো নিয়ে আমরা উল্লাস করতে পারি। কিন্তু, বাস্তবে, ভারত অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকবে যদি প্রতিরক্ষা বিষয়ক ব্যাপারগুলো নিয়ে আমরা অনতিবিলম্বে মনোনিবেশ করা যায়।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে