চরমপন্থীদের আঁতুড়ঘর: বালাকোটের সঙ্গে ওয়াহাবি ও মৌলবাদীদের সম্পর্ক বহুযুগের

ইতিহাস সাক্ষী, সন্ত্রাসবাদের মরুদ্যানের সঙ্গে হাফিজ সঈদ-মাসুদ আজহারদের সম্পর্ক নিবিড়

 |  5-minute read |   02-03-2019
  • Total Shares

মৌলানা মাসুদ আজহারের নেতৃত্বধীন জৈশ-ই-মহম্মদ জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘাঁটিগুলোকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের তিনটি জায়গায় অতর্কিতে হামলা চালিয়েছিল ভারতীয় বায়ুসেনা। এই জায়গাগুলোর অন্যতম বালাকোট। ঐতিহাসিক ভাবে বালাকোটের সঙ্গে পাকিস্তান ও ভারতের ওয়াহাবি বা ইসলামী মৌলবাদীদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

প্রায় দু'শতাব্দী ধরেই জৈশ-ই-মহম্মদ ও লস্কর-ই-তৈবার মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর বালাকোট নিয়ে আবেগ রয়েছে। লস্করের প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সঈদের সঙ্গেও বালাকোটের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এক সময় হাফিজ এই অঞ্চলের দরিদ্র মুসলমানদের জন্য একটি সেবাপ্রতিষ্ঠান চালাতেন।

body_030219023121.jpgবালাকোটে আক্রমণ করেছিল ভারতীয় বায়ুসেনা [সৌজন্য: টুইটার]

একটা সময় ছিল যখন দক্ষিণ এশিয়ার ওয়াহাবি নেতাদের অন্যতম আঁতুড়ঘর ছিল এই বালাকোট।

ভারতের বিখ্যাত ওয়াহাবি প্রচারক সৈয়দ আহমেদ বারেলভি এই বালাকোটই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।

১৮৩১ সালে শিখ সম্রাট রণজিৎ সিংয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়ে নিহত হন বারেলভি। সেই যুদ্ধে তাঁরই সঙ্গে তাঁর লেফটেন্যান্ট শাহিদ ইসমাইলও নিহত হয়েছিলেন। এই শাহিদও একজন ওয়াহাবি প্রচারক ছিলেন। তাঁর অনবদ্য লেখার জন্য শুধুমাত্র ভারত বা পাকিস্তান নয়, সৌদি আরবের ওহাবিদের কাছেও বেশ জনপ্রিয় তিনি। এই যুদ্ধটির সময়ে তেহরিক-উল-মুজাহিদিন নামের একটি গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বারেলভি এবং তিনি নিজে ওয়াহাবিদের আমির-উল-মমিন (বিস্বস্ত নেতা) ছিলেন।

body1_030219023529.jpgলস্কর-ই-তৈবার নেতা হাফিজ সঈদের সঙ্গে বালাকোটের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে [ছবি: রয়টার্স]

মৌলবাদী ইসলামে বিশ্বাসী একটি পরিবারে জন্ম হয়েছিল শাহ ইসমাইলের। তাঁর প্রপিতামহ ধর্মান্ধ মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের উপর ফতোয়া-এ-আলমগিরি নামের একটি ধর্মীয় বই রচনা করেছিলেন। বইটিতে মূলত ঔরঙ্গজেবের কোরান নিয়ে বিশ্লেষণ করা একটি ধারাভাষ্য তুলে ধরা হয়েছে। ইসমাইলের ঠাকুরদা ছিলেন স্বনামধন্য ইসলামী প্রচারক শাহ ওয়ালিউল্লাহ। মুঘল সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে ছিল সেই মারাঠি ও জাঠদের মতো 'কাফিরদের' পরাস্ত করতে ১৭৫৯ সালে আহমেদ শাহ আবদালিকে ভারত আক্রমণ করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন এই ওয়াহিউল্লাহ। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল, গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করা।

ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলন প্রতিষ্ঠানের অন্যতম হোতা এই বারেলভি ও ইসমাইল। এমনকি ব্রিটিশ রেকর্ডে বারেলভিকে 'সৈয়দ আহমেদ বারেলভি ওয়াহাবি' বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। মক্কা ও মদিনা দর্শনে গিয়ে সেখানকার মূলস্রোতের ওয়াহাবি নেতাদের সান্নিধ্যে এসে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল বরেলভি। এর পর ভারতে ফিরে তিনি ওয়াহাবি প্রচার শুরু করে দেন।

ইসমাইল বারেলভিকে নিজের ধর্মীয় গুরু হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত এই গুরু-শিষ্যের মধ্যে অভিন্ন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ ইসমাইলের লেখার অন্ধ ভক্ত ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহরুও ইসমাইলের লেখার ভক্ত ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, স্বাধীনতা ও দেশভাগের ঠিক পূর্বের গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলোতে (১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫) জওহরলাল কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন।

ইসমাইলের বই তাকিয়ত-উল-ইমান-এ (বিশ্বাসের ভিত্তি মজবুত করা) সুফি আন্দোলন ও অ-ইসলামীয় ধর্মগুলোর রীতিনীতিগুলোকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে। গত দেড়শো বছর ধরে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে এই বইটিকে পাঠ্য পুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মনে করা হয়, মাদ্রাসাগুলোর পড়ুয়াদের মৌলবাদী করে তোলার উদ্দেশ্যেই এই বইটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

body2_030219023646.jpgইসমাইলের লেখা এই বইটি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে অবশ্য-পাঠ্য

বালাকোট যুদ্ধে শিখ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রণজিৎ সিংয়ের পুত্র কুনওয়ার শের সিং যিনি পরবর্তীকালে কিছুদিনের জন্য শিখ সম্রাট হয়েছিলেন। যুদ্ধের শেষে বরেলভির দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইসমাইলকে অবশ্য বালাকোটে সমাহিত করা হয়েছিল।

বালাকোটে ইসমাইলের সমাধি আজও রয়েছে।

body3_030219023741.jpgবালাকোটে ইসমাইলের সমাধি আজও রয়েছে [সৌজন্য: উইকিম্যাপিয়া কমন্স]

উত্তরপ্রদেশের বরেলির বাসিন্দা বরেলভি ভারত ত্যাগ করে ব্রিটিশ ও শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার উদ্দেশ্যে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে (বর্তমানে খাইবার-পাখতুনিস্তান) গিয়েছিলেন। আর, সেই কারণেই শিখদের সঙ্গে বালাকোট যুদ্ধের সূত্রপাত।

বরেলভির মূল লখ্য ছিল সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করা। অন্যান্য ওয়াহাবিদের মতোই তিনিও বিশ্বাস করতেন যে সম্রাট আকবরের উদারমনষ্কতার জন্য ভারতে বিশুদ্ধ ইসলাম দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে, সেই সময়ে তিনি ব্রিটিশদেরই এক নম্বর শত্রু বলে মনে করতেন। এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তিনি তৎকালীন হিন্দু ও মুসলমান রাজাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যথোপযুক্ত সমর্থন আদায় করতে না পেরে তিনি পাখতুনিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হন।

সেখানে তিনি সর্বপ্রথম তাঁর বন্ধু তথা পাঠান নেতা আমির খান পিণ্ডারির সাহায্য চান। কিন্তু ব্রিটিশ আমির খানকে টঙ্ক-এর শাসক করে দেওয়ায় তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যেতে রাজি হননি।

এর পর গোয়ালিয়রের মারাঠি রাজা মহারাজা দৌলত রাও সিন্ধিয়ার নিকট আত্মীয় রাজা হিন্দুরাও ঘাটগের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন বরেলভি। কিন্তু তিনিও বরেলভিকে সাহায্য করতে অস্বীকার করেন। উল্লেখ্য, দিল্লিতে অবস্থিত বড়া হিন্দুরাও হাসপাতালের বাড়িটি একদা এই হিন্দুরাও ঘাটগের রাজপ্রাসাদ ছিল।

বরেলভি যখন সীমান্ত প্রদেশে পৌঁছালেন তখন সেই অঞ্চলের উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকজন তাঁকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তারা তাঁকে তাদের ধর্মীয় নেতা হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁকে তাদের আমির-উল-মমিনের সম্মান দিয়েছিলেন। সেখানে সিত্তানা বলে একটি জায়গায় বসবাস করতেন বরেলভি এবং এক ভয়াবহ ওয়াহাবি আচারে তিনি নির্লিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। এই আচার মেনে সুফি প্রচারকদের ধরে ধরে কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। এর কারণ ওহাবিদের কাছে সুফি আন্দোলন নিষিদ্ধ। ওহাবিরা মনে করেন সুফিরা হিন্দু ধর্মের রীতি মেনে গুরু পুজো করেন।

সেই সময়ে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠানরা লোকসঙ্গীত বেশ পছন্দ করতেন। লোকসঙ্গীত তাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ওয়াহাবি প্রচারক হিসেবে লোক গায়কদের শাস্তি দিতেন বরেলভি ও তাঁর ভক্তরা। এর ফলে, খুব শীঘ্রই সেই অঞ্চলের পাঠানরা তাঁকে ঘৃণা করতে শুরু করে দেন।

body4_030219023949.jpgপ্রথমে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের উপজাতিরা বরেলভিকে স্বাগত জানালেও, পরে তাঁর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে [ছবি: রয়টার্স]

একটা সময়ে সেই অঞ্চলের পাঠানদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তিনি হাজার পাঁচেক শিষ্যকে সঙ্গে নিয়ে কাশ্মীরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে থাকার সময়তেই শিখদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন বরেলভি। আর তাই তিনি শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। ১৮৩১ সালে উত্তরপশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ থেকে ফেরার সময়ে বালাকোটে শিখ বাহিনির মুখোমুখি হন তিনি। মাত্র কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পরেই তিনি ও তাঁর লেফটেন্যান্ট নিহত হন।

আজ দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে যে মৌলবাদী ইসলামের প্রচলন ঘটেছে তার জন্য ওয়াহাবি প্রচারক বরেলভি ও ইসমাইলকেই দায়ী করা হয়ে থাকে।

তাঁরা যেহেতু 'জিহাদ' করতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন তাই তাঁদেরকে ওয়াহাবি বিশ্বে আলাদা আসনে রাখা হয়েছে। ওয়াহাবিদের কাছে ইসমাইল 'পবিত্র' কারণ তিনি শুধুমাত্র তলোয়ার নয়, নিজের কলম দিয়েও ইসলাম ধর্মের প্রচার করেছিলেন।

আর এই কারণগুলোর জন্যেই ওয়াহাবি এবং সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে বালাকোটের নিবিড় সম্পর্ক বা যোগাযোগ রয়েছে।

বর্তমানে যখন কর্তারপুর সাহেব গুরুদ্বার খুলে দিয়ে 'খলিস্তানের' নামে পাকিস্তান শিখদের মন জয় করতে চাইছে, তখন ইতিহাসের পাতায় ১৮৩১ সালের বালাকোট যুদ্ধ অন্য কথা বলছে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

UDAY MAHURKAR UDAY MAHURKAR @udaymahurkar

The writer is deputy editor, India Today.

Comment