এবার নকল চাঁদও তৈরি করবে চিন: জেনে নিন সেই চাঁদের ইতিবৃত্তান্ত
শহরগুলোকে আলোকিত করতে তৈরি হবে এই চাঁদ, কিন্তু পৃথিবীর উপর এর কুপ্রভাব অপরিসীম
- Total Shares
চিনেরা সব কিছুরই নকল করতে সিদ্ধহস্ত। এবার চাঁদমামামার পালা। হ্যা, আপনি ঠিকই বুঝেছেন। মহাকাশে আস্ত একটা নকল চাঁদ বানাতে চলেছে চিন।
তা, এই নকল চাঁদ বানানোর পিছনে উদ্দেশ্যটা ঠিক কী? এই নকল চাঁদের মাধ্যমে রাতের বেলা সূর্যের কিরণ চিনের শহরগুলোর উপর প্রতিফলিত হবে। এর ফলে রাতের বেলা শহরগুলোকে আলোকময় করে রাখার জন্য যে বিদ্যুৎ ও অর্থ খরচ হয় তা সাশ্রয় করা যাবে। তবে আর পাঁচটা প্রকল্পের মতো, এই প্রকল্পের জন্য মানুষ, জীবজন্তু ও পশু পাখির উপর কী প্রভাব পড়তে পারে তা মাথায় রাখেনি বেজিং।
দক্ষিণ পশ্চিম চিনের সিচুয়ান প্রভিন্সের চেংদু শহরের উপর এই নকল চাঁদ 'জ্বলজ্বল' করবে। এই কৃত্রিম চাঁদটি ১০কিলোমিটার থেকে ৮০ কিলোমিটারের একটি নির্দিষ্ট জায়গা জুড়ে সূর্যের কিরণকে প্রতিফলিত করবে এবং প্রায় ৫০০ কিলোমিটার উচ্চতায় পৃথিবীকে প্রদিক্ষন করবে। সত্যিকারের চাঁদটি কিন্তু ৩,৮০,০০ কিলোমিটার উচ্চতায় পৃথিবীকে প্রদিক্ষন করে।
চিনের দৈনিক পিপলস ডেইলির প্রতিবেদন অনুযায়ী এই চাঁদটি আসল চাঁদের আয়তন থেকে আট গুন বড় হবে।
চেংদুর মহাকাশ সংক্রান্ত আধিকারিকরা দাবি করেছেন নকল চাঁদ তৈরি করে তা যথোপযুক্ত ব্যবহার করতে পারলে খরচ রাস্তার আলোর খরচের থেকে কম পড়বে। চায়না ডেইলির দাবি, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৫০ বর্গকিলোমিটারের একটি জায়গা আলোকিত করতে পারলে ১.২ বিলিয়ন ইউয়ান (১৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১২৬৬কোটি টাকা) সাশ্রয় হবে।
২০২০ সালের মধ্যে সিচুয়ানের জিচ্যাং উপগ্রহ কেন্দ্র থেকে এই নকল চাঁদটিকে উৎক্ষেপণ করা হবে। চায়না ডেইলির প্রতিবেদন অনুযায়ী এই প্রকল্প সফল হলে আরও বেশ কিছু নকল চাঁদ উৎক্ষেপণ করার পরিকল্পনা রয়েছে চিনের।
এই খবরটা কিন্তু একেবারেই সুখবর নয়।
আলো দূষণ সমস্যায় ফেলছে অলিভ রিডলি প্রজাতির কচ্ছপদের [ছবি: রয়টার্স]
লেট দেয়ার বি নো লাইট
এই ধরণের কৃত্রিম, অপ্রয়োজনীয়, জোর করে তৈরি করা আলোকে আমরা সাধারণত 'আলো দূষণ' বলে থাকি। এই নকল চাঁদ কিন্তু 'আলো দূষণের' মাত্রাটা বাড়িয়ে দেবে। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আলো উৎপাদন করলে তার খারাপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। এর ফলে, মহাকাশ নিয়ে গবেষণা আরও জটিল, কঠিন হয়ে পড়বে, রাতের তারাগুলোকে আর প্রত্যক্ষ করা যাবে না এবং সর্বপরি বাস্তুতন্ত্র ও জীব জন্তু এমনকি উদ্ভিতের জীবনের উপরও প্রভাব ফেলবে।
কয়েকশো লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীর জীবন দিন রাতের প্রাকৃতিক নিয়মের উপরই নির্ভরশীল। এই নিয়ম পৃথিবীর সমস্ত উদ্ভিত ও জীবজন্তুর কোষে প্রবেশ করে গিয়েছে। রাতের বেলায় বাড়িতে ও রাস্তায় আলো জ্বালিয়ে মানুষ এই নিয়মের উপর এমনিতেই বিশাল প্রভাব ফেলেছে।
নিশাচর পাখিদের দেশ করে দিতে পারে চিনের কৃত্রিম চাঁদ [ছবি: রয়টার্স]
জন্তুদের ক্ষেত্রে আলো ও অন্ধকার দুটোই সমান উপকারী। যে জন্তুরা শিকার করে তারা রাতের অন্ধকারকে হাতিয়ার করেই শিকার করে। অলিভ রিডলির প্রজাতির কচ্ছপরা হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে সমুদ্র সৈকতে ডিম পাড়তে আসে। ডিম ফোটানোর সময় তারা দিগন্তরেখার আলোয় দিক নির্ণয় করে। কিন্তু সৈকত লাগোয়া রাস্তা জুড়ে আলোর স্তম্ভ বাসানোর জন্য এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে উল্টোদিকে ডিম ফোটাচ্ছে তারা। এর ফলে, ডিমগুলো এক হয় গাড়ির তলায় চাপা পড়ে নয়ত চোরাকারবারিদের শিকার হয়।
একই ভাবে নিশাচর প্রাণীরা চাঁদ ও তারার আলোর সাহায্যে রাতে উড়ে বেড়ায় ও শিকার সন্ধান করে বেড়ায়। কিন্তু কৃত্রিম আলোর ফলে আলোকিত বাড়ি, টাওয়ার বা বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা খেয়ে তাদের জীবনহানী হয়। ঋতুর সঙ্গে আলোর যে তারতম্য ঘটে তা দেখেই পরিযায়ী পাখিরা তাদের যাত্রার দিনক্ষণ নির্ধারণ করে। কিন্তু কৃত্রিম আলোতে তাদের এই দিন নির্ণয় বদলে গেলে জীবনহানির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। কারণ, নির্দিষ্ট জায়গায় তারা যদি নির্দিষ্ট ঋতুর আগে পৌছিয়ে যায় তাহলে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে না। এর ফলে এদের সংখ্যাও ক্রমশ হ্রাস পাবে।
হংকংয়ে কৃত্রিম আলোর ঝলকানিতে চাঁদ প্রায় দেখতেই পাওয়া হয় না [ছবি: রয়টার্স]
কুপ্রভাবের এখানেই শেষ নয়
আলো দূষণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যর উপরও প্রভাব ফেলে।
গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে প্রাকৃতিক জীবনচক্রের উপর মানুষ নির্ভরশীল। শরীরে মেলাটোনিন বলে একটি পদার্থের উৎপাদন হয় দিনের আলো ও রাতের অন্ধকারের ভারসাম্যের ফলে।
ঘুমোনোর সময়ও যদি সর্বক্ষণ আলো ফুটে থাকে তাহলে মেলাটোনিনের উৎপাদন হ্রাস পাবে। এর ফলে মানুষের দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, কর্মক্লান্তি, মাথা ব্যাথা ও এমনকি স্থূলতাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। উল্টে, মানুষের ঘুমের পরিমাণ কমে যাবে।
এখানে একটা কথা স্মরণ করে দেওয়াই ভালো। চিনেরা এমনিতেই মানসিক চাপ, মানসিক অবসাদ ও মানসিক দুশ্চিন্তায় বেশি ভোগেন। গুয়াংজি ন্যাচারাল সাইন্স ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে যে চিনের জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ সারা জীবন ধরে মানসিক অবসাদে ভোগেন এবং ৩.৫ শতাংশ জীবনভর নানা ধরণের আতঙ্কে ভোগেন।
মানসিক বিগারগ্রস্তদের আমরা ইংরেজিতে 'লুনাটিক' বলে থাকি। এই শব্দটির উৎপত্তি কিন্তু ল্যাটিন শব্দ 'লুনাটিকাস' থেকে যার বাংলা তর্জমা 'চাঁদের থেকে'।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে