সমকামিতা থেকে পরকীয়া, শবরীমালা থেকে তিন তালাক - ২০১৮র ঐতিহাসিক মুহূর্ত ২০১৯এ মুছে গেল কেন
শীর্ষ আদালতের নির্দেশগুলো সংস্কার ও পুরোনো ধ্যানধারনা-মুক্ত হতে পারেনি
- Total Shares
২০১৯ সালে প্রবেশ করে ফেলেছি আমরা। প্রত্যেকেই এখন উৎসবমুখর। আর তা না হওয়ার তো কারণ নেই - উৎসব পালনের জন্যে আমাদের কাছে যে এখন একাধিক কারণ রয়েছে।
গোটা ২০১৮ সাল জুড়েই ক্রীড়াক্ষেত্রে, বিনোদন জগতে, অর্থনীতিতে ও রাজনীতিতে প্রচুর সাফল্যের খবর এসেছে।
বছরের সেরা কাহিনি অবশ্য আমাদের সর্বোচ্চ আদালতই রচনা করেছে।
২০১৮ সালে দেশের শীর্ষ আদালত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়কেটি রীতিমতো ঐতিহাসিক যা উদিত ভারতের রূপ পরিবর্তন করে দিতে পারে। আর এই নির্দেশগুলো পাওয়ার পরে আমরা একটি গোঁড়ামি ও পুরোনো ধ্যানধারনা-মুক্ত ভারতের চিন্তা করতেই পারি।
অন্তত প্রাথমিক ভাবে তো তাই মনে হয়েছিল।
ভারতীয়রা অন্যদের বিচার কবে বন্ধ করবে [ছবি: রয়টার্স]
২০১৮ সালে একটি ঐতিহাসিক নির্দেশের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতা কোনও অপরাধ নয় বলে জানিয়েছে। এর ফলে বিচারব্যবস্থার উপর এলজিবিটি সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সমাজের উচিত ছিল এই রায়দানকে স্বাগত জানিয়ে সমকামে বিশ্বাসী পুরুষ ও মহিলাদের নিজেদের মতো জীবনযাপন করার সুযোগ করে দেওয়া।
কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এখনও তাদের সম্পর্কে পরনিন্দা বন্ধ করতে পারিনি। তারা হয়তো আইনের বলে বলীয়ান হয়েছে কিন্তু তাদের প্রতি এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি আগের মতো একই রকম গোঁড়া রয়ে গিয়েছে।
আরও একটি ঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে পরকীয়া কোনও অপরাধ নয়। আদালতের ব্যাখ্যা, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা আদতে মহিলাদের স্বামীর 'সম্পত্তি' হিসেবে স্বীকৃত করে। কিন্তু, এই নির্দেশের পরেও সমাজ মনে করে যে ৪০৭ ধারা বিবাহের পবিত্রতা রক্ষা করে।
তাহলে কীসের পরিবর্তন হল? কিছুরই নয়।
আদালতের নির্দেশে লাভের লাভ কী হল? মহিলারা তো মন্দিরের প্রবেশাধিকার পেল না [ছবি: রয়টার্স]
মহিলাদের আজও 'অবলা' বলে গণ্য করা হচ্ছে এবং তাঁদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত দুর্ব্যবহার চলছে।
শবরীমালা মন্দিরে ১০ থেকে ৫০ বছর বয়স্কা মহিলাদের প্রবেশাধিকার এ বছরেরই আইনসিদ্ধ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এই নির্দেশ সত্যিই ভারতীয় নারীদের জয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নারীদের কি মন্দিরে প্রবেশাধিকার সত্যি সত্যিই মিলেছে?
না। শত চেষ্টার পরেও মহিলাদের ঠাকুর দর্শন না করে ফিরে আসতে হয়েছে। তীব্র উচ্ছৃঙ্খলতা ও তিক্ত প্রতিবাদের সামনে মহিলাদের পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয়েছে।
বন্দিদশার ওপারেই রয়েছে স্বাধীনতা [ছবি: রয়টার্স]
বিধায়ক-সাংসদদের মধ্যে যাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তাঁদের নির্বাচনে লড়াইয়ের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে যত কম শব্দ খরচ করা যায় ততই মঙ্গল। এই ধরণের হাই-প্রোফাইল মামলাগুলোর কোনও দিনও নিষ্পত্তি হয় না এবং এই মন্ত্রীরা শাসনব্যবস্থার ভিতর বহাল তবিয়তে রয়ে যান।
শীর্ষ আদালতের নির্দেশগুলোর মধ্যে সেরা ছিল তিন তালাক সম্পর্কিত নির্দেশটি। আদালত ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের এই তাৎক্ষণিক বিবাহ বিচ্ছেদের প্রথাকে বেআইনি ঘোষণা করেছিল। আদালত জানিয়েছিল এই প্রথা অসাংবিধানিক। রায়দানের সময়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, এই প্রথায় মুসলমান মহিলাদের মৌলিক অধিকার খর্ব হয় এবং এই প্রথার সঙ্গে কোনও রকম আপোষ চলে না। এই রায় সত্যি সত্যিই আদালতের সাহসের পরিচয় দিয়েছে।
এই নির্দেশের পরে মুসলমান মহিলারা আদালতের বাইরে খুশিতে ফেটে পড়েন। উল্টোদিকে বিভিন্ন টেলিভিশনের পর্দায় এই রায়ের তীব্র বিরোধিতা করতে দেখা যায় ইমামদের। কিন্তু শীর্ষ আদালতের এই রায়দানের পরেও কোথাও না কোথাও এক মুসলমান মহিলার হোয়াটসঅ্যাপে 'তালাক তালাক তালাক' এই তিনটি শব্দ পাঠিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করেছে তার স্বামী।
তিন তালাক: মহিলারা আনন্দে ফেটে পড়লেন, ইমামরা টিভির পর্দায় বিরোধিতা করলেন [ছবি: রয়টার্স]
২০১৮ সালের ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোর পরেও আমরা কেমন একটা সেই পুরাতনের রেশ নিয়ে ২০১৯ সালে প্রবেশ করলাম। আমরা এখনও মানুষকে বিচার করে চলেছি, এখনও মহিলাদের সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকারকে খর্ব করে চলেছি এবং এখনও হাই-প্রোফাইল মামলাগুলোর সমাধানের অপেক্ষায় প্রহর গুণে চলেছি। ২০১৯ সালেও আমরা একটি সমাজের বোঝা বহন করে চলবে যে সমাজ মানুষের আবেগকে পাত্তা দেয়না।
২০১৯ সালে আমরা শুধুই সমাজের ক্ষয় রোধের আশা করতে পারি। শুধুমাত্র, তা পূরণ হলেই আমরা খোলা মনে উড়তে পারব।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে