১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয় বদলে দিয়েছিল ভারতের ক্রিকেটের ধারা
আশা ছেড়ে দিয়ে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সেই রাতে
- Total Shares
গোটা দুনিয়া এখন ফুটবল-জ্বরাক্রান্ত, রাশিয়ার দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপছে তাবৎ উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধ্ব, প্রতিটা গোলের সঙ্গে ওঠানামা করছে পৃথিবীময় উত্তেজনার পারদ; কিন্তু ২৫ জুন যে আমাকে মনে করায় অন্য আরেক খেলার কথা, সেটা ক্রিকেট।
২৫শে জুন, ১৯৮৩: লর্ডসের মাঠে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রুডেন্সিয়াল কাপের দ্বৈরথ। ৩৫ বছর কখন কোথা দিয়ে হুশ করে যেন কেটে গেল দেখতে দেখতে। বিশ্ব-ক্রিকেট মঞ্চে ভারতের নিঃশব্দ অভ্যুত্থান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মারকাটারি ব্যাটিং আর হাড় হিম করা পেস ব্যাটারির বিরুদ্ধে ১১ ভারতীয় ক্রিকেট সৈনিকের মহিমান্বিত মাথা উঁচু করে দেওয়া জিদের লড়াই।
২৫শে জুন ১৯৮৩ আমার কাছে এক টুকরো টুকরো স্মৃতির কোলাজ: বলবিন্দার সিং সান্ধুর ইনস্যুইং, শর্ট মিড-উইকেট থেকে অনেকটা দৌড়ে যাওয়া কপিলদেবের হাতে জমা হওয়া ভিভ রিচার্ডসের সেই ক্যাচ। মহিন্দর অমরনাথের বলে হোল্ডিং এলবিডব্লিউ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠে ঢুকে পড়া ভারতীয় সমর্থকদের উচ্ছ্বাস, লর্ডসের ব্যালকনি থেকে ছড়িয়ে পড়া শ্যাম্পেনের ফোয়ারা আর কপিলদেবের হাতে ধরে থাকা প্রুডেন্সিয়াল কাপ, যার ছবি দেখে জুলজুলে চোখে তাকিয়ে থাকতেই অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম আমরা!
স্মৃতি মোটেই সতত সুখের নয়- জীবনে অনেক ভালো স্মৃতির পাশাপাশি, খারাপ স্মৃতিও নাড়া দেয় মানুষের মনে। কিন্তু ১৯৮৩-র ২৫ জুনের ওই খেলা আমার মনে আজ ৩৫ বছরের পরেও এক মাদকতাময় আবেশ তৈরি করে। নিঃসন্দেহে ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে এটা ছিল এক ঐতিহাসিক দিন।
অবশ্য সে ইতিহাস হঠাৎ একদিনে লেখা হয়নি। ১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপে বেঙ্কটরাঘবনের নেতৃত্বে সাঙ্ঘাতিক হতাশ করেছিল ভারতীয় ক্রিকেট দল। তাই যতই হোক না কেন, কপিলদেবের মতো লড়াকু মেজাজের তরুণ নতুন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে একরাশ উজ্জ্বল নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের নিয়ে।
সে ইতিহাস হঠাৎ একদিনে লেখা হয়নি
১৯৮৩ সালে যখন বিশ্বকাপে গেল ভারত, খুব একটা কিছু আশা করেননি ভারতের অতি বড় ক্রিকেট সমর্থকও। কিন্তু চমক প্রথম খেলাতেই—ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ধরাশায়ী ভারতের কাছে!
শুরুতেই অঘটন। সেটা কেব্ল টিভি বা স্যাটেলাইট টিভির যুগ নয়, আমাদের ভরসা ছিল ট্রানজিস্টারের রানিং কমেন্টারি। দূরদর্শনের সময় তখন বাঁধা সন্ধ্যা ৬টা ৩২ থেকে রাত সড়ে নটার ইংরিজি নিউজ পর্যন্ত! সেই সংবাদেরই ফাঁকে যদি বা কখনো সাদা-কালো খেলার ক্লিপিংয়ের কয়েক সেকেন্ড দেখার সৌভাগ্য হয়! কিন্তু পরের খেলায় সেই হার অস্ট্রেলিয়ার কাছে।
মেজাজটা পালটে দিয়েছিল জিম্বাবোয়ের সঙ্গের খেলাটা। যতদূর মনে পড়ছে ৭ উইকেট পড়ে গিয়েছিল ৭০ রানের মধ্যে। আমি তখন একাদশ শ্রেণির ছাত্র, গড়িয়াহাটে এক ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকার মুখে স্কোরটা শুনে বিষণ্ণ মুখে বসে আছি চেম্বারে। প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে যখন বেরোচ্ছি আবার স্কোর শুনলাম- তখনও ব্যাটিং করছে ভারত, ধারাভাষ্যকারের গলায় কপিলদেবের তাণ্ডবের শিহরণ!
দুঃখের কথা, ওই ম্যাচটির কোনও রেকর্ডিংও পৃথিবীতে নেই কারণ সেদিন যতদূর মনে পড়ে ধর্মঘটে ছিলেন ইংল্যান্ডের টিভি-কর্মীরা। কপিলদেবের ১৭৫ রানের সেই ইনিংস দেখা হল না কোনও দিনই এ দুঃখ যাবার নয়। তবে ওই খেলাটাই বোধহয় ছিল টার্নিং পয়েন্ট। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবিতেও অদ্ভুত রকমের আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল ভারতীয় ক্রিকেটারদের!
তখন সারাদিন ধরে কোনও মিডিয়া-হাইপ ছিল না, উত্তেজনা যেটুকু তৈরি হত, সেটা খবরের কাগজ আর কয়েকটা খেলার সাপ্তাহিক পত্রিকার মাধ্যমে। এত রকমারি খবরের কাগজও ছিল না তখন। আমাদের বাড়িতে তখনো টিভি ঢোকেনি। আমি সাধারণত খেলা দেখতে যেতাম আমার পাড়ার এবং ইস্কুলেরও বন্ধু শুভ্রনীলের বাড়িতে। কী ক্রিকেট, কী ফুটবল- বড় খেলার দিন ওদের বসার ঘরে একটা জমাটি আড্ডা বসে যেত, কাঁচায়-পাকায় মিশে। সঙ্গে থাকতো মাসিমার লুচি-তরকারির অফুরান জোগান। এই ফাইনালটাও দেখতে গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতেই, বুকে দুরুদুরু উত্তেজনা আর সাঙ্ঘাতিক আশা নিয়ে।
ইতিহাসের চাকা কিন্তু ঘুরতে শুরু করেছিল সেই ২৫ জুন ১৯৮৩ থেকেই
টস-জেতায় ক্লাইভ লয়েডের ভাগ্য প্রায় কিংবদন্তি, যথারীতি এ বারেও টসে জিতে ভারতকে ব্যাটিং করতে পাঠালেন লয়েড। কী সাঙ্ঘাতিক বোলিং শুরু করল হোল্ডিং, মার্শাল, গার্নার ও রবার্টসরা চারজন। স্লিপে চিতাবাঘের মতো দাঁড়িয়ে তিন ফিল্ডার। আগুনে গোলাগুলো লেগ স্টাম্পে পড়ে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছিল অফ-স্টাম্প দিয়ে আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠছিল আমাদের সবার হৃদপিণ্ড! দুজোঁর হাতে বল জমা করে দিয়ে ফিরে গেলেন সুনীল গাভাসকার।
শ্রীকান্ত একটু আশা জাগালেও তা দীর্ঘস্থায়ী হল না। মহিন্দর অমরনাথ, সন্দীপ পাটিল কিছুটা প্রতিরোধ গড়লেও সে সবই ছিল ক্ষণস্থায়ী। একে এক প্যাভিলয়নে ফিরছিলেন সবাই এরমধ্যে হঠাৎ আবার হয়ে গেল লোডশেডিং, যা ছিল তখনকার নৈমিত্তিক ব্যাপার। কানে ট্রানজিস্টর গুঁজে অন্ধকারে চোখের জল ঢেকে ভারতের ব্যাটিং বিপর্যয়ের শেষটুকু শুনছিলাম আমরা।
লাঞ্চ-ব্রেকে শুভ্রনীলের মায়ের করা অত সুন্দর লুচি-তরকারিও বিস্বাদ লাগছিল সেদিন। টিভির সামনে ছেড়ে গম্ভীর মুখে একে একে উঠে যাচ্ছিলেন গুরুজনরা। শুভ্রনীলের বাবা, মেসোমশাই ছিলেন কালী-ভক্ত। একটার পর একটা রিজেন্ট কিং সাইজ সিগারেট খেতে খেতে বারবার উঠে গিয়ে মাথা ঠুকছিলেন মা কালীর বড় ছবিটার সামনে। গোটা পাড়ায় কেমন যেন কারফিউয়ের থমথমে নীরবতা। শুনেছি ভারতীয় ক্রিকেটারদের কয়েকজনের স্ত্রীরাও সেসময়ে মাঠ ছেড়ে হোটেলে ফিরে গিয়েছিলেন!
ব্রেকের পর খেলা শুরু হলো আবার, সান্ধুর সেই ডেলিভারির কথা তো আগেই বলেছি। তারপর নেমে পেটাতে শুরুক করলেন ভিভ। একটা একটা করে বল বাউন্ডারিতে যাচ্ছে আমাদের বুকে ছুরি চালিয়ে! ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্লেয়ারদের হাঁটা-চলায় হাবেভাবে তখন ফুটে উঠছে সিংহের ঔদ্ধত্য- কাপটা যেন শুধু ছোঁওয়ার অপেক্ষা!
কিন্তু এরপরেই পাশার দান বদলাতে শুরু করলো। রিচার্ডস, লয়েড, গোমস- এক এক করে প্যাভিলিয়নে। বাদবাকিটা তো ইতিহাস! আমরা তখন একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে লাফাচ্ছি কিন্তু দুঃখের বিষয় অনেকেই জেতার আশা ছেড়ে বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সেদিন! খবরটা জেনেছিলেন পরের দিন সকালে খবরের কাগজ পড়ে!
না তখনো কালীপুজো আসতে অনেক দেরি, বাজির রসদ ছিল না তেমন কারও কাছেই। তা ছাড়া ক্রিকেটে জিতে বাজি ফাটানো চলটা চালু হয়নি তখনো– তাই বাজি বিশেষ ফাটেনি সেদিন রাতে। কিন্তু অনেক পাড়াতেই বেরিয়েছিল বিজয় মিছিল, হয়েছিল গভীর রাতের আবির খেলা।
৩৫-৩৫টা বছর কেটে গেছে তারপর। কেউ কথা না রাখলেও কথা রেখেছে ভারতীয় ক্রিকেট দল! সেদিন লর্ডসের মাঠে যে ভেল্কি দেখিয়েছিল প্রথম, তারই রেশ ধরে এতোটা পথ হেঁটে ফেলেছে ভারতীয় ক্রিকেট। একথা ঠিক, তারপরের সিরিজেই ভারতে এসে হিংস্র, ক্ষত-বিক্ষত বাঘের নৃশংসতায় ভারতীয় ক্রিকেট টিমকে দুরমুশ করে গিয়েছিল ক্লাইভ বাহিনী। কিন্তু তা হলেও ইতিহাসের চাকা কিন্তু ঘুরতে শুরু করেছিল সেই ২৫ জুন ১৯৮৩ থেকেই।