দুই ধরনের সন্ত্রাস: আজহার মাসুদকে বাঁচালেও উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে কঠোর চিন
উইঘুরদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে স্বঘোষিত জঙ্গিকে রক্ষা করছে চিন
- Total Shares
রাষ্ট্রসঙ্ঘে এই নিয়ে চতুর্থবার মাসুদ আজহারকে জঙ্গি বলে ঘোষণা করা আটকে দিল চিন।
সন্ত্রাস নিয়ে বেজিংয়ের নীতি যে দ্বিমুখী তা খুব স্পষ্ট ভাবেই দেখা যাচ্ছে।
তাদের বিরুদ্ধে বহু বার অভিযোগের কোনও প্রমাণ পাওয়া না গেলেও জিনঝিয়াং প্রদেশে হাজার হাজার মুসলমানকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়েছে চিন। কিন্তু আজহারের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের পদক্ষেপের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে বেজিং – আজহার হল জৈশ-ই-মহম্মদের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা, জৈশ হল সেই সংগঠন যাকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে আখ্যা দিয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ।
সুদিপ পশ্চিমের জিনঝিয়াং প্রদেশে হাজার হাজার মুসলমান, মূলত উইঘুরদের আটক করে রাখা নিয়ে সারা বিশ্বে ক্রমেই সমালোচনার পাহাড় জমছে – এই অবস্থায় সোমবার শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে বেজিং, তারা তার নাম দিয়েছে “সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।” জিনঝিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে কঠোর পদক্ষেপ করা হয়েছে তা যে ঠিক, সে কথা প্রমাণ করতে চাইছে চিন।
ওই শ্বেতপত্রে চিনের নীতি হিসাবে বলা হয়েছে যে তারা কাঠিন্য ও সহমর্মিতার মধ্যে তারা ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে। শ্বেতপত্রে ধর্মীয় যে সন্ত্রাস দমনের কথাও বলা হযেছে।
চিনের সবচেয়ে বড় প্রদেশে জিনঝিয়াং অঞ্চলে ১ লক্ষ ১০ হাজার মতো উইঘুর রয়েছেন যাঁদের দশ ভাগের এক ভাগ রয়েছেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে প্রেসিডেন্ট জিনপিংকে – কেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তিনি দ্বিমুখী নীতি নিয়ে চলছেন। (উৎস: রয়টার্স)
২০১৮ সালের অগস্টে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত্র কমিটি (ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান রাইটস কমিটি) ততক্ষণে জিনঝিয়াং প্রদেশকে গণ কারাগার বানিয়ে ফেলেছে চিন এবং মৌলবাদ থেকে তাঁদের মুক্ত করার নামে তাঁদের বিশ্বাসে আঘাত হামছে। মানবাধিকার কর্মীদের থেকে জানা গেছে যে লোকজনকে জোর করে চাইনিজ ম্যান্ডারিন শেখানো হচ্ছে, চিনা কমিউনিস্ট পার্টির নামে শপথ করানো হচ্ছে, ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ এমন খাবার খেতে বাধ্য করা হচ্ছে এবং চিনের প্রেসিডেন্ট জাই জিনপিংযের প্রতি আনুগত্যের শপথ করানো হচ্ছে।
জিনজিয়াংয়ে চিনা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফেরা মিহরিগুল তুরসুন নামে এক ব্যক্তিকে মার্কিন কংগ্রেসে বলতে শোনা গেছে তাঁকে গ্রেফতার করে মাসের পর মাস ধরে বিভিন্ন সময়ে তাঁকে ওই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটকে রাখা হত। যখন প্রথমবার তিনি বিদেশ থেকে ফিরলেন তখন তাঁর কাছ থেকে তাঁর সন্তানদের দূরে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং অন্য ৬০ জনের সঙ্গে একটি ঘরে তাঁকে তালাবন্ধ করে রাখা হয়, যে ঘরে তাঁকে বন্দি করে রাখা ছিল, সেই ঘরের প্রতিটি দেওয়ালে ক্যামেরা লাগানো ছিল। ওই ঘরে এক সঙ্গে ৬০ জন ঘুমাতে পারতেন না, ৪৫ জন একসঙ্গে ঘুমাতে পারেন, আর বাকি ১৫ জনকে তখন দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, এই ভাবেই একের পর এক (বাই রোটেশন) তাঁদের ঘুমাতে হত।
এই শিবিরের অবস্থা ছিল ভয়াবহ – যাঁরা অনুশোচনা করতেন (তাঁদের অধিকার কোনও সময় দাবি করে ফেলেছেন বলে) তাঁদের কেউ যদি সান্ত্বনা দিয়ে ফেলতেন বা সহমর্মিতা প্রকাশ করে ফেলতেন তা হলে হত তাঁর ঘরে থাকা অন্যদের সামনে নগ্ন করে তাঁদের উপরে অত্যাচার করা হত এবং কেউ তার প্রতিবাদ করতে গেলে তাঁকেও শাস্তি পেতে হত।
কেন মাসুদ আজহারকে রক্ষা করছে চিন – যে নিজেই দাবি করছে যে সে সন্ত্রাসবাদী। (সূত্র: পিটিআই)
চিন দাবি করে যে তারা জিনঝিয়াং প্রদেশে মানবাধিকার রক্ষায় সচেষ্ট এবং তারা দাবি করেছে যে সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তারা ২০৫২টি বিস্ফোরক ডিভাইস উদ্ধার করছে; তাদের দাবি, ৩০,৬৪৫ জনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, ৪৮৫৮টি অবৈধ ধর্মীয় কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে এবং ৩,৪৫,২২৯টি ধর্মীয় জিনিস বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
চিন দাবি করেছে যে এই সন্ত্রাসবাদীদের প্রধান নেতারাই তাদের লক্ষ্য।
যাই হোক, যারা কাঠমান্ডু থেকে আইসি ৮১৪ বিমান অপহরণে যুক্ত ছিল এবং ভারতে একের পর এক সন্ত্রাসবাদী হামলার জন্য দায়ী, যার মধ্যে রয়েছে ২০০১ সালের সংসদ ভবনে হামলা, ২০১৬ সালে পাঠানকোটে বিমানঘাঁটিতে হামলা – এবং ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ে হামলা – তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা থেকে রাষ্ট্রসঙ্ঘকে বিরত রাখছে চিন।
তিব্বতে জনবিন্যাসের বদল করে দেওয়ার পরে এখন জিনঝিয়াংয়ের জনবিন্যাস জোর করে বদল করতে উঠে পড়ে লেগেছে চিন, এখন তারা পরিকল্পনা করে হান চাইনিজ অঞ্চলে ব্যাপক হারে অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে।
ধর্মের উপরে নিষেধাজ্ঞা? মসজিদের উপরে চিনের নজরদারিই প্রমাণ করছে যে কঠোর পদক্ষেপ করা হচ্ছে। (সূত্র: রয়টার্স)
জিনজিয়াং প্রদেশের মধ্য দিয়ে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভ (বিআরআই) করার সময় উইঘুর মুসলমানদের প্রতিবাদ কঠোর ভাবে দমন করেছে। উইঘুর 'স্বাধীনতা সংগ্রামীরা' বিআরআই-এর উপরে আঘার হানতে পারে বলে চিনের মনে ভয়ও রয়েছে। মৌলানা মাসুদ আজহারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার পথ আটকে রাখাকেও এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা যেতে পারে কারণ চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরও (সিপিইসি) পাকিস্তানের জঙ্গিরা কাজে লাগাতে পারবে।
নিজেদের ভাষ্যকারদের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের তাদের অবস্থান নিয়ে বিদেশের গণমাধ্যমের প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়েছে চিন। উল্টে তারা দাবি করছে যে পশ্চিমের দেশগুলো শক্তিশালী চিনের তো বটেই এমনকি চিনেরও বিরোধী।
জাই জিনপিংকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে – চিন যখন তার নিজের দেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তখন তারা কেন ‘সন্ত্রাসের মৌলানা’ মাসুদ আজহারের বিরদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে দিচ্ছে না?
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে