নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই আরাবল্লীকে বাঁচিয়ে রাখা একান্ত জরুরি
শুধু সৌন্দর্যের জন্য, দেশের রাজধানীকে বাঁচাতেই দরকার আরাবল্লী
- Total Shares
বিশ্বের যত সুন্দর জিনিষস রয়েছে, সে সবের পরিবর্ত সম্ভব।
তবে উল্টোদিকে এমন অনেক জিনসই রয়েছে যেগুলোর কোনও পরিবর্ত হতে পারে না, নিজস্বতা ও সত্ত্বার বিচারে যে সব জিনিস সত্যিই অনন্য, এমন কোনও জিনিস সার শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে, আভিজাত্য রয়েছে, বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। উত্তর ভারতের আরাবল্লী যে অসাধারণ সুন্দর, তা নয়। পূর্ব হিমালযের মতো এই পর্বতে নামী-দামি নানা ধরনের অর্কিড আছে বা বহু রকম গাছগাছালি পাওয়া যায়, এমনও নয়। আবার পশ্চিম হিমালয়ের মতো এখানে রডোডেনড্রনও পাওয়া যায় না। পশ্চিমঘাট পর্বতের এখানে তেমন ভাবে জীববৈচিত্র্য দেখা যায় না। সাদা চোখে বলা যেতে পারে, এই পাহাড়ের পরিবর্তে অন্য কিছু ভাবা যেতেই পারে, তার উপরে এই পাহাড় আবার ঊষর ও শুষ্ক।
তবে আরাবল্লীর এমন কতকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে কোনও ভাবেই যার কোনও পরিপূরক হতে পারে না – এই পর্বতই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরগুলোকে রক্ষা করে মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাওয়ার হাত থেকে।
জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের (ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন বা এনসিআর) শক্তিকেন্দ্রগুলোয় জলের জোগান সুনিশ্চিত করে এবং এটি দেশের একমাত্র মরুভূমি থরের পাশে খাড়া হয়ে রয়েছে। এই পর্বতই আমাদের রক্ষা করে বিশ্বজুড়ে হয়ে চলা উষ্ণায়ন থেকে। যখন সারা বিশ্ব পরিবেশ রক্ষার জন্য সমবেত হচ্ছে – বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ, মিছিল ও আন্দোলন হচ্ছে, সম্প্রতি শিশুরাও যে আন্দোলনের পুরোভাগে থেকেছে – তখন আমাদের একটা ব্যাপার বুঝতে হবে: পরিবেশের জন্য লড়াই করা মানে শুধুমাত্র মেরুপ্রদেশগুলোর বরফের আস্তরণ গলে যাওয়ার বিরুদ্ধে নয়। এর মানে সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে যাওয়া ও হিমাবাহ নিঃশ্বেস হয়ে যাওয়ার মতো সুদূরপ্রসারী বিষয়গুলো নয়। এটা কোনও একজন ব্যক্তিবিশেষ বা কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি নয় যে এ নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করার কোনও কারণ নেই।
দুটি গ্রে ফ্র্যাঙ্কোলিন, স্থানীয় ভাবে যাদের তীতার বলা হয়, তারা আরাবল্লীতে জল খেতে আসে। (ছবি: নেহা সিনহা)
তার বদলে বলতে পারি, সর্বত্র আবহাওয়া বদলাচ্ছে – আর আমরা যে শহরে বসবাস করি এটা সেই শহরের সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তন রোধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পন্থাটি হল – যেগুলি প্রযুক্তিগত ভাবে সমাধানকারীরা নজর করেন না – তা হল স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রকে আবার ফিরিয়ে আনা। শুষ্ক, উত্তপ্ত, ধূলিময় উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চল – যেখানে গ্রীষ্মকালে মাত্রাছাড়া গরম পড়ে আর শীত মানেই হাড়কাঁপানো ঠান্ডা -- সেখানে এই চরম আবহাওয়ার মতো করে অভিযোজন হওয়া গাছপালা রয়েছে যারা স্থানীয় ভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে – এদের কোনও পরিপূরক হয় না। যেমন তমাল গাছ, তার কণ্টকময় কাণ্ড এবং বিষময় কমলা ফল, শুষ্কতম গ্রীষ্মের যে গাছ শ্যামল থাকে। কদম গাছের কথাও ধরতে পারেন, এর ফুলগুলো হয় একেবারে বলের মতো গোল। ধউ ও শিরিষের মতো গাছও রয়েছে এই তালিকায়, যে গাছের ফুলগুলোকে অনেকটা মেক-আপ বক্সে থাকা তুলির মতো দেখতে হয়। পলাশের মতো ধীরে ধীরে বৃদ্ধি হয় এমন গাছ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে শিমূলের মতো তাড়াতাড়ি ফুল ধরে এমন গাছও। কোটরে ভরা জাল গাছও আছে যে গাছ কটকটে রোদ উপেক্ষা করে সাবলীল ভাবে বেঁচে থাকতে পারে।
লেবুরঙের শিমূল গাছে কালো চিল। (ছবি: নেহা সিনহা)
এই গাছগুলোর বদলে এবার দুবাইয়ে যে খেজুর ও তাল জাতীয় গাছ দেখা যায়, সেই গাছের কথা ভাবুন এবং দেখবেন যে গাছটা বাড়ছে ঠিকই কিন্তু এলাকাটি বাড়ছে না, তারা কেউই আরাবল্লীর এই কঠিন বাস্তুতন্ত্রের সাপেক্ষে উপযুক্ত ভাবে কাজ করতে পারবে না।
এদের মাধ্যমেই এই পাহাড়গুলি নিরাপদে রয়েছে – যেমন হালকা ঠান্ডা ও তুলনায় অনেকটা উঁচুতে অবস্থিত, এই জায়গার যে এমন কিছু থাকতে পারে তা মনে হয় না – মাউন্ট আবু; আবার সরিস্কা ব্যাঘ্র প্রকল্প যেখানে বাঘেরা বেশ ভালো রয়েছে; দিল্লিতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া পুরোনো বনাঞ্চল। এই সব জায়গায় রয়েছে চিতাবাঘ, নানা ধরনের পাখি যারা মূলত মাটিতে হেঁটে বেড়ায়, গাছের ছায়া যেখানে গভীর সেখানে জন্মানো ফুল, আর সমতলের ব্যাপ্তির কাছে ক্রমেই হারিয়ে যেতে থাকা ভৌগোলিক ঐতিহ্য।
কাসিকা ফিস্টুলা (সোদার বা কর্ণিকা গাছ) এমন একটি গাছ যেটি আরাবল্লীর পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। (ছবি: নেহা সিনহা)
এবার দেখুন এই ঐতিহ্যের সঙ্গে কী ঘটছে।
একটি নয়, আরাবল্লী ধ্বংস করা নিয়ে দু’-দু’টি আদালত উদ্বেগ করেছে। খনির জন্য আরাবল্লীর ৩১টি পাহাড় ধ্বংস হয়ে যাওয়া নিয়ে গত বছর আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। পাহাড় ধ্বংস করা নিয়ে আদালত বার বার সতর্ক করলেও তাতে কেউ কর্ণপাত করেনি। রিয়েল এস্টেট সংস্থা ও অন্যদের জন্য আরাবল্লীকে আরও মুক্ত করে দিতে এই বছরের গোড়ায় পঞ্জাব ল্যান্ড প্রিজার্ভেশন অ্যাক্ট সংশোধন করে হরিয়ানা সরকার – ওই সংশোধনীর জন্য হরিয়ানা সরকারকে তীব্র ভাবে ভর্ৎসনা করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল বা জাতীয় পরিবেশ আদালত, মানে আরও একটি আদালত ফরিদাবাদ জেলায় আরাবল্লীকে বনাঞ্চল বলে গন্য করার নির্দেশ দেয়। আবাসন প্রকল্পের জন্য দু’দিনে ৭,০০০ গাছ কেটে ফেলে পরে এক উদ্বিগ্ন ব্যক্তি এ নিযে মামলা করেছিলেন।
শিরিষ গাছে একটি বসন্তবৌরী পাখি। এই গাছটি শুষ্ক ও উষ্ণ অঞ্চলের উপযোগী। (ছবি: নেহা সিনহা)
আদালত এবং এই বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকজন এখন পাহাড়ের ব্যাপারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ফরিদাবাদের মামলায় জুড়ে গিয়েছিল বনবিভাগের বিভিন্ন কর্তার নাম, কিন্তু যেটা সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার তা হল প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্রমেই আবাসনে পরিণত হওয়ার জন্য বিশ্বের অন্যতম প্রাচীনতম পর্বতশ্রেণীকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে ক্ষতির মাত্রা যাই হোক না কেন, তাতে আবাসন সংস্থা, খনি সংস্থা ও বিধায়ক-সাংসদদের কিছু যায়-আসে না, তারা নিজের মতো করে লাগামছাড়া ভাবে প্রকল্প রূপায়ণ করে যাবে।
নির্বাচনী জয়ের দৌড়ে হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের কোনও গুরুত্ব নেই, যদি থাকে তা হলে গুরুত্ব আছে নগদ ও টেন্ডারের। আমাদের দায়িত্ব হল নিজেদের শিক্ষিত করে তোলা এবং আমাদের জলবায়ুর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। এখন আমাদের বলা উচিত – নো আরাবল্লী, নো ভোট।
আমাদের নিজেদের স্বার্থেই আমাদের এগোতে হবে দীর্ঘদিন ধরে যেটি অবহেলার শিকার, ত দিকে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে