এক হাতেই ব্যাট করলেন তামিম ইকবাল: বিশ্ব ক্রিকেটের কয়েকটি সাহসিকতার গল্প
শুধু ব্যাটে বলে লড়াই নয়, এই ঘটনাগুলও তো ক্রিকেট লোকগাথার জন্ম দিয়েছে
- Total Shares
পারফর্ম্যান্সের বিচারে বিশ্বক্রিকেট তামিম ইকবালকে কী ভাবে মনে রাখবে তা বিচার করার সময় এখনও আসেনি। তবে সাহসিকতার বিচারে বাংলাদেশের ওপেনার ইতিমধ্যেই ক্রিকেট ইতিহাসে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন।
দুবাইয়ে এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারে সুরঙ্গা লাকমানের বলে বাঁ-হাতের কব্জিতে চোট পান তিনি। পরীক্ষায় ধরা পড়ে তাঁর কব্জিতে চিড় ধরেছে। কিন্তু বাংলাদেশের নবম উইকেটের পতনের পরেই, শেষ উইকেটে, মুশফিকুর রহিমকে সঙ্গ দিতে মাঠে নেমে পড়েন তামিম। এক হাতে ব্যাট করে শেষ উইকেটে মুশফিকুরের সঙ্গে জুটি বেঁধে ৩২ রান যোগ করেন। তামিমের এই সাহসী মানসিকতা, দেশের জন্য কিছু করে দেখাবার অদম্য জেদকে কুর্নিশ জানিয়েছে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব।
সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তামিম ইকবাল [সৌজন্যে: টুইটার]
চোটাঘাতের তীব্র যন্ত্রণা সত্ত্বেও দেশের হয়ে খেলতে নামার কয়েকটি উদাহরণ এর আগেও রচিত হয়েছে।
আসুন, সেই সাহসী ইনিংসগুলোর উপর আর একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
ম্যালকম মার্শাল [বনাম ইংল্যান্ড (১৯৮৪)]
ভারতের মতো বিশ্বক্রিকেটের দুধের শিশুর কাছে ১৯৮৩র বিশ্বকাপ ফাইনালের হারের বেদনা তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৮৪ সালের ইংল্যান্ড সফর। আর হেডিংলি টেস্টের প্রথম দিনেই বুড়ো আঙ্গুল ভেঙে বসলেন দলের দীর্ঘদেহী পেস বোলার ম্যালকম মার্শাল।
সেই টেস্টে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড ২৭০ রান তুলেছিল। জবাবে ভালোই ব্যাট করছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, টপকে গিয়েছিল ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসের স্কোর। ওয়েস্ট ইন্ডিজের নবম উইকেট যখন পড়ল তখন গোমস ৯৬ রানে অপরাজিত। দুই দলের খেলোয়াড় ও সমর্থকরা মোটামুটি নিশ্চিত যে গোমসকে ৯৬ রানে অপরাজিত থেকেই প্যাভিলিয়নে ফিরতে হবে। ন'উইকেটেই শেষ হয়ে যাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস।
এক হাতে ব্যাট করছেন ম্যালকম মার্শাল
সেই সময় সকলকে অবাক করে দিয়ে মাঠে নামলেন ম্যালকম মার্শাল। মাটি কামড়ে এক হাতে ব্যাট করলেন এবং আউট হওয়ার আগে গোমসের শতরানটা নিশ্চিত করে দিলেন। এখানেই শেষ নয় ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর সময় দেখা গেল লাল বল হাতে ব্যাটসম্যানের উল্টো প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন ম্যালকম মার্শাল। ভাঙা বুড়ো আঙ্গুল নিয়ে ভেলকি দেখালেন তিনি। সেই ইনিংসের ১০টির মধ্যে সাতটি উইকেটই তো ম্যালকম মার্শালের ছিল।
