আটের দশকের পর মুম্বাই মুভি ও স্থানীয় অবাঙালিদের নকল করতে শুরু করলাম
বাঙালির ঠাকুর ঘরে ঘরে এখন গণেশ, সন্তোষী মা, বালাজি, বজরংবলী
- Total Shares
বাঙ্গালির চিরকেলে বদনাম যে তারা হুজুগে। আসলে ঠিক তা নয়। আত্মীকরণের অভ্যাস বাঙ্গালির চিরকেলে। তাই বাঙালি ঠিক কখন যে কি বুঝে ওঠা খুব মুশকিল। আনেক্তা হাওয়া মোরগের মতো। এক সময়ে বাঙালি কথায় কথায় উধৃতি দিতো “ শয্যা হীনের লজ্জা নাইকো দারিদ্রে নেই ভয়” বা simple living high thinking-র তত্ব। নরুণ পাড় ধুতি আর টুইডের বাংলা শার্ট পড়া মাস্টার মশায় স্কুলে বাচ্চাদের পাখি পড়ার মতো করে বলতেন জীবনের উদ্দেশ্য ধনী হওয়া নয় বরং জ্ঞানী হওয়া। তাই তৎকালীন বাঙালি লক্ষ্মীর সাধনার থেকে সরস্বতীর সাধনায় বেশী গুরুত্ব দিতো।
এতো সারস্বত সাধনা করেও প্রাথমিক ভাবে বোঝে নি শ্রীপঞ্ছমী কথাটার গূঢ় অর্থ। শ্রী অর্থে লক্ষ্মী, তিনিই সরস্বতীর সাধনাকে এগিয়ে নিয়ে যান। গোলমাল ছিলো ভাবনায়। বৈভব আর বৈভবের বাহ্যারম্ভরকে এক করে দেখায় বিশ শতকের আম বাঙালি আর্থিক ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও পিছিয়ে পরেছিলো। উনিশ শতকের কম্প্রাদর
বাঙালি আর দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ের মূলত দালালীর ব্যবসায়ে যুক্ত বাঙ্গালিকে গড়বাঙালি খুব একটা ভালো ছখে দেখত না। হয় বাবু বিলাসী নয় ব্যাটা দালাল- এই ছিল মনোভাব।
দেশ ভাগের পর বাংলার আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দ্রুত পট পরিবর্তন ঘটতে থাকে। যে বাঙালি একদিন পোশাকে আশাকে গৃহসজ্জা আসবাব সবকিছুতে মুঘল আমলকে নকল করতো সেই বাঙ্গালিই রাণীর আমলে বাড়িতে অর্গান বাজিয়ে ‘সেভ দ্য কুইন’ গাইতে শুরু করলো। আটের দশকের পর থেকে এলো নতুন ঝড়। আমরা মুম্বাই মুভি আর স্থানীয় উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয়দের নকল করতে শুরু করলাম পোশাকে আর মিশেল ঘটালাম মুখের ভাষায়। মুখের লব্জ হয়ে গেল ‘আররে ইয়ার’ কিম্বা ‘ইয়ে ক্যায়া হ্যায় ডিয়ার’।
নতুন নতুন দেব দেবীর সংযোজন ঘটেছে- যেমন সন্তোষী মা, বালাজী, বজরংবলী। গণেশ পুজার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং জাঁক জমক এ বছর ছিল লক্ষণীয়। একটু তলিয়ে যদি দেখা যায় তবে দেখবেন লোকমাতা রানী রাসমনির প্রতিষ্ঠিত মা ভবতারিনীর মন্দির চত্তরে গনেশের কোনও আলাদা মন্দির নেই। আছেন মা ভবতারিনী সঙ্গে দ্বাদশ ভৈরব আর শ্রী রাধামাধব। অর্থাৎ বৈষ্ণব, শাক্ত ও শৈব পরম্পরা প্রতিষ্ঠিত কিন্তু গাণপত্য পরম্পরা সে সময়ে বাংলায় শিকড় গাড়তে পারে নি।
বাঙ্গালির চিরকেলে বদনাম যে তারা হুজুগে [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
