নিউজিল্যান্ডের মহিলারা ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে সেরা অভিব্যক্তিটা দেখিয়েছেন
হিজাব পড়ে মুসলমানদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর জন্য নিউজিল্যান্ড মহিলাদের ধন্যবাদ
- Total Shares
১৯৮৪ সালের নভেম্বর মাসে আমরা যখন শেষ পর্যন্ত স্কুলে প্রবেশ করতে পারলাম তখন আমরা একে অপরের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পাচ্ছিলাম না। চোখের সামনে মৃত্যু মিছিল দেখার পর আমরা প্রত্যেকই যেন কোনও এক অজানা অপমানে বিধস্ত হয়ে পড়েছিলাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমরা একে অপরকে জোক বলতে শুরু করলাম। জোকগুলো কিন্তু বেশ খুব শস্তা ও গতানুগতিক। এর ঠিক তিন দিনের মাথায় আমরা খবর পেলাম, আমাদের এক সহপাঠী সেই মৃত্যু মিছিলে বলি হয়েছে।
খবরটি পাওয়ার পর আমাদের এক সহপাঠীর মাথায় একটি অসাধারণ পরিকল্পনা এসেছিল। ছেলেটির ছোট বোন আমাদের স্কুলেই পড়ত। আমরা চেয়েছিলাম মেয়েটি স্কুলে যোগ দেওয়ার পর তার যাতে কোনও অসুবিধা না হয় তার জন্য আমরা তার নোটসগুলো তৈরি করে দেব ও ক্লাস ওয়ার্কগুলো লিখে দেব। আমরা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে তার বইগুলোও নিশ্চয়ই আগুনে পুড়ে গিয়েছে। হঠাৎই আমাদের মধ্যে একধরণের স্বেচ্ছাসেবার সত্ত্বা জেগে উঠেছিল। আমরা বুঝতে শিখে ছিলাম যে এই পরিস্থিতিতে তাকে সাহায্য করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য।
কিন্তু সেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া আর সম্ভব হল না। মেয়েটি আর কোনও দিনও স্কুলে ফিরল না। আমাদের লেখা নোটসগুলো তার হাতে পৌঁছেছিল কিনা সে বিষয়ে আমি আজও নিশ্চিত নই। যদি পৌঁছাত, তাহলেও বা কী হত? তবে সেই নোটসগুলো কিন্তু আমাদের সাহায্য করেছিল। এই নোটসগুলো আমাদের এটা বুঝতে সাহায্য করেছিল যে আমরা তার পাশেই রয়েছি। যারা পথে নেমে হত্যালীলা চালায়, সেই বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।
নিউজিল্যান্ডে দেখলাম স্কুল পড়ুয়ারা 'হাকা' নৃত্য করছে। এটি একটি প্রথাগত রণনৃত্য। এই নাচ দেখে আমি সত্যিই আনন্দ পেয়েছি। আমি জানি এই নৃত্যের মাধ্যমে স্কুল পড়ুয়ারা তাদের মনে মধ্যে জমে থাকা বিশৃঙ্খলা ও আকস্মিক ধাক্কাটা ব্যক্ত করতে চাইছিল। প্রতিটি ক্ষতেরই প্রলেপ প্রয়োজন। যে ভাবে ক্রাইস্টচার্চে নৃশংস হত্যা চালানো হয়েছে তাতে বেশ বড় মাপের অভিব্যক্তির প্ৰয়োজন। আর ঠিক সেই কাজটিই করে দেখালেন নিউজিল্যান্ডের রমণীরা। মুসলিম নারীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের জন্য তাঁরা গোটা একটি দিন হিজাব পরে কাটাল। হিজাব হচ্ছে সেই পোশাক যাকে ঘিরে বিশ্ব জুড়ে বিতর্কের শেষ নেই।
১৯২৩ সালে মিশরের নারীবাদী হুদা শ'ওরওয়াই জনসমক্ষে ঘোমটা পরিত্যাগ করেছিলেন। ছাত্রীরা অবিভাবকের অনুমতি ছাড়াও অবগুণ্ঠন ব্যবহার করতে পারবে - এই দাবি তুলে, ১৯৯৪ সালে, মিশরের ছাত্র সংগঠনগুলোর তীব্র আন্দোলন শুরু করেছিল। সেই আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করে শেষ পর্যন্ত পড়ুয়াদের দাবি মেনে নিয়েছিলেন মিশরের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী। নারীবাদী বিষয়ক শিক্ষাবিদরা নারীবাদী আন্দোলনে অবগুণ্ঠন স্থান নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। তবে আমি এখানে সেই বিতর্কে যেতে চাইছি না।
একটা কথাই শুধু বলতে চাই, সেই বিশ শতক থেকেই মুসলিম রাষ্ট্রগুলো অবগুণ্ঠন বন্ধ করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।
তুরস্ক ও ইরান তো অবগুণ্ঠন ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ফেলছিল, যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে তীব্র প্রতিবাদের সূচনা হয়। ইরানের বহু নারী বহু বছর ধরে নিজেদের বাড়িতেই আবদ্ধ করে রেখেছিলেন কারণ তাঁরা ঘোমটা ছাড়া পথে নামতে চাননি। যাঁরা পথে ঘোমটা পরে নেমেছিলেন তাঁদের অপমান করা হয়েছিল, জরিমানা করা হয়েছিল এমনকি বন্দিও করা হয়েছিল।
নিউজিল্যান্ড মহিলাদের এই অভিব্যক্তি নিঃসন্দেহে মন জয় করে নেয় [ছবি: রয়টার্স]
আজ অবশ্য ইরানের মহিলারা হিজাব বাধ্যতামূলক করে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। মানবাধিকার আইনজীবী নাসরিন সতৌদেহকে ৩৮ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং ১৪৮টি বেত্রাঘাতে দণ্ডিত করা হয়েছিল। আজকের ইরানের মহিলাদের কাছে ঘোমটা না পরা মানে নিজের জীবন বিপন্ন করা। ইরানি মহিলারা জানেন পিতৃতন্ত্র শুধুমাত্র ভূষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, মহিলা কী পরতে পারবেন আর কি পরতে পারবেন না তা এই পিতৃতন্ত্র সমাজই ঠিক করে দেয়।
পশ্চিমি মহিলারা, যাঁরা ইরানে গিয়ে মাথায় স্কার্ফ ব্যবহার করেন, তাঁরা এই প্রথাকে আইনসম্মত করে তুলছেন এবং ইরানি মহিলাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছেন। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের মহিলাদের কাছে মাথায় ঢাকা দেওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়।
বহু যুগ ধরেই মুসলমান মহিলাদের ঘোমটা পরার পিছনে একটি কারণ ছিল - শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলে তারা যেন হেনস্তার হাতে থেকে উদ্ধার পায়। মার্কিন সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে যাওয়ার পর আফগান মহিলাদের বোরখা পরিহিত ছবি স্বভাবতই মার্কিন সংবাদমাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ভারতেও তো বোরখা পরিহিত ভারতীয় মহিলারাও টিভির পর্দায় বসে তিন তালাক নিয়ে আলোচনা করেন।
আর রাজনৈতিক ও সামাজিক কলঙ্কে জর্জরিত এই পোশাক ইস্যুটিকেই হাতিয়ার করে নিউজিল্যান্ডের মহিলারা তাঁদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন।
আমার মতে এটা শুধুই একটি সাহসী পদক্ষেপ নয়, এটি ইসলামোফোবিয়ার একটি প্রত্যক্ষ আক্রমণ।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে