প্রধান বিচারপতির ইমপিচমেন্ট হোক বা না হোক, বিচার ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই আস্থা হারিয়েছে

গণতন্ত্র ও সংবিধান প্ৰতিষ্ঠা করে, আদালত ব্যর্থ হওয়া মানেই জরুরি অবস্থা কায়েম হয়ে যাওয়া

 |  3-minute read |   23-04-2018
  • Total Shares

যে কোনও প্রতিষ্ঠানই নির্দিষ্ট কার্যপ্রণালী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও মানুষের বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। কোটি কোটি ভারতবাসী ন্যায়বিচারের জন্য সুপ্রিম কোর্টের উপর ভরসা করে। দেশের শীর্ষ আদালত দেশের সংবিধানের মূল্যবোধের অভিভাবক। একেবারে নিরপেক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে এই আদালতের রায় আইনেরই সমতুল।

আমরা যতই বিরোধী দলের আনা ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব নিয়ে হিসেবে নিকেশ করি না কেন, জনগণের আদালত কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রধানবিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের বিচার করে ফেলেছে।

আইনের ময়দানে জনগণের বিচারকে কিন্তু কোনও দিনও হালকা ভাবে দেখা হয় না। আইন মানুষের উপর গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক মূল্যবোধ জাগায়। বিচারপতিদের উচিৎ নিজেদের আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার সম্ভ্রম রক্ষা করা, যা করতে ব্যর্থ হয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। মানুষের বিশ্বাসভঙ্গ হয়েছে এবং তাই, ইতিমধ্যেই জনতার আদালতে মুখ্যবিচারপতি দোষী সাব্যস্ত হয়ে গেছেন।

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুধরোতে পারেনি বলে দেশের শীর্ষ আদালতের বর্তমানে এই ধরণের শোচনীয় পরিস্থিতি। সুপ্রিম কোর্ট যে ভাবে ঘর গুছিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলোকে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করে চলেছে, তাই তো যে কোনও প্ৰতিষ্ঠানের উচিৎ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা এবং এমন একটি কার্যপ্রণালী প্রয়োগ করা যার মাধ্যমে নিজেদের দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করা যায়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সব চেয়ে বেশি স্বচ্ছতা অবলম্বন করা উচিৎ। কিন্তু এখানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ ব্যবস্থায় সব চেয়ে বেশি অস্বচ্ছতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

body_042318121234.jpgইতিমধ্যেই জনতার আদালতে প্রধান  বিচারপতি দোষী সাব্যস্ত হয়ে গেছেন

দেশের আইন ব্যবস্থার কঠিন সত্য ও শীর্ষ বিচারপতিদের অন্তর্কলহ এখন জনসমক্ষে চলে এসেছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক কাজকর্ম বা গুরুত্বপূর্ণ মামলা কোন এজলাসে যাবে তা ঠিক করবার অধিকার এখন একমাত্র প্রধান  বিচারপতির, তবে এর কোনও লিখিত নিয়মাবলি নেই।

গত নভেম্বরের ১০ তারিখে আরও পাঁচজন বিচারপতির সামনে মুখ্য বিচারপতি দীপক মিশ্রের সঙ্গে তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন আর এক বর্ষীয়ান বিচারপতি প্রশান্ত ভূষণ। দেশের সর্বোচ আদালতের অবস্থা এখন কতটা শোচনীয় তা সে দিনই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।

কিছুদিন আগে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির কেলেঙ্কারি নিয়ে একটি মামলায় রায় দান করেছিলেন বিচারপতি জে চেলমেশ্বর। পরে সেই রায় খারিজ করে দেন স্বয়ং মুখ্য বিচারপতি দীপক মিশ্র। সে দিন আদালতের দর্শক গ্যালারিতে বসেছিলাম আমি। আমার পাশে বসা একজন চুপি চুপি বললেন, "দেখে শুনে মনে হচ্ছে আদালত নয় আমরা সংসদ ভবনে বসে রয়েছি। আশা করি এখানে চেয়ার-টেবিল ছোড়াছুড়ি হবে না।"

সেই দিন সুপ্রিম কোর্টের গৌরব অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছিল। এর দু'দিন বাদেই আরও এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেল। সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে যা অভূতপূর্ব। চার জন বর্ষীয়ান বিচারপতি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে জনসমক্ষে সরব হলেন।

সুপ্রিম কোর্ট অনেক সময়তেই অপ্রিয় রায় দান করেছে। আদালতের উচিৎ রায়দানের পর সেই রায় যাতে কার্যকর হয় তার উপর জোর দেওয়া। শীর্ষ আদালত যখন রায় কার্যকর করার উপর জোর দেয় তখন তা নিয়ে নৈতিক বিতর্ক শুরু হয়ে যায় - এই রায়ে শুধুই কোনও রাজনৈতিক দলের সমস্যা বাড়ল নাকি আদতে তা জনগণের পক্ষে গেল। আদালতের ক্ষমতা অসীম। কিন্তু আদালত যদি ঘরোয়া কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে নিজেই আক্রমণের শিকার হয় তখন কিন্তু সেই আদালতের ভাবমূর্তি কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ে।

যখনই সুপ্রিম কোর্ট সুবিচারের জন্য মাথা তুলে লড়াই করেছে, ইতিহাস সুপ্রিম কোর্টকে যোগ্য সম্মান দিয়েছে। আবার জরুরি অবস্থার মতো বিভিন্ন সময় যখন শীর্ষ আদালত সুবিচার দিতে পারেনি, ইতিহাস কিন্তু সুপ্রিম কোর্টকে ক্ষমা করেনি।

যে চারজন বিচারপতি সাংবাদিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা সুপ্রিম কোর্টের কার্যপ্রণালি সংস্কার করতে চেয়েছিলেন এবং জানিয়েছিলেন যে তাঁরা অপারগ হয়েই এই সাংবাদিক বৈঠক ডেকেছেন। তাঁদের লক্ষ একটাই ছিল - সুপ্রিম কোর্টের স্বার্থ রক্ষা। কিন্তু এর পর থেকেই এই ঝামেলায় শুধুমাত্র রাজনৈতিক মহলই লাভবান হয়েছে।

শাসক দল সুপ্রিম কোর্টকে দু'ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে। এই অবস্থায় সুপ্রিম কোর্ট ক্ষমতালোভী শাসক দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে কার্যপ্রণালী নির্ণয় করতে পারছে না। আদালতের ক্ষমতা থাকলেই সুবিচারের আশা করা যেতে পারে। কিন্তু একটি দুর্বল ও বিভক্ত আদালত কিন্তু সরকারকে শক্তিশালী করে তোলে। উল্টোদিকে, এই পরিস্থিতির মজা লুটছে বিরোধী দলগুলো কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করছে না। কংগ্রেসকে দেখুন। ইমপিচমেন্ট আনা উচিৎ নাকি অনুচিৎ সে বিষয় কংগ্রেস নেতৃত্ব এখনও এক মত হতে পারেনি।

পরিশেষে এক কথা বলতে চাই। আপনারা যদি দেশের সাংবিধানিক পরিকাঠামো একটু তলিয়ে দেখেন তা হলে বুঝবেন তা শুধু বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সেই বিশ্বাস বা আস্থা হারিয়ে যেতে বসেছে। সুপ্রিম কোর্টে লড়াই হয়ত এখনও চলছে, কিন্তু বিচার ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই প্রধান যুদ্ধে হেরে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতির প্রভাব দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রের উপরও পড়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের হাত থেকে তা রক্ষা করবার প্রয়োজন আছে বৈকি। স্বাধীনতা থেকেই আদালতগুলো সেই চেষ্টাই করে আসছে। আদালত ব্যর্থ হওয়া মানেই তো দেশে জরুরি ব্যবস্থা কায়েম হয়ে যাওয়া।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

ANUSHA SONI ANUSHA SONI @anushasoni23

The writer is special correspondent at India Today TV.

Comment