মণিপুরে কারও কার্ডের তথ্য চুরি হল, কিছু না জেনে আপনি হাজতে
নগদে ফোন রিচার্জ করেও থানায় হাজিরা দিতে হয়েছিল নিরপরাধ কয়েকজনকে
- Total Shares
২০০৮ সালের ঘটনা। মিজোরাম থেকে বছর কুড়ির দুই তরুণ চাকরির ইন্টারভিউ দিতে কলকাতা বিমানবন্দরে নেমেছিলেন। কিন্তু বিমানবন্দরে নেমে তাঁদের মাথায়, যাকে বলে, বিনা মেঘে বজ্রপাত। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থানার পুলিশ ও সিআইএসএফের যৌথ বাহিনী তাঁদের পাকড়াও করে থানায় নিয়ে গেলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হল। চাকরি ইন্টারভিউ তো দেওয়া হলই না, উপরন্তু দিন ছ'য়েকের মতো শ্রীঘরে কাটাতে হল তাঁদের।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো তাঁরা শুনলেন তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁরা নাকি কোনও একজন কলকাতার বাসিন্দার ক্রেডিট কার্ডের তথ্য হাতিয়ে আইজল-কলকাতা ফিরতি বিমানের টিকিট কেটেছেন।
এই প্রথমবার তাঁদের কলকাতায় আগমন, কস্মিনকালে কলকাতার কোনও বাসিন্দার সঙ্গে কোনও দিনও সাক্ষাৎও হয়নি... তবে নিজেদের হয়ে বেশ কিছু সওয়াল করে কোনও লাভ হয়নি। তাঁদের সব প্রচেষ্টাই বৃথা গিয়েছিল সেদিন। কোনও ভাবেই তাঁরা তদন্তকারী পুলিশ অফিসারদের মন ভেজাতে পারেননি। ঠিক কী হয়েছিল সেদিন, যে জন্যে বিনা অপরাধে দুই কিশোরকে ছ'দিন ধরে বিমানবন্দর থানার লকআপে আটক থাকতে হয়েছিল?
এর উত্তর খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে আরও দিন দুয়েক আগে। দিনটা রবিবার ছিল। বেহালার বাসিন্দা জনৈক ব্যবসায়ী মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে সবে মাত্র দিবানিদ্রায় মগ্ন হবেন হবেন করছেন, হঠাৎ তাঁর সেলফোনে বার্তা ঢুকল। তিনি যে সংস্থার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন, সেখান থেকে বার্তা পাঠিয়ে জানানো হয়েছিল কোনও এক ট্রাভেল এজেন্সিকে প্রায় ২১,০০০ টাকা দেওয়া হয়েছে তাঁর ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে।
প্রতারককারীরা প্রতারিত টাকা ব্যবহার করবার সময় অন্য কাউকে হাতিয়ার করে থাকেন
প্রথমে বেহালা থানা ও পরে বিমানবন্দর থানায় মামলায় রুজু করেন তিনি। প্রথমে, এই ট্রাভেল এজেন্সির ঠিকুজি কুষ্ঠি খুঁজে পেতে সমস্যা হচ্ছিল পুলিশের। কিন্তু টাকার পরিমাণ দেখে সন্দেহ হয় যে এই টাকায় খুব সম্ভবত বিমানের টিকিটই কাটা হয়েছে। তাই বিমানবন্দর থানার অফিসাররা এবার বিমান সংস্থাগুলোতে তদন্ত শুরু করলেন। তদন্তে জানা গেল ওই ট্রাভেল এজেন্সিকে এয়ার ডেকান তাদের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পরিষেবা সামলানোর জন্য নিয়োগ করেছিল। সেই এজেন্সির মাধ্যমেই ওই দুই বছর কুড়ির যুবক আইজল-কলকাতার ফিরতি বিমানের টিকিট কেটেছিলেন। কলকাতা বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের তাই গ্রেফতার করা হয়েছিল।
কিন্তু জেরা চলাকালীন ও পরবর্তী পর্যায়ের তদন্ত চলাকালীন পুলিশের মনে হয়েছিল এই দুই যুবক সত্যি কথাই বলেছেন। এই দুই যুবকের দাবি ছিল যে তাঁরা নগদ টাকা দিয়েই টিকিট কেটেছিলেন। আলাদা করে রশিদ চাননি, কারণ যে পরিমাণ অর্থ তাঁরা দিয়েছিলেন সেই পরিমাণের কথা টিকিটে উল্লেখ আছে। টিকিটে অবশ্য লেখা ছিল যে কার্ডের মাধ্যমে এই টিকিট কাটা হয়েছিল। যুবকরা জানিয়েছিলেন যে তাঁরা সেই বিষয়টি খেয়াল করেননি।
আরও একটি কারণে পুলিশের মনে হয়েছিল যে এই দুই যুবক সত্যি কথা বলছেন। বিমান সংস্থার তরফ থেকে জানানো হয়েছিল যে কার্ড সোয়াপ করে এই টিকিট কেনা হয়নি। হয়েছিল অনলাইন ট্রানজ্যাকশনের মাধ্যমে। সাধারণত কোনও ক্রেডিট কার্ড উপভোক্তা যদি নিজে থেকে অনলাইনে কিছু কেনেন তাহলে তিনি অনলাইন ট্রানজ্যাকসন করে থাকেন। কিন্তু দোকানে গিয়ে যদি কিছু কেনেন তাহলে কার্ড সোয়াইপ করে কেনেন। এক্ষেত্রে অবশ্য তা ঘটেনি।
জামিনে মুক্ত হয়ে আইজল ফিরে যান দুই যুবক। এর মাস খানেক বাদে গুয়াহাটি থেকে আটক করা হয় ওই ট্রাভেল এজেন্সির মালিককে। জেরায় তিনি স্বীকার করে নেন যে ওই দুই যুবক নগদ পয়সা দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কাছে ওই ক্রেডিট কার্ডের তথ্য থাকায় তিনি ওই তথ্য ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ডে টিকিটটি কিনেছিলেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বেহালার ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ক্রডিট কার্ডের তথ্য উত্তরপূর্বাঞ্চলে পৌয়ে গেল কী ভাবে?
সেই সময় ওটিপির সুবিধা সব ব্যাঙ্কে চালু হয়নি। অনলাইন ট্রানজাকসনের ক্ষেত্রে মাত্র চারটে তথ্য লাগত অ্যাকাউন্ট নম্বর (ক্রেডিট কার্ডের), এক্সপায়ারি ডেট, সিভিভি নম্বর (যা কার্ডের পিছনে থাকে) ও কার্ড ব্যবহারকারীর জন্মের তারিখ। তদন্তে উঠে এল যে মাস খানেক আগে অন্য কোনও ব্যাঙ্কের কর্মচারী হিসেবে একজন এই ব্যবসায়ীর বাড়িতে এসেছিলেন সেই ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। আবেদনপত্রের এক জায়গায় আবেদনকারীর পুরনো কার্ড থাকলে তার নম্বর ও কোন ব্যাঙ্কের তা পূরণ করবার কথা লেখা ছিল। ব্যবসায়ী কার্ডের নম্বর মুখে বলেছিলেন। কিন্তু ব্যাঙ্ক কর্মচারী কার্ডটি একবার নিজে হাতে দেখতে চেয়েছিলেন। সেই ফাঁকে তিনি কার্ডের সিভিভি নম্বর ও এক্সপায়ারি ডেট টুকে ফেলেন। পরবর্তীকালে সেই কার্ডের তথ্য পয়সার বিনিময় কয়েক হাত ঘুরে আইজল পৌঁছায়।
এই মামলায় মূল অভিযুক্ত-সহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। ছাড়া পেয়েছিলেন দুই মিজো যুবক, কিন্তু ছ'দিন লকআপে কাটিয়ে। উল্টোটাও হতে পারত, মণিপুরে কারও কার্ডের তথ্য চুরি গেল, আপনি জেল খাটলেন!
বছর দু'য়েক আগে বেশ কয়েকটি মামলা জমা পড়েছিল হাওড়া কমিশনারেটের গোয়েন্দা বিভাগে। ফোনে প্রতারনা করে ব্যাঙ্কের তথ্য হাতিয়ে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ। তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা প্রথমে সেই টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে কোথায় গেল তা খোঁজ করবার চেষ্টা করলেন। দেখা গেল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে সেই টাকা সর্বপ্রথম গিয়েছে বিভিন্ন অনলাইন ওয়ালেটে। তারপর সেই অনলাইন ওয়ালেট থেকে ওই টাকা দিয়ে বেশ কিছু সেলফোনের রিচার্জ করা হয়েছিল। গোয়েন্দারা সেই নম্বরগুলোর মালিকদের ঠিকুজিকোষ্ঠি বের করলেন। দেখা গেল সবাই আসানসোলের বাসিন্দা। একটি নম্বরও ভুয়ো নয় (অর্থাৎ যাঁদের নামে নম্বর নথিভুক্ত রয়েছে তাঁরাই এই নম্বর ব্যবহার করছেন)।
যারপরনাই আহ্লাদিত হয়ে গোয়েন্দারা আসানসোল গেলেন তাঁদের আটক করতে। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তে যা উঠে এল তা শুনে পুলিশের চক্ষু চড়কগাছ। এরা প্রত্যেকেই স্থানীয় কয়েকটি দোকান থেকে নগদের বিনিময় সেলফোন নিয়মিত রিচার্জ করান। এবার পালা দোকানদারদের। দোকানদার জানালেন মোবাইল ফোন পরিষেবাকারী সংস্থার পরিচয় দিয়ে কিছু লোক তাদের কাছে নিয়মিত এসে একটু বেশি কমিশনের রিচার্জ প্রক্রিয়া বিক্রি করে যান। তাদের শর্ত হচ্ছে কমিশনের টাকা বাদ দিয়ে বাকি টাকাটা তাদের নগদ দিতে হবে। তার পরিবর্তে তারা অনলাইন ওয়ালেটের নম্বর ও পাসওয়ার্ড দিয়ে যান। দোকানদাররা সেই ওয়ালেটে ঢুকে অনলাইনে রিচার্জ করে দেন।
এই ঘটনায় বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছিল বটে কিন্তু যতদিন পুলিশ মোডাস অপারান্ডি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি ততদিন কিন্তু সেই সেলফোন ব্যবহারকারীদের রোজ থানায় হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে প্রায় সপ্তাহ তিনেক বাদে মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছিল তাঁদের।
নগদে কিছু কিনতে গেলে তার পরিমাণ যতই কম হোক না কেন, রশিদ চেয়ে নিন
এই ঘটনাগুলোর প্রবাহ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র যিনি প্রতারিত হলেন তিনিই শুধু বিপদে পড়েন না। প্রতারককারীরা প্রতারিত টাকা ব্যবহার করবার সময় অন্য কাউকে হাতিয়ার করে থাকেন। এবং তাঁরাও বিপদে পড়েন। বিনা কারণে তাঁদের নিয়মিত হাজিরা দিতে হয় আবার বিনা কারণে তাদের আবার লকআপেও দিন কাটাতে হয়।
এর থেকে মুক্তির উপায় কী?
প্রথমত সচেতনতা। কেউ সস্তার জিনিস দেওয়া মানেই ঝাঁপিয়ে পড়া নয়। দেখে নিতে হবে, বুঝে নিতে হবে ঠিক কোন কারণে বা কোন যুক্তিতে সস্তার জিনিস দেওয়া হচ্ছে। দোকানদাররা যদি শুধুমাত্র কমিশনের কথা না ভেবে তা আঁচ করতে পারতেন তা হলে তাঁদের এ ভাবে বিপদে পড়তে হত না বা পুলিশি জেরার সম্মুখীন হতে হত না।
দ্বিতীয়ত, প্রতারকরা টাকা ব্যবহারের সময় মূলত তাদেরই হাতিয়ার করেন যাঁরা নগদে কাজ করেন। সুতারং, নগদে কিছু কিনতে গেলে তার পরিমাণ যতই কম হোক না কেন, রশিদ চেয়ে নিন।
ওই দুই যুবক বা যারা সেলফোন রিচার্জ করিয়েছিলেন তাদের কাছে যদি নগদে কেনার রশিদ থাকত তাহলে হয়ত পুলিশকে অনেক সহজেই বোঝানো সম্ভব হত যে তারা কোনও ভাবেই এই দুষ্কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়।
সাবধানের কিন্তু কোনও মার নেই!