সচিন তেন্ডুলকর [বনাম পাকিস্তান (১৯৯৯)]
তখনও তাঁর বয়স ১৭ পূর্ণ হয়নি। দেশের হয়ে অভিষেক সিরিজ খেলেছেন চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাও, আবার পাকিস্তানের মাটিতে সবুজ উইকেটে। উল্টোদিকে, ইমরান খান-ওয়াসিম আক্রম -ওয়াকার ইউনিস সমৃদ্ধ ত্রিফলা পেস আক্রমণ। তবে দমে যাওয়ার বান্দা তিনি নন। সিরিজের তৃতীয় টেস্টেই ৫৯ রানের একটি ঝকঝকে ইনিংস খেলে ফেলেছেন। তবে সিরিজের স্মরণীয় ঘটনাটি ঘটেছিল চতুর্থ টেস্টে।
সেই টেস্টে সচিন তেন্ডুলকর যখন ব্যাট হাতে নামলেন তখন মাত্র ৩৮ রানে চার উইকেট হারিয়ে ফেলেছে ভারত। ক্রিজে রয়েছেন নভোজ্যোৎ সিং সিধু। সবুজ উইকেটে পাক পেসারদের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি ভারতের রাঘব বোয়াল ব্যাটসম্যানরা। এই তেন্ডুলকর তো কোন ছাড়।
যেমনটা ভাবা গিয়েছিল তেমনটাই হল। পাক বোলাররা ঠিক করেই রেখে ছিলেন কোনও রকম রেহাই করা হবে না ভারতের বছর ষোলোর কিশোরকে। ওয়াকারের বাউন্সারের পেসটা ঠিক মতো আঁচ করতে পারলেন না সচিন। সোজা গিয়ে লাগলো তাঁর নাকে। ছুটে এলেন ফিজিও। নন স্ট্রাইকার এন্ড থেকে দৌড়ে গেলেন সিধু। সচিনের নাক দিয়ে গলগল করে রক্তপাত হচ্ছে।
কিন্তু সচিন দমবার পাত্র নন। প্রাথমিক শুশ্রুষার পর উঠে দাঁড়ালেন। ভাঙা হিন্দিতে বললেন, "মে খেলঙ্গা"। গোটা মাঠে আতঙ্কে রয়েছে পরের বলে কী হয়। টিভির পর্দার সামনে একই অবস্থা আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে। সচিন খেললেন। ওয়াকারের ওভার পিচ বলটা নিখুঁত ডাইভে সীমানার বাইরে পাঠালেন।
বল সীমানা পেরোনোর আগেই অবশ্য তামাম ক্রিকেট বিশ্ব বুঝে গিয়েছিল যে এক নতুন তারকার জন্ম হল।
অনিল কুম্বলে [বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২০০২)]
২০০২ সালের ভারতের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। অ্যান্টিগা টেস্টে ব্যাট করতে গিয়ে মার্ভিন ডিলনের বলে থুতনিতে চোট পেলেন অনিল কুম্বলে। কিন্তু রক্ত মুছে আবার ব্যাট করতে শুরু করে দিলেন। তাও এমন ভঙ্গিমায় যে দেখে শুনে মনে হচ্ছিল চোটের কোনও লক্ষণই নেই। দিনের শেষে ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেল কুম্বলের থুতনিতে চিড় ধরেছে এবং তাঁকে অবিলম্বে দেশে ফিরতে হবে অস্ত্রোপচারের জন্য।
অস্ত্রোপচার পরে হবে, আগে দেশসেবা [ছবি: এএফপি]
কিন্তু পরের দিন সকালে বিশ্ব ক্রিকেট দেখল গলা থেকে মাথা অবধি ব্যান্ডেজ বাধা কুম্বলে সতীর্থদের সঙ্গে মাঠে নামছেন। ১৪ ওভার বল করে ব্রায়ান লারার মূল্যবান উইকেটটি সেদিন তুলে নিয়েছিলেন তিনি।
দেশের স্বার্থে, নিজের চিকিৎসার থেকে দলের প্রয়োজনটাকেই সেদিন প্রাধান্য দিয়ে ছিলেন বেঙ্গালুরুর লেগ স্পিনার।
গ্যারি কার্স্টেন [বনাম পাকিস্তান (২০০৩)]
২০০৩ সালের পাকিস্তান সফরের সময় তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিলেন গ্যারি কার্স্টেন। ভালই খেলছিলেন। অর্ধশতরানটাও পূরণ করে ফেলছিলেন।
কিন্তু ৫৩ রানে ব্যাট করার সময় ঘটে গেল ছন্দপতন। শোয়েব আখতারের বাউন্সার সরাসরি কার্স্টেনের মুখে এসে লাগলো। মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। এক্স-রে রিপোর্টে জানা গেল যে নাকে চিড় ধরেছে তাঁর।
ভাঙা নাক নিয়েই খেলে গেলেন গ্যারি কার্স্টেন [ছবি: রয়টার্স]
দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় ইনিংসে একটা সময় মনে হচ্ছিল যে পাকিস্তান এই ম্যাচ সহজেই জিতে যাবে। কিন্তু চতুর্থ উইকেটের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই কার্স্টেন আবার মাঠে। আরও ৪৬ রান যোগ করে ৯৯ রানে আউট হয়েছিলেন কার্স্টেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ত আট উইকেটে ম্যাচটা হেরেছিল, এক রানের জন্যে হয়ত শতরান পাননি কার্স্টেন। কিন্তু কার্স্টেনের এই সাহসী ইনিংস বিশ্ব ক্রিকেটে পাকাপাকি নাম লিখিয়ে ফেলেছে।
আবার সচিন তেন্ডুলকর [বনাম কেনিয়া (১৯৯৯ বিশ্বকাপ)]
চোটাঘাতের যন্ত্রণা মানে শুধুমাত্র শারীরিক যন্ত্রণা নয়। মানসিক যন্ত্রণাও বটে। বিশ্ব ক্রিকেটে এমন উদাহরণও রয়েছে যেখানে একজন ক্রিকেটার তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মাঝেও দেশের হয়ে খেলতে নেমে চূড়ান্ত ভাবে সফল।
৯৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর বসে ছিল ইংল্যান্ডে। গ্ৰুপ পর্যায়ে ভারতের দ্বিতীয় ম্যাচে ভারত যখন জিম্বাবোয়ের কাছে দ্বিতীয় ম্যাচে হারল তখন সচিন তেন্ডুলকর মুম্বাইতে। পিতা রমেশ তেন্ডুলকরের অন্ত্যেষ্টিতে। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে হেরেছিল। বিশ্বকাপে টিকে থাকতে হলে, মানে পরবর্তী রাউন্ডে যেতে হলে, ভারতকে পরের তিনটে ম্যাচেই জিততে হবে। মোটেও সহজ কথা নয়। কারণ উল্টোদিকে তখন কেনিয়া, তৎকালীন (আগের বারের) বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা ও ঘরের মাঠের ইংল্যান্ড।
সচিন কি দেশের জন্যে আবার ইংল্যান্ডে ফেরত আসবেন? গোটা ভারত তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সেরে সচিন ফিরলেন ইংল্যান্ডে। ব্রিস্টলে কেনিয়ার বিরুদ্ধে খেলবেন বলে।
শতরানের পর আকাশে নিজের বাবাকে খুঁজে ছিলেন সচিন [ছবি: রয়টার্স]
'ফিরলেন' বা 'খেলবেন' বললে কম বলা হবে। সচিন তেন্ডুলকর সেদিন ১৪০ রানের এক রাজকীয় ইনিংস খেলে সেই বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের মোমেন্টামটাই বদলে দিয়ে ছিলেন। শতরানের পর সচিনের সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবাকে খোঁজার ছবিটা তো ক্রিকেট যতদিন থাকবে ততদিন ক্রিকেট সমর্থকদের মনে গেঁথে থাকবে।
ব্যাটে বলের লড়াইয়ের থেকেও এই ঘটনাগুলোই তো ক্রিকেটকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে, ক্রিকেট নিয়ে লোকগাথার জন্ম দিয়েছে। এক মহান ক্রিকেট লিখিয়ে তো তাই একবার লিখে ছিলেন 'স্কোরবোর্ড একটা অর্থহীন বস্তু'।