কালী পুজার অনেক আগে থেকে কুল কাঠ আকন্দ কাঠ যোগাড় করা, সেগুলো থেকে কাঠকয়লা তৈরি করা তারপর কাত্তিক মাস পরতেই পাড়ায় পাড়ায় হামালদিস্তের ঠুকঠাক, ঠনঠন করে হাথ কালি মুখ কালি করা কাঠকয়লা, সোরা গন্ধক লোহাচুর পেতলচূর নানান ভাগের তুবড়ি রংমশাল ছূঁচোবাজিঠাসা বাঙ্গালি, বাঁখারি আঠা আর কাগজ দিয়ে বানানো তেলনুটি আর কর্পূরের ফানুসে বাঙ্গালি আজ প্রায় বিরল। উত্তর কলকাতায় যদিয়ও দু-এক ঘর আছেন। তবে সে সবই বনেদি বাড়ির ক্ষীয়মাণ সাংস্কৃতিক পরম্পরা মাত্র। সে যায়গায় এখন ব্রান্ডপ্রেমী বাঙ্গালি শিবকাশির বাজি ছেড়ে পারলে চিনা বাজিতে মত্ত। আকাশ প্রদীপ আর বাড়ির ছাদে বাঁশের ডগায় জ্বলেনা। মাটির প্রদীপ থেকে মোমবাতি হয়ে এখন চিনে টুনি কালীপুজোর গৃহের আলোকসজ্জায় ন্যাস্ত। তবে হ্যাঁ ফানুস এসেছে ফিরে বহু বহু বছরের পরে, কিন্তু আবারও সেই রেডিমেড, বাজির মতো ঘুড়ির মাঞ্জার মতো। এখন আর কেউ এসে মেশে না।
বাঙালি এখন কালীপুজোর পরেরদিন দীপাবলির শুভেচ্ছা পাঠাতে পছন্দ করে [ছবি: পিটিআই]
কিছুকাল আগেও আম বাঙ্গালি ইংরাজি হরফে শুভ দীপাবলীর শুভেচ্ছা পাঠাতেন এসএমএস-এ। আর এখন স্মার্ট ফনের দৌলতে ইমোজিই যথেষ্ট, কে আর বাক্যব্যয় করে! করলেও Wish You a Happy Dewali আর Same to You-এ সীমায়ীত। না হলে তো অন্যের পাঠানো বার্তা forward করে দিলেও হয়। এখন তো টিভিতে এক বিজ্ঞাপনে দেখছি ভাই বোনে কোথা হচ্ছে দেখলি বাবা আর কাকার দেওয়ালী কেমন হ্যাপি হয়ে গেল। এখন তোর দেওয়ালীও হ্যাপি করে দি?
এখানেই শেষ নয়, উৎসব অনুষ্ঠানে এলো উত্তর-পশ্চিম ভারতের রীত রিশালা, বিয়ের অনুষ্ঠানে ঘটলো নতুন নতুন সংযোজন, এখন হাতে মেহেন্দি পরা হল হাল ফ্যাশন, উত্তর ভারতীয় হিন্দি বিবাহ সঙ্গীত এখন টিভি সিরিয়ালের দৌলতে আমদের বসার ঘর ছেড়ে শোবার ঘরে, বাঙালি সিরিয়ালের রোমান্স এখন হিন্দি গান দিয়ে গাঁথা। আজ থেকে তিন দশক আগেও যে সব অনুষ্ঠানের বা ব্রত পালনের নাম শোনা যেত না এখন ঘটা করে সে সবই পালিত হচ্ছে। ধন্তেরসের ধুম লেগেছে বাঙ্গালির হৃদয়ে। সোনার দোকানে দোকানে লম্বা লাইন। ধন্তেরসে নাকি কিছু সোনা দানা কিনলে নাকি ধনলক্ষ্মীর অপার কৃপা লাভ হয়। সুতরাং শ্রমবিমুখ বাঙ্গালি শ্রম না দিয়ে ধন্তেরসে ধাতু বিশেষত সোনা, রুপার ওপর সোনার জল করা অথবা রুপার কিছু একটা, নিতান্ত সিটি গোল্ডের গয়না কিনে কোন এক বিশেষ যাদুতে লক্ষ্মী দেবীর কৃপা লাভ করার ফন্দী ফিকির করতে শুরু করেছেন। শুনেছি এবছর নাকি কলকাতায় আটা ছাঁকা চালুনির খুব বিক্রি বেড়েছে, কারন হিন্দি ছবিতে আর খবরের কাগজের রঙিন বিজ্ঞাপনে আর খবরে করবা চৌথের ছবি ছাপা হয়েছে। এরপর বাঙ্গালি রমনী যদি সন্তানের কল্যাণে নানা রকম ষষ্ঠীর ব্রতের সঙ্গে সঙ্গে ছট্ পুজা বা স্বামীর কল্যাণ কামনায় করবা চৌথ পালন করেন আশ্চর্য হবার কিছু নেই।