এশিয়ান গেমসে স্বপ্না বর্মণের সোনা জয়, নাকি দারিদ্র্যকে জয়
কেমন করে উদ্বেগ দূরে রাখছিলেন স্বপ্নার পরিবারের লোকজন?
- Total Shares
একটা টিভি সেট চলছে। কোনও জনপ্রিয় সিরিয়ালের একটাও শব্দ নেই। নেই আবহ সঙ্গীতও। বরঞ্চ চলছে ধারাভাষ্য। ১০ ফুট বাই ৮ ফুটের ঘর। কচি-মাঝারি-বয়স্ক মিলিয়ে প্রায় ৯ জন বসে। সকলের চোখ টেলিভিশনের পর্দায়। কারও হাত জোড় করে প্রার্থনার ভঙ্গি। কেউ শাড়ির আঁচল দাঁতে কাটছেন। কেউবা অবিরত "উফ্, মা, মাগো... মা মা" বলে টেনশন ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। কেউ আবার ভাবলেশহীন ভাবে বসে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে প্রবল টেনশন। মেয়েটা পারবে তো?
স্বপ্না বর্মণের হাইজাম্প (এপি)
এই ছবিটা গোটা বিশ্ব দেখতে পায়নি। যেটা দেখা গেল, তা হল: মেয়েটি সত্যিই করে দেখাল! জাকার্তা এশিয়াড থেকে সোনার পদক নিয়েই ফেরা নিশ্চত। দু-দিনের টানা লড়াই। ইভেন্টের নাম: মেয়েদের হেপ্টাথলন। সাতটি ইভেন্টের লড়াই। হাই জাম্প, জ্যাভেলিন, শটপাট, লং জাম্প। এই চারটি ফিল্ড ইভেন্ট। বাকি তিনটি-ট্র্যাক ইভেন্ট। ১০০ মিটার হার্ডলস, ২০০ ও ৮০০ মিটার দৌড়। প্রথমদিন চারটি ইভেন্ট হয়। পরের দিন তিনটি। সব মিলিয়ে পয়েন্টের লড়াই।
সব শেষে ছিল ৮০০ মিটার দৌড়। তা শেষ করার আগেই স্বপ্নপূরণের আনন্দে বিহ্বল স্বপ্না। হাঁটু ভেঙ্গে ট্র্যাকে উপুড় হয়ে ঠোঁট ছোঁয়া চুম্বন তখন ১৩০ কোটি ভারতবাসীর জন্য সেরা ক্যামেরাবন্দি ছবি। কয়েক মিনিটে জাতীয় তেরঙ্গা পতাকা মাথার উপর উড়িয়ে সোনার মেয়ের বিজয় দৌড়। এ সবই সকলে দেখেছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে আরেক বিরল দৌড় লাইভ দেখেছিল হাতে গোনা কয়েকজন। সেই দৌড় ক্যামেরাবন্দি হয়ে ভাইরাল হয় প্রযুক্তির দৌলতে। তা ছিল সোনার মেয়ে স্বপ্নার মায়ের দৌড়।
Breaks the 6000 point barrier and wins a Gold in style. Swapna Burman bags gold in women's heplathon event. Congratulations.#AsianGames2018 pic.twitter.com/qbBbGbhbMl
— Virender Sehwag (@virendersehwag) August 29, 2018
Congratulations to Swapna Burman @Swapna_Barman96 ..for her gold ..we in india and bengal are so happy and proud ...
— Sourav Ganguly (@SGanguly99) August 29, 2018
মা বাসনা টিভির সামনে বসেছিলেন দু’টি দিন, আর ছিলেন উঠোন পেরিয়ে মা তারার সামনে। নারীশক্তির নবজাগরণ। দেবী ‘মা’ আসল মায়ের বাসনার জোরে সোনা জয়ের স্বপ্ন সফল করল মেয়ে স্বপ্না।
সেদিন বাঁশ আর টিনের ঘেরা ঘরে যখন সকলে বাড়ির মেয়ের স্বপ্ন সফল হওয়ার আনন্দে আত্মহারা মা বাসনা "মা মা" বলে কাঁদতে-কাঁদতে উঠোন পেরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন মহামায়ার সামনে। এ ছবি আজ সকল মিডিয়ায় ভাইরাল। অথচ জাকার্তা জাগরণের আগে স্বপ্নার স্বপ্ন নিয়ে সকলের মাথা ব্যাথাই ছিল না। না থাকারই কথা। এমন সব প্রতিভাদের জন্মের সময় মুখে সোনার চামচ তো জোটেই না, ভালো মানের মধুও জোটে না।
তবু ওঁরা জন্ম (স্বপ্নার জন্ম ২৯ অক্টোবর, ১৯৯৬) নেয় অজ পাড়াগাঁয়। অবহেলায়, অনাদরে ওঁরা বাড়তে থাকেন। একদিন ঝলমলিয়ে ওঠেন। স্বপ্না এমনই।
এশিয়াডে সোনা পদক জয়ী জলপাইগুড়ির সোনার মেয়ে স্বপ্না বর্মণ। ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামের মাঠে এশিয়ান অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ানশিপে মেয়েদের হেপ্টাথলনে সোনা পায় স্বপ্না। সেদিনই এশিয়াডে এশিয়া সেরার স্বপ্ন দেখা শুরু।
