বিহারের এই প্রত্যন্ত গ্রামের পড়ুয়ারা কী ভাবে বছরের পর বছর আইআইটি-জয়েন্টে উত্তীর্ণ হন
পাটোয়া টোলির প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একজন করে ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন
- Total Shares
গত রবিবার, অর্থাৎ ১০ জুন, আইআইটি কানপুরের জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফল ঘোষিত হয়েছে। আমি বা আমার পরিবারের কেউ এ বছর এই পরীক্ষায় না বসলেও, এই পরীক্ষাটিকে কেন্দ্র করে আমার মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার কোনও অন্ত ছিল না। এর কারণ, বিহারের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। পূর্ব ভারতের পড়ুয়ারা খুব একটা আইআইটি নিয়ে চর্চা করে না। কিন্তু বিহারের এই প্রত্যন্ত গ্রামটি থেকে প্রতি বছরই নিয়মিত ভাবে পড়ুয়ারা আইআইটিতে সুযোগ পেয়ে থাকেন। বিহারের পড়ুয়াদের প্রথম প্রেম যখন সিভিল সার্ভিস, তখন এই গ্রামের পড়ুয়ারা আইআইটিতে যোগ দিতে বেশি পছন্দ করেন।
একেবারে মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলে অবস্থিত এই গ্রামটির নাম পাটুয়া টোলি। নিজেদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও জীবনধারণের মান উন্নত করতে এই গ্রামের প্রতিটি পড়ুয়াই আইআইটিতে সুযোগ পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। সব ধরণের প্রলোভন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখে ও তাঁতে কাপড় বোনার তীব্র খটাখট শব্দের মধ্যেও পাটুয়া (তাঁতি) সম্প্রদায়ের যুবকরা জয়েন্ট এন্ট্রাসের গণ্ডী পার করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে। বিহারের গয়া জেলার এই তাঁতিরা দুটি কর্মে সিদ্ধহস্ত: রং-বেরঙের তাঁত বুনতে আর ভালো মানের ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করতে। প্রথমটি তাঁদের পারিবারিক পেশা আর দ্বিতীয়টি মন্দার বাজারে তাঁদের স্বপ্ন সফল করার চাবিকাঠি।
নব্বইয়ের দশকে তাঁত শিল্পে মন্দা শুরু হয়। এর ফলে পাটোয়া টোলির তাঁতিরা তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে রুজি রোজগারের ধান্দায় রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা বা দিনমজুর হয়ে গেছেন। এদের সৌভাগ্য যে এদের সন্তানরা দারিদ্র্য ও এত সমস্যার পরেও আইআইটি-জয়েন্ট এন্ট্রান্সের মতো সর্বভারতীয় পরীক্ষায় দক্ষতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এই ধারার সূত্রপাত ১৯৯১ সালে যখন জনৈক গ্রামবাসী কেসি ঠাকুরের পুত্র জিতেন্দ্র প্রসাদ এই গ্রাম থেকে প্রথম পড়ুয়া হিসেবে আইআইটিতে সুযোগ পান। জিতেন্দ্রর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয় প্রতিবেশীদের সন্তানরাও আইআইটি -জয়েন্ট এন্ট্রান্সের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দেয়। জিতেন্দ্রকে আদর্শ করে গ্রামের দেড় হাজারের মতো পরিবার তাঁদের সন্তানকে আইআইটিতে পাঠানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দেন।
এঁরা বাড়িতে হিন্দি ভাষায় কথা বলেন আর প্রস্তুতির পাঠ্যবইগুলো ইংরেজিতে লেখা, তাই তারা সর্বদাই অভিধান সঙ্গে করে ঘুরে বেড়ান
পাটোয়া টোলির অধিকাংশ পরিবারই দরিদ্র। সেই গ্রামের নতুন প্রজন্ম অবশ্য কর্মসংস্থান ও কর্মসুরক্ষা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত। তারা নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থানকে উন্নত করবার স্বপ্ন দেখে। এদের অনেকেই প্রস্তুতির অঙ্গ হিসেবে গয়া শহরের কোচিং সেন্টারগুলোতে ভর্তি হয়। প্রস্তুতি পর্বে এদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার অভাব। এরা বাড়িতে হিন্দি ভাষায় কথা বলে থাকে। অথচ প্রস্তুতির পাঠ্যবইগুলো ইংরেজিতে লেখা। তাই তারা সর্বদাই অভিধান সঙ্গে করে ঘুরে বেড়ায়।
