৮৩-র জয় কেবল আমাদের ক্রিকেটকে নয়, ভারতের দীর্ঘকালের ক্রীড়া ইতিহাসের মোড়টাকেই ঘুরিয়ে দিয়েছিল
স্কুলের ছেলেদের দেখতাম কাঁধে বড় ব্যাগ নিয়ে চলেছে ক্রিকেট মাঠে, সকলেই ভবিষ্যতে বিশ্বজয় করতে চায়
- Total Shares
রাশিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবলের মাঝে ভারতও গর্ব করতে পারে। তারাও বিশ্বকাপ জিতেছিল। সেটা ক্রিকেটে। ১৯৮৩ সালে, ৩৫ বছর আগে এই দিনেই। মানে ২৫ জুন, লন্ডনের লর্ডসে। ওই একটি জয় কেবল আমাদের ক্রিকেটকে নয়, ভারতের দীর্ঘকালের ক্রীড়া ইতিহাসের মোড়টাকেই যেন ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ভারত টেস্ট খেলছে ১৯৩২ সাল থেকে। টেস্টে অনেক জয় এসেছে। ইংল্যান্ড সিরিজও জিতেছিল অজিত ওয়াড়েকরের নেতৃত্বে। কিন্ত কপিল দেবের নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালের ২৫ জুন যেন সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।
৩৫ বছর আগে সেই রাতের কথা এখনও চোখের সামনে। টিভির পর্দায় দেখছি প্রুডেন্সিয়াল কাপ একত্রে ধরেছেন কপিল দেব ও মহিন্দর অমরনাথ। মহিন্দর ছিলেন ম্যান-অফ-দ্য-ম্যাচ। লর্ডসের আউটফিল্ডে তখন অসংখ্য মানুষ আর গোটা ভারত মাঝরাতে টিভির সামনে। যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, সেই ক্লাইভ লয়েডের দলকেই ভারত হারিয়েছে ৮৩ রানে। তখন দেশে এত টিভি ছিল না। তবে রেডিওর রিলে আর যাঁদের ক্লাব ও বাড়িতে টিভি ছিল সেই জয়ের মুহূর্তে উল্লাসধ্বনিতে ভারতের আকাশ যেন বিদীর্ণ। পাড়ায় পাড়ায় পটকা আর বাজি। রাস্তায় নেমে এসেছে মানুষের ঢল।
ভারত এর আগে বহুবার অলিম্পিক সোনা জিতেছে হকিতে। কিন্তু ক্রিকেটের জয়ের মতো উল্লাস কখনও দেখা যায়নি। কারণ ক্রিকেট ঢুকে গিয়েছে প্রতিটি পরিবারের হেঁশেলে।
৩৫ বছর আগে সেই রাতের কথা এখনও চোখের সামনে
কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারতের এই জয় আমরা কেউই বোধহয় আশা করিনি। কারণ ১৯৭৫ সালে বিশ্বকাপে ভারত মাত্র একটি ম্যাচ জিতেছিল। তাও দুর্বল পূর্ব আফ্রিকার বিরুদ্ধে। আর ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপে আমাদের একটিও জয় ছিল না। তাই ১৯৮৩ সালে 'আমরা জিতব কি' এই প্রশ্নই ছিল সকলের মনে। ওদিকে, ক্লাইভ লয়েড বিশ্বকাপে হ্যাট্রিকের আশায়।
ভারত এবার ফাইনালে ওঠার আগে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মতো দলকেও হারিয়েছে। গ্রুপ লিগে ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও হারিয়েছিল। আর জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে 'ক্যাপ্টেন্স-নক' খেলেছেন কপিল দেব। তাঁর নামের পাশে ১৭৫। তিনবারের বিশ্বকাপে এটি রেকর্ড।
ভারত ফাইনালে উঠেছে। সামনে ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টসে জিতে ভারতকে তিনি ব্যাট করতে পাঠালেন। তাঁর বোলাররা দ্রুত প্যাভিলিয়নে পাঠালেন ভারতের ব্যাটসম্যানদের। ৫৪.৪ ওভারে (তখন একদিনের ক্রিকেটে ৬০ ওভারের ইনিংস হত) ভারত ১৮৩ রান করল। এই অল্প রানে ম্যাচ জেতা যায় না। এটা অনেকেই ধরে নিয়েছেন।
কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন ব্যাট হাতে ক্রিজে তখন রুদ্রমূর্তিতে ভারতের দুই বোলার - মদন লাল আর মহিন্দর অমরনাথ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটে আঘাত হানলেন মদন। ওপেনার ডেসমন্ড হেইন্স, তারপর হিলারি গোমস ও স্টার ব্যাটসম্যান ভিভিয়ান রিচার্ডসকে বিদায় করে দিলেন। রিচার্ডসকে তেলো বন্দি করেন ক্যাপ্টেন কপিল। বিনির বলে ক্যাচ তুলে লয়েড ধরা পড়েন কপিলের হাতে।
রিচার্ডসকে তেলো বন্দি করেন ক্যাপ্টেন কপিল
এর পর মহিন্দর অমরনাথ। দুজোঁ, মার্শাল আর হোল্ডিংকে দ্রুত প্যাভিলিয়নে পাঠিয়ে দিলেন। মহিন্দরের ছিল অসাধারণ বোলিং, ১২ রানে ৩ উইকেট আর মদন লালের ৩১ রানে ৩ উইকেট।
ভারতের প্রথম ক্রিকেট অধিনায়ক লালা অমরনাথের দ্বিতীয় পুত্র মহিন্দর তৃতীয় বিশ্বকাপে অবিস্মরণীয় ভূমিকা নেন। ৩৩ বছর বয়সি জিমির এই ভূমিকা ভোলার নয়। তিনি ভারতের ইনিংসে ২৬টি রানও করেছিলেন। ব্যাটে ও বলে তাঁর সম্মিলিত সাফল্য ১৯৮৩ সালের ২৫ জুন তাঁকে 'লর্ডসের লর্ড' করেছিল। খেলা শেষে তাই অধিনায়ক কপিল প্রুডেন্সিয়াল কাপ হাতে নিয়েই পরক্ষণেই তুলে দেন জিমির হাতে। টিভির সামনে বসে বুঝতে পারিনি কপিল তাঁকে কী বলছিলেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল কপিল যেন বলছেন, "এই জয় তো তোমারই জয়, জিমি।"
প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয়ের পর গোটা দেশে তার প্রভাব পড়ে। ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড তো বটেই, প্রতিটি রাজ্যের ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের মতো পাড়ায় পাড়ায়ও যেন ক্রিকেটের নবজাগরণ। স্কুলের অল্পবয়সী ছেলেদের দেখতাম মা-বাবার হাত ধরে কাঁধে বড় ব্যাগ নিয়ে চলেছে ক্রিকেট মাঠে। সকলেই যেন হতে চায় একজন কপিল দেব, মহিন্দর অমরনাথ, মদন লাল, গাভাসকার, কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত, যশপাল শর্মা, সন্দীপ পাটিল, রজার বিনি, সৈয়দ কিরমানি বা বলবিন্দর সিং সান্ধু।