সিবিআই বনাম কলকাতা পুলিশ: কেন মনে হচ্ছে সিবিআইয়ের প্রস্তুতির অভাব ছিল
কমিশনারের বাড়িতে অভিযানের সময়েও সিবিআই কর্তারা জানতেন না সেটি কোন থানা এলাকায়
- Total Shares
জমে উঠেছে সিবিআই বনাম কলকাতা পুলিশের লড়াইটা। রবিবার সন্ধ্যাবেলায় সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসাররা হানা দিয়েছিলেন কলকাতা পুলিশ কমিশনারের বাসভবনে। কিন্তু তাঁদের বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। উল্টে কলকাতা পুলিশের তরফ থেকে তদন্তকারী অফিসারদের কিছুক্ষণের জন্যে আটক করে রাখা হয়।
এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে প্রশাসনিক বৈঠক সেরে সাংবাদিকদের মুখোমুখী হন মুখ্যমন্ত্রী। এর পর সোজা চলে যান মেট্রো চ্যানেলে। সেখানে এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্নায় বসেছিলেন তিনি, অবশ্য মঙ্গলবার ধর্না শেষ করেন।
সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল সিবিআই। দেশের শীর্ষ আদালত রাজীব কুমারকে সিবিআইয়ের সামনে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি সিবিআইকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে পরবর্তী শুনানির আগে কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে গ্রেফতার করা যাবে না।
প্রথম থেকেই অনেকের মনে ধারণা জন্মেছিল যে সিবিআই পুরোদস্তুর তৈরি হয়ে এই 'অপেরেশনে' নামেনি। আসুন দেখে নেওয়া যাক কেন ধারণার উদয় হল।
১) কী ধরণের অপরেশন
সিবিআই বলছে 'সিক্রেট অপারেশন'। অর্থাৎ গোপন অভিযান। কিন্তু কলকাতা পুলিশ যে কলকাতার নগরপাল রাজীব কুমারকে খুঁজছে তা কয়েকদিন আগে থেকেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। সরকারিভাবে সিবিআইয়ের তরফ থেকে না জানানো হলেও এই খবর সিবিআই সূত্র থেকেই সংবাদমাধ্যম সংগ্রহ করেছে। সিবিআই ঠিক কোন দিন নগরপাল বাসভবনে হানা দেবে সেই খবর জানা না থাকলেও তা যে কোনও দিনই হতে পারে বলে 'খবর' ছিল। সুতরাং এই অভিযানকে কতটা 'সিক্রেট' বলা চলে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
২) সঠিক তথ্যের অভাব
আর পাঁচজনকে জেরা করা আর একজন আইপিএস আধিকারিককে জেরা করা এক কথা নয়। বিশেষ করে সেই আইপিএস অফিসার যখন কলকাতা পুলিশ কমিশনার। বিশেষ করে সেই অফিসার যখন বেশ কয়েকবার সমন পাওয়ার পরেও দেখা করতে চাননি সিবিআইয়ের আধিকারিকদের সঙ্গে। বিশেষ করে যখন কলকাতা পুলিশ ও রাজ্য সরকার পাল্টা চাপ সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এই ধরণের ক্ষেত্রে সিবিআইকে তো আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করে অভিযানে নামা উচিত ছিল। অথচ এই ধরণের অভিযানের একেবারে প্রাথমিক কর্তব্যেই গলদ রয়ে গেল কী ভাবে।
রবিবার সন্ধ্যাবেলা একটা জিনিস পরিষ্কার জানা গিয়েছিল। যে বাড়িতে অভিযান করতে গিয়েছিলেন সিবিআইয়ের তদন্তকারী আধিকারিকরা (অর্থাৎ নগরপালের সরকারি বাসভবন) সেই বাড়িটি কোন থানার আওতায় পড়ে সেই সামান্য হোমওয়ার্কটুকুও করা হয়নি। প্রথমে পার্ক স্ট্রিট থানায় গিয়ে পরে শেক্সপিয়ার সরণি থানায় হাজির হলেন তাঁরা।
সিবিআইয়ের মতো একটি সংস্থার কাছে এই গাফিলতি মেনে নেওয়া যায় না।
রাজীব তদন্তে কি পুরদস্তুর প্রস্তুত ছিল সিবিআই? [ছবি: পিটিআই]
৩) তদন্তের প্রক্রিয়া
তদন্তের প্রক্রিয়া সম্পর্কেও সিবিআইয়ের আধিকারিকরা দু'জায়গায় দু ধরণের কথা বললেন। সংস্থার এক শীর্ষ স্থানীয় আধিকারিক ফোনে টেলিভিশন দেওয়া একটি সাখ্যাৎকারে জানালেন তাঁরা শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়েছিলেন। আর তাই তাঁদের কোনও কাগজের প্রয়োজন ছিল না। আবার শেক্সপিয়ার সরণি থানা থেকে বেরিয়ে এসে সিবিআইয়ের এক আধিকারিককে দেখা গেল সংবাদমাধ্যমকে একটি কাগজ দেখিয়ে জানাচ্ছেন, "প্রয়োজনীয় কাগজ আমাদের কাছে রয়েছে।" আদৌ, এই ধরণের অভিযানে নথি লাগে (কলকাতা পুলিশ এই অভিযোগই তুলেছে) কী লাগে না তা নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেই গেল।
৪) আদালতের সাহায্য নেওয়া হয়নি
কলকাতা পুলিশের হাতে 'হেনস্থা' হওয়ার পর সিবিআই আদালতের দ্বারস্থ হল। আদালতও রাজীব কুমারকে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। তিন তিনবার চিঠি পাঠিয়ে রাজীব কুমার যখন সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসারদের সঙ্গে দেখা করেননি তখন তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আগেই সিবিআই আদালতের দ্বারস্থ হল না কেন? আদালতের নির্দেশ আগেই জোগাড় করতে পারলে হয়তো তাদের কাজ করতে আরও সুবিধা হত।
৫) তথ্যপ্রমাণ আছে কি?
সোমবার প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ জানিয়েছেন, "সিবিআইয়ের আনা অভিযোগ যদি সত্যি হয় তাহলে তিনি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেবেন যাতে অভিযুক্তকে পস্তাতে হয়।" আর এর জন্যে সিবিআইকে উপযুক্ত প্রমান দাখিল করতে বলা হয়েছিল। মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি রাজীব কুমারকে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিলেও জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁকে পরবর্তী শুনানি অবধি গ্রেফতার করা যাবে না। তার মানে কি সিসিআইয়ের কাছে এখনও পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ নেই?
সবমিলিয়ে আদালতের নির্দেশের ফলে কলকাতা সিবিআই বনাম কলকাতাপুলিশ লড়াইয়ের ফল এখন ১-১। মানে, হাজিরা দিতেই হবে রাজীব কুমারকে। আবার পরবর্তী নির্দেশ ছাড়া কমিশনারকে গ্রেফতার করতে পারবে না সিবিআই।
আশা করা যায় লড়াইয়ের পরবর্তী রাউন্ডে আরও প্রস্তুতি নিয়ে ময়দানে নামবে সিবিআই।