তবে গ্রামবাসীরা যে ভাবে এক জোট হয়ে তাঁদের সন্তানদের প্রস্তুতি পর্বে অংশগ্রহণ করেন তাতে এই সমস্যা নগণ্য? বলেই মনে হতে পারে। বেশ কয়েকটি 'ঘরোয়া' আবাসিক শিবির গড়ে তোলা হয়েছে যাতে পরিক্ষার্থীরা এক সঙ্গে সময় কাটাতে পারে ও পড়শোনা করতে পারে। এই গ্রাম থেকে যারা ইতিমধ্যেই আইআইটিতে সুযোগ পেয়ে গেছেন তাঁদেরকেও বাহবা দিতে হবে। নিজেদের ছুটিগুলো তাঁরা গ্রামের বাড়িতেই কাটান আর সেই ফাঁকে পরবর্তী প্রজন্মকেও প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সাহায্য করে থাকেন। ওই গ্রামের ইঞ্জিনিয়ার তথা আইআইটির প্রাক্তন ছাত্রদের 'নব প্রয়াস' নামক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে যেখানে গ্রামের পরবর্তী প্রজন্মের আইআইটি প্রার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে দক্ষ পড়ুয়াদের বেছে নিয়ে তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর ফল প্রথম ৯৮ সালে পাওয়া যায়। সে বছরে গ্রামের তিন পড়ুয়া একসঙ্গে আইআইটিতে সুযোগ পায়। পরের বছর এই গ্রাম থেকে আইআইটিতে সাত জন সুযোগ পায়। এর পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
গ্রামের বাসিন্দাদের হিসেবে অনুযায়ী গত দেড় দশকে নয় নয় করে প্রায় ২০০জন পড়ুয়া আইআইটিতে সুযোগ পেয়েছে। এছাড়া আরও অনেকেই এনআইটি ও অন্যান্য নামকরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে। ২০১৭ সালে এই অঞ্চলের ২০ জন পড়ুয়া আইআইটিতে সুযোগ পেয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট গ্রাম বা অঞ্চল থেকে এক সঙ্গে এতগুলো ছাত্র ছাত্ৰীর আইআইটিতে সুযোগ পাওয়ার উদাহরণ কিন্তু খুব বেশি নেই।
পাটোয়া টোলি থেকে ২০১৬ সালে ১১ জন ও ২০১৫ সালে ১২ জন পড়ুয়া আইআইটিতে সুযোগ পেয়েছিল। এ বছর অবশ্য মাত্র পাঁচ জন পড়ুয়া আইআইটিতে সুযোগ পেয়েছে। বর্তমানে, পাটোয়া টোলির প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একটি করে ইঞ্জিনিয়ার আছে। একটা সময় পাটোয়া টোলিকে 'বিহারের ম্যাঞ্চেস্টার' বলে ডাকা হত। এখন এই ইঞ্জিনিয়ারদের দাপটে সেই তকমা হারাতে বসেছে পাটোয়া টোলি।
তাঁদের পূর্বপুরুষরা সারাজীবন তাঁত বুনে এসেছেন। কিন্তু নতুন প্রজন্ম নতুন করে স্বপ্ন বুনতে চাইছে। জিতেন্দ্র এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকে আর এই গ্রামের অন্যান্য ইঞ্জিনিয়াররা দেশের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আবার এই গ্রামের বেশ কয়েকজন আইআইটির প্রাক্তন ছাত্র রয়েছেন যাঁরা শুধুমাত্র পরবর্তী প্রজন্মকে তালিম দেওয়ার জন্য মনোনিবেশ করেছেন। পড়ুয়াদের সঙ্গে তাঁদের অভিভাবকদের কথাও বলতে হবে। স্বপ্ন পূরণের জন্য তাঁরা তাঁদের সন্তানদের সর্বদাই উৎসাহিত করেন।
এখানকার গ্রামবাসীরা নিত্যদিন ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করে দিনমজুর বা অন্যের তাঁতযন্ত্রে তাঁত বুনে সন্তানদের শিক্ষিত করতে নিবেদিতপ্রাণ। জাতীয় স্তরে এই পড়ুয়াদের আরও বেশি করে স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ, যাতে এরা দেশের অন্যান্য প্রান্তিক সম্প্রয়দায়ের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে