ধর্মাচরণের জন্য কী প্রয়োজন তাও বলে দেবে আদালত?
প্রশ্ন উঠছে অন্য ধর্মের ক্ষেত্রেও ধর্মস্থানের অপরিহার্যতা নিয়ে
- Total Shares
নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদ অপরিহার্য কিনা তা আদালত কী ভাবে ঠিক করতে পারে? মজলিশ-ই ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (মিম) প্রধান পেশায় ব্যারিস্টার ও বর্তমানে সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এই প্রশ্ন তুলেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ‘নামাজ পড়ার জন্য মসজিদ অপরিহার্য নয়’ সংক্রান্ত পুরোনো রায়ের প্রেক্ষিতে তাদের যে অবস্থানের কথা জানিয়েছে, সেই প্রসঙ্গে।
সর্বোচ্চ আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
কেবলমাত্র আসাদউদ্দিন ওয়াইসি নন, মুসলমান সমাজের সর্বত্রই এই রায় ঘিরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। তার চেয়েও বড় কথা সর্বোচ্চ আদালতের অবস্থান দেশের শাসক দল বিজেপিকে উজ্জীবিত করে তুলেছে। দলের কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের অনেকেই এই রায়ের পর নতুন করে অযোধ্যা অভিযান কর্মসূচি গ্রহণ করার কথা ভাবতে শুরু করেছেন। যদিও এই রায়ের সঙ্গে অযোধ্যা মামলার সম্পর্ক নেই বলে আদালত মনে করে।
মুসলমান সমাজের বড় একটি অংশের মতে, ইসলামে মসজিদ একটি জরুরি অংশ। কুরআন ও হাদিসে মসজিদের উল্লেখ আছে। কুরআনে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার কথাও বলা রয়েছে।
এর আগে তিন তালাক ইস্যুতে বিচারপতি কুরিয়েন বলেছিলেন, তিন তালাকের বিষয়টি কুরআনে নেই। লক্ষ্য করার বিষয় হল, তিন তালাকের মতো বিষয় সামনে আসাতে কুরআনের উল্লেখ করা হয়েছিল কিন্তু যখন মসজিদের বিষয়টি এল তখন কুরআন প্রসঙ্গ একেবারেই চাপা পড়ে গেল। সেকারণেই মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ প্রশ্ন তুলেছে, নামাজ আদায়ে মসজিদ অপরিহার্য নয় যেমন; অন্য ধর্মে ধর্মস্থান কী অপ্রয়োজনীয় নয়? সম্পূর্ণভাবেই ধর্মীয় বিষয়ে কোনটা জরুরি আর কোনটা তা নয়; কীভাবে আদালত তা ঠিক করে দিতে পারে? যদিও আদালত জানিয়ে যে এটি জমিঅধিগ্রহণ সংক্রান্ত মামলার প্রেক্ষিতে রায়।
মুসলমান সমাজ চেয়েছিল বিষয়টি যাতে সাংবিধানিক বেঞ্চে পাঠানো হয়। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত মামলাটি সাংবিধানিক বেঞ্চে পাঠানোর দাবি খারিজ করে দিয়ে পুরনো রায়ই বহাল রেখেছেন। তবে তিন সদস্যের বিচারপতির সমন্বিত বেঞ্চে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র এবং বিচারপতি অশোক ভূষণ ওই রায় দিলেও বিচারপতি এস আব্দুল নাজির ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। তিনি মনে করেন, মসজিদ নামাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কী না তা বিচারের জন্য পাঁচ সদস্যের বিচারপতির বেঞ্চ গঠন করা উচিত।
কলকাতার রেড রোডে নমাজ পড়া (ফাইল ছবি: পিটিআই)
একটি সর্বভারতীয় ইসলামীয় সংগঠন সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে জানায়, যে বিচারপতিই বলুন না কেন, তার সম্পর্কে একথাই বলা যায় যে, কুরআন শরিফ নিয়ে এবং ফেকাহ শাস্ত্র নিয়ে তিনি পড়াশোনা করুন। কারণ, নামাজের সঙ্গে মসজিদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। জুম্মার নামাজ মসজিদ ছাড়া কখনও হয় না। অন্যদিকে আরেকটি সংগঠনের তরফে বলা হল, ওই রায়ে কোথাও মসজিদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়নি। বরং বলা হয়েছে মুসলমানরা প্ল্যাটফর্মে নামাজ পড়তে পারেন, স্টেশনে নামাজ পড়তে পারেন, প্রয়োজনে রাস্তার উপরে বসেও নামাজ পড়তে পারেন। সুপ্রিম কোর্ট থেকে এগুলোর বৈধতা পাওয়া গেল যে মুসলমানরা মসজিদ ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় নামাজ পড়তে পারে।
কেবলমাত্র নমাজ পড়া নয়, নমাজ প্রতিষ্ঠা করা ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। প্রত্যেক মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য হল, নামাজ কায়েম করা, নামাজের জামাত প্রতিষ্ঠা করা। সে জন্যই মসজিদ মুসলমান সমাজের অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। মসজিদ ছাড়া দিনে পাঁচবার নামাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং অপরিহার্য ভাবে শুক্রবারের জুম্মার নামাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সংবিধানে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে স্বাধীনভাবে ধর্মপালনের অধিকার দেয়া হয়েছে। মসজিদ এবং নামাজ প্রসঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের ওই মন্তব্য কাম্য নয় এবং সংবিধানের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।
নামাজ পড়ার জন্য যে মসজিদ অপরিহার্য নয়, সেটাই ছিল ১৯৯৪ সালের সর্বোচ্চ আদালতের রায়। ইসমাইল ফারুকি মামলায় আদালতের পাঁচ বিচারপতি সর্বসম্মত ভাবে জানিয়েছিলেন, মসজিদ ছাড়াও নামাজ যে কোনও স্থানেই পড়া যেতে পারে। সে কারণে সরকার প্রয়োজনে মসজিদের জমি অধিগ্রহণও করতে পারে।
২৪ বছর আগের এই রায়কেই সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড ও অন্যরা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। তাঁদের আর্জি ছিল, বিষয়টা সুপ্রিম কোর্টের সাত বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের কাছে পাঠানো হোক, যেহেতু অযোধ্যার মূল মামলার নিষ্পত্তির আগে এই বিষয়টির মীমাংসা হওয়া জরুরি। কারণ সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায় ২০১০ সালে এলাহাবাদ উচ্চ আদালতকে প্রভাবিত করেছিল। সেই রায়ে এলাহাবাদ উচ্চ আদালত অযোধ্যার বিতর্কিত ২ দশমিক ৭৭ একর জমি তিনটি সমান ভাগে ভাগ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিতর্কিত স্থানের গর্ভগৃহ, যেখানে রামের মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল, তা দেওয়া হয় ‘রামলালা’কে, দ্বিতীয় ভাগ দেওয়া হয় সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে, তৃতীয় ভাগটি পায় নির্মোহী আখড়া।
অযোধ্যা মামলার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই বলে মনে করে সর্বোচ্চ আদালত (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছে, এই রায় অযোধ্যার বিতর্কিত জমির মালিকানা সংক্রান্ত মূল মামলার রায়কে প্রভাবিত করবে না। আগামী ২৯ অক্টোবর থেকে ওই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানায় আদালত। কিন্তু আদালতের রায় বেরনোর পর সাধারণ মুসলমান সমাজের যে প্রিতিক্রিয়া তা সন্তোষজনক নয়। ঘরে নামাজ পড়লে এক গুণ সওয়াব পাওয়া যায়। কিন্তু মসজিদে নামাজ পড়লে ২৭ গুণ সওয়াব পাওয়া যায়। জুমার নামাজ মসজিদ ছাড়া হয় না। জামাত মসজিদ ছাড়া হয় না। স্বভাবতই প্রশ্ন তাহলে মহামান্য আদালত কেন ওই রায় দিয়েছেন?
উত্তর জানা নেই। একমাত্র সর্বোচ্চ আদালত এর ব্যাখ্যা দিতে পারে। ধর্মপ্রাণ এক মুসলমান বলেন, মসজিদের প্রয়োজন আছে নাকি নেই এ ব্যাপারে দারুল উলুম দেওবন্দের কাছে ব্যাখ্যা চাইলে ভালো হত। কেউ কেউ বলেন, কাবা শরীফে নামাজ পড়লে এক লাখ গুণ সওয়াব পাওয়া যায়। লোকে মক্কা নগরে বেড়াতে যায় না। কাবা শরিফের মসজিদে নামাজ পড়তে যায়। মদিনা শরীফে প্রিয় নবীর (সা.) রওজা জিয়ারত করার পাশাপাশি মসজিদে নববীতে নামাজের জন্য মানুষের হুড়োহুড়ি পড়ে। এখানেই বোঝা দরকার মসজিদের প্রয়োজন আছে, না নেই। মসজিদ ছাড়া মুসলিমের পরিচয় নেই। মসজিদ নিয়েই মুসলিমের পরিচয়। ধর্ম নিয়ে
ধর্মপ্রাণ মানুষ নানা মত সব যুগে-কালে-প্রসঙ্গে-অপ্রসঙ্গে দিয়ে আসছেন। সর্বোচ্চ আদালত তার রায়ে মসজিদ ও নামাজের সম্পর্ক নিয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করলে মুসলমান সমাজে নানা প্রতিক্রিয়া হতেই পারে। লক্ষ্যনীয়, বিজেপি নেতা সুব্রমনিয়াম স্বামীর বক্তব্য, এই রায়ের ফলে রাম মন্দির নির্মাণের পথ প্রশস্ত হল। তিনি এও জানান, মসজিদ স্থানান্তর করা যায়, মন্দির নয়। বাধা দূর হয়েছে, এ বার রাম মন্দির নির্মাণ হবে। এ ধরনের কথা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় সর্বোচ্চ আদালতের রায় মুসলমান সমাজকে সাময়িকভাবে হতাশ করলেও হিন্দুত্ববাদী শাসক ও বিজেপিকে দারুণ ভাবেই উজ্জীবিত করেছে। ক্রমশ তারা আরও আগ্রাসি হয়ে উঠছে। অভীষ্ট লক্ষ্যপূরণে তাদের আগ্রাসন ভূমিকা আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেবে।
উল্লেখ করাই যায়, প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র অবসর নিচ্ছেন ২ অক্টোবর। অর্থাৎ সোমবার তাঁর শেষ কাজের দিন ছিল। অবসর গ্রহণের আগে অযোধ্যা সংক্রান্ত এই মামলা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ তাই তাঁর কাছে ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
আরও গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে, ১৯৯২ সালের ২ ডিসেম্বর অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধুলিসাৎ হওয়ার আগে থেকেই রাম মন্দির–বাবরি মসজিদ মামলা ছিল দেশের প্রতিটি নির্বাচনের অন্যতম প্রধান ইস্যু। বিজেপির প্রতিটি নির্বাচনী ইস্তাহারে অযোধ্যায় রাম মন্দির স্থাপনের বিষয়টি যেমন প্রতিশ্রুতি হিসেবে উল্লিখিত, তেমনই বিজেপিবিরোধী দলগুলো দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র রক্ষার স্বার্থে বিষয়টির বিরোধিতা করে এসেছে।
আগামী বছর ২০১৯ সালে দেশের লোকসভা নির্বাচন। শাসকদল তথা বিজেপি রাম মন্দিরের ধ্বজা উড়িয়ে হিন্দি তথা হিন্দু বলয়ে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে নিজেদের জমি অনেকটাই শক্তপোক্ত করেছেন কিন্তু হিন্দুত্বের নিরিখে সেই সময় এসে পড়েছে যেখানে কার্যত তাদের হিঁদুয়ানির প্রমাণ দিতেই হবে। রাম মন্দির নির্মাণ করে দেখাতেই হবে অন্তত শুরু করা হল এমন নিদর্শন তাদের রাখতেই হবে। এর অন্যথা ঘটলে পরিণতি কী, তা তারাই সবচেয়ে ভাল জানে। সে কারণেই এই মামলার গুরুত্ব যেমন বেড়ে গিয়েছিল, সর্বোচ্চ আদালতের রায় ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের প্রেক্ষিতে তা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল।
বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারে রামমন্দির নিয়ে প্রতিশ্রুতি থাকে (পিটিআই)
সর্বোচ্চ আদালত জমির অধিকারের মামলার সঙ্গে এ বারের রায়ের সরাসরি কোনও যোগসাজশ নেই এ কথা জানিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রায় গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিজেপি মনে করে, জমি মামলার নিষ্পত্তি ঘটিয়ে অযোধ্যায় রাম মন্দির স্থাপনের কাজ শুরু করা যাবে। আর তা কার্যকরী করা মানেই ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটবে। তাতে শাসক দলের রাজনৈতিক লাভ হবে।
তা ছাড়া নমাজ পড়ার জন্য মসজিদ অপরিহার্য নয় বলে সর্বোচ্চ আদালত ফের জানিয়ে দেওয়ায় গেরুয়া শিবির অযোধ্যা মামলায় হাতে পেয়ে গেল আরও বড় অস্ত্র। তারা এ বার আদালতে দাবি জানাবে, বাবরি মসজিদকে অযোধ্যায় বিতর্কিত জমি থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও পুনর্বাসন দেওয়া হোক। কারণ মন্দিরে পুজো করা হিন্দুদের আস্থার বিষয়। তার থেকেও বড় কথা হল, অযোধ্যায় রাম মন্দিরে রামলালা বিরাজমান। অন্যদিকে সর্বোচ্চ আদালত যদি পূর্বতন রায় পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দিত, তা হলে বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি মামলা আরও বেশ কিছুদিনের জন্য ঝুলে থাকত। সেক্ষেত্রে ২০১৯-এর ভোটের আগে রাম মন্দির প্রশ্নে আদালতে কোনও রায় ঘোষণা হওয়া মুশকিল হয়ে পড়ত।
গত ২৬ বছর ধরে বাবরি-বিতর্ক শুধু ঝুলে নেই জাতীয় রাজনীতিকেও বারবার প্রভাবিত করেছে। সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় ওই মামলার ঝুলে থাকা অবস্থাটা অনেকটাই লাঘব করল কিন্তু ’১৯-এর ভোটের রাজনীতি তে বিজেপির হিন্দুত্ব অনেকটাই উজ্জীবিত হল।