জ্যাভেলিন বা বর্শা ছোড়া (এপি)
জলপাইগুড়ি তথা এই রাজ্যের উত্তর প্রান্তের সোনার মেয়ে স্বপ্না বর্মণের পৈত্রিক বাড়ি এবং জমি বলে কিছুই নেই। অন্যের দান করা জমিতেই পঞ্চায়েত সমিতি থেকে বানিয়ে দেওয়া ঘরেই থাকেন স্বপ্নার বাবা পঞ্চানন বর্মণ, মা বাসনা এবং দাদা অসিত বর্মণ। বাড়িতে এলে জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের পাতকাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের কালিয়াগঞ্জ ঘোষ পাড়ার বাড়িতেই থাকেন বাংলার ওই সোনার মেয়ে। রাজ্য সরকার এই স্বপ্নার অ্যাথলিট জীবনের লড়াই রাজ্যের অষ্টম শ্রেণীর স্বাস্থ্য ও শারীর শিক্ষা পাঠ্যপুস্তকের কন্যাশ্রী বিভাগে যুক্ত করেছেন।
কালিয়াগঞ্জের ঘোষপাড়ার মানুষ পেশায় রিকশাভ্যানচালক পঞ্চানন বর্মণ (বাবা) এবং মা বাসনা বর্মণ ক্ষুদ্র চা বাগানের শ্রমিক ছিলেন। ৬ বছর আগে পঞ্চানন বর্মণের ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার পর তিনি এখন আর সে ভাবে সংসারের জন্য কিছুই করতে পারেন না। স্বামীকে দেখাশোনার জন্য নিজে চা বাগানের শ্রমিকের কাজও ছেড়ে দিয়েছেন বাসনাদেবী। স্বপ্নার বড় দিদি চন্দনার বিয়ে হয়ে গেছে। বড় দাদা পবিত্র রাজমিস্ত্রীর কাজ করে আলাদা থাকেন পরিবার নিয়ে।
বাবা-মা আর এক দাদা অসিত বর্মণ থাকেন একসঙ্গে। অসিত পেশায় রাজমিস্ত্রি। এক কাঠা জমিতেই এক চিলতে টিন-বাঁশের বাড়িতেই স্বপ্নাকে আর তাঁর স্বপ্নকে লালন-পালন করেছেন তাঁরা। দাদা অসিতের সামান্য রোজগারের টাকায় স্বামীর চিকিৎসার পাশাপাশি বাড়িতে রান্নার গ্যাসের সংযোগ নিয়েছেন। মেয়ে এশিয়াডে সোনা জয়ের লড়াই করে জিতেছে, তাতে মা দারুণ খুশি। একবেলা খেয়ে কোনও মতে তাঁরা কাটিয়েছেন। স্বপ্না স্থানীয় পাতকাটা ঘোষপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর পাশেই কালিয়াগঞ্জ উত্তমেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ২০১৪ সালে পাস করেন। স্বপ্না আগে রেলে চাকরি পেয়েও খেলার জন্য তা ছেড়েও দেন। বর্তমানে ওএনজিসিতে অস্থায়ী হিসেবেই কাজ করেন।
৮০০ মিটারে বিজয়ীর দৌড় (এপি)
কলকাতায় সাই ক্যাম্পে কোচ সুভাষ সরকারের অধীনে কোচিং নিলেও কমার্স নিয়ে স্নাতক স্তরে পড়ছেন। স্বপ্নার কালিয়াগঞ্জ উত্তমেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের গেমস শিক্ষক বিশ্বজিৎ মজুমদার গর্বের সঙ্গে বলতে থাকেন, "আমি ২০০৫ সালে স্কুলে যুক্ত হই। স্বপ্না পরের বছর ভর্তি হয়। প্রতিদিন বিকেলে ৩টে থেকে ৫টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ করিয়েছি স্বপ্নাকে। ২০০৮ সালে কলকাতায় সাই ক্যাম্পে নির্বাচনের জন্য ট্রেনের জেনারেল বগিতে করে স্বপ্নাকে নিয়ে গেছি। স্বপ্না আরও বড় সাফল্য পাক।"
২০১২ সালে জুনিয়র ন্যাশনাল গেমসে হাইজাম্পে স্বপ্না সোনা জেতে, পরের বছর স্কুল অ্যাথলেটিক্সে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে হাইজাম্প, বর্শা নিক্ষেপ, হ্যামার নিক্ষেপেও সোনা পায়। ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়াতে এশিয়ান গেমসে চতুর্থ স্থান পান স্বপ্না। কিন্তু, ২০১৫ সালে চোটের কারণে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে নামতে পারেননি তিনি।
স্বপ্নার বাবা পঞ্চানন বর্মণ বাড়িতে সকলের সঙ্