৩৩জনকে হত্যা করে ধৃত ভোপালের দর্জি: দেশের কয়েকজন সিরিয়াল কিলারের কথা

কারও শিকার কোলের শিশু, কারও ফুটপাথবাসী তো কারও শিকার ধর্মস্থানে আসা মহিলা

 |  5-minute read |   16-09-2018
  • Total Shares

ভোপালের এক সাদামাটা নিরীহগোছের দর্জি গত ১১ বছরে ট্রাকচালক ও খালাসি মিলিয়ে ৩৩জনকে খুন করেছে বলে অভিযোগ। গত সপ্তাহে গ্রেফতার হয়েছে আদেশ খামরা নামে সেই দর্জি। গ্রেফতারের পর থেকেই জেরার মুখে প্রতিদিনই তার কাছ থেকে বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য জানতে পারছে পুলিশ। 

আদেশ পুলিশকে প্রথমে জানিয়েছিল যে সে তার কাকা আশোক খামরার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই হত্যালীলা চালিয়েছে। ২০১০ সালে অন্তত শ'খানেক ট্রাক চালককে হত্যার অভিযোগে পুলিশ অশোককে গ্রেফতার করেছিল। এরপর ১৩ সেপ্টেম্বর, আদেশ জানায় যে একজন আদ্যোপান্ত নিরীহ বালক থেকে তার এই দাগি আসামি হয়ে ওঠার নেপথ্য আসলে রয়েছেন তার বাবা। আদেশের দাবি, ছেলেবেলা থেকেই বাবা তাকে ভালোবাসতেন না এবং তাঁর ভালোমন্দের জন্যে কেউ কোনও দিনও পরোয়া করেনি।

সকালে দর্জি রাতে আততায়ী

আদেশ ও বিভিন্ন লোকজনকে জেরা করে পুলিশের অনুমান যে দিনের বেলায় আদেশ শান্ত গোবেচারা চেহারা নিয়ে সেলাইয়ের কাজ করত আদেশ। রাত হতেই সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত। পথে ট্রাক চালকদের সঙ্গে আলাপ করে, তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করত। এর পর তাঁদের হত্যা করে তাঁদের সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র চুরি করে নিত।

তার গ্যাংয়ের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে বড় রাস্তার ধারের ধাবাগুলোতে গিয়ে ট্রাক চালকদের সঙ্গে ভাব জমাত আদেশ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ট্রাক চালকদের কাছ থেকে মোবাইল চার্জার চাওয়ার আছিলায় ভাব জমানো শুরু হত। এর পর চালক ও খালাসিদের ওষুধ খাইয়ে খুন করে দেহগুলোকে কোনও পাহাড়ি অঞ্চল বা কালভার্টে ফেলে দেওয়া হত এবং মাল-সহ লরিটিকে বিক্রি করে দেওয়া হত।

body_091618011617.jpgআদেশ খামরা ৩৩জন ট্রাক চালককে খুন করেছে বলে অভিযোগ [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]

আদেশ ও তার দলের প্রত্যেকেই ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে। যারা আদেশের কাছ থেকে মাল-সহ চুরি করা লরিগুলো কিনে নিত এখন তাদের খোঁজ করছে পুলিশ। ধৃতদের জেরা করে জানা গেছে, যে ওষুধগুলো খাইয়ে চালক ও খালাসিদের বেহুঁশ করা হত, সেই ওষুধ যারা সরবরাহ করত তারাই বামাল লরি কিনে নিত।

তদন্তকারী আধিকারিক জানিয়েছেন যে এখনও অবধি ভেঙে পড়ার কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি আদেশের মধ্যে। মারা যাওয়ার আগে তার শিকাররা শেষ কী খাবার খেয়েছিলেন, তাদেরকে ঠিক কোথায় কোথায় আঘাত করা হয়েছিল এবং তাদের দেহ কোথায় কোথায় খালাস করা হয়েছে - এসবের পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে চলেছে আদেশ।

ভোপাল পুলিশ এখন এই মামলাটির গভীরে প্রবেশ করতে চাইছে।

আসুন, এই ফাঁকে দেখে নেওয়া যাক ভারতের কয়েকটি বহু আলোচিত সিরিয়াল কিলারের কথা, এখানে তাদের কথাই বলা হবে যারা গ্রেপ্তার হয়েছিল এবং বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল।

‘কোলের শিশু’ হত্যাকারী দুই বোন 

সীমা গোভিট ও রেণুকা সিন্ধে নামের দুই সৎ বোন হয়ে ভারতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়া প্রথম দুই মহিলা হয়ে উঠতে পারেন।

এদের বিরুদ্ধে ১৩টি শিশুকে অপরহরণ করে এদের মধ্যে ১০টি শিশুকে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছিল। অবশেষে ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট পাঁচটি শিশুকে হত্যার দায়ে এদের দোষী সাব্যস্ত করে।

সীমা ও রেণুকা তাঁদের মা অঞ্জনার দুই স্বামীর দুই সন্তান। স্বামী পরিত্যক্তা অঞ্জনা তার মেয়েদের পকেটমারি ও ছিঁচকে চুরির প্রশিক্ষণ দেয়। চুরির সময় লোকেদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে সীমা ও রেণুকা শিশুদের অপহরণ করত। এদের মধ্যে যে শিশুদের নিয়ে তারা ঝামেলায় পড়ত, তাদের মেরে ফেলত। 

body1_091618011255.jpgসীমা ও রেণুকা তাদের মা অঞ্জনার কাছে ছিচকে চুরির কায়দা রপ্ত করেছিল [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]

একটি ঘটনায় তারা নাকি একটি শিশুকে ইলেক্ট্রিক পোলে আছড়ে ফেলে মাথা ফাটিয়ে তাকে হত্যা করেছিল। অন্য একটি ঘটনায় তারা একটি দুই বছরের শিশুকে টুকরো টুকরো করে তার ছিন্নভিন্ন দেহ ব্যাগে পুরে সেই ব্যাগ নিয়ে অবলীলায় সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখেছিল

কোলহাপুর দায়রা আদালত, বম্বে হাইকোর্ট এমনকি সুপ্রিম কোর্টও এই দুই মহিলাকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে। এর পর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও তাদের ফাঁসির হুকুম রদের আর্জি খারিজ করে দেওয়ার পর এখন নতুন করে আর্জি করা হয়েছে। এই দুই মহিলার আইনজীবীর দাবি, খুনগুলো তাদের মা অঞ্জনা করেছিলেন যিনি মামলা চলাকালীন মারা যান।

দেশের প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার

ভারতের প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার বেঙ্গালুরুর কেডি কেমপাম্মা। ২০১০ সালে ছ'জন মহিলাকে হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে হয়ে ছিল। ২০১২ সালে, তাঁর সাজা মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে আজীবন কারাবাস করা হয়েছিল।

কেমপাম্মা তার শিকারের সন্ধানে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়াত। সন্তানহীন বা দাম্পত্যে কলহে জর্জরিত মহিলারাই তার লক্ষ্য ছিল। শান্ত সরল প্রকৃতির কেমপাম্মা প্রথমে এই মহিলাদের আস্থা অর্জন করে তাঁদের সমস্যার কথা শুনে তাঁদেরকে 'বিশেষ ধরণের' পুজো করার পরমার্শ দিতেন।

body2_091618011417.jpgসায়ানাইড মল্লিকা তথা কেডি কেমপাম্মা দেশের প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]

এই মহিলাদের তিনি তাঁদের বাড়ির থেকে দূরে কোনও মন্দিরে পুজো দিতে ডাকতেন। সেখানে তিনি তাঁদের সায়ানাইড মিশ্রিত পানীয় (এর থেকেই তার নাম সায়নাইড মল্লিকা) খাইয়ে তাঁদের হত্যা করত ও তাঁদের দামি গয়না ও টাকাপয়সা লুঠ করে নিত।

পুলিশের দাবি, কেমপাম্মা বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্য প্রথমে জাল চিট-ফান্ডের ব্যবসা ফেঁদেছিল। সেই ব্যবসা জানাজানি আসার পর সে এই পথ বেছে নেয়।

যে ব্যক্তি ঘৃণার বশে মহিলা খুন করতেন

তিনজন মহিলা হত্যাকারীর গল্পের পর এবার একজন পুরুষ অপরাধীর কথা যে মহিলাদের তীব্র ঘৃণা করতেন।

অনুরাগ কাশ্যপের ছবি রমণ রাঘব ২.০ -- যাকে কেন্দ্র করে তৈরি সেই রামন রাঘব, সে অবশ্য দেশের একজন অন্যতম ধুরন্ধর সিরিয়াল কিলার।

১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ অবধি রমণ রাঘব ৪১জনকে হত্যা করেছে। মৃতেরা সকলেই হয় মুম্বাইয়ের বস্তিবাসী নয়তো ফুটপাথবাসী। শাবল জাতীয় কোনও ধারালো অস্ত্র দিয়ে এদের মাথা থেঁতলে দিয়ে হত্যা করেছিল রমণ। সেই দিনগুলোতে গোটা মুম্বাই জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। গুজবও রটে গিয়েছিল যে ভিনগ্রহের কোনও প্রাণী গভীর রাতে মুম্বাইয়ের রাস্তায় হানা দিয়ে এই খুনগুলো করত। এই প্রাণী নাকি নিজের ইচ্ছে মতো রূপও বদল করতে পারত।

body3_091618011524.jpgশাবল জাতীয় অস্ত্র দিয়ে মাথা থেতলে মহিলা খুন করতেন রামন রাঘব [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]

একবার তো তিনি এক ঘুমন্ত মহিলাকে খুন করে বেশ কয়েকবার মৃত্য মহিলাটিকে ধর্ষণ করে। বেশ কয়েকবার তো সে তার শিকারকে খাবার সময়ে হত্যা করে মৃত্যদেহের পাশে বসেই মৃতে অভুক্ত খাবার খেয়েছে। বাসনপত্র থেকে শুরু করে গলার হার, এমনকি ঘিয়ের শিশি পর্যন্ত, মৃত্যের সবকিছুই সে চুরি করে নিত।

গ্রেফতারের পর সে দাবি করেছিল শিব ঠাকুর তার মনের ভিতরে প্রবেশ করে তাকে এই খুনগুলো করতে নির্দেশ দিত। তার দাবি তিনি শুধু তাঁদেরকেই আক্রমণ করতেন যাঁরা তাঁকে 'মহিলা হয়ে উঠতে' বাধ্য করতেন।

১৯৬৯ সালে দায়রা আদালত রাঘবকে মৃত্যদণ্ডে দণ্ডিত করে ছিল। ১৯৮৭ সালে বম্বে হাইকোর্ট সাজার পরিমাণ কমিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাবাসে দণ্ডিত করে। ১৯৯৫ সালে কিডনির রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এই অপরাধী।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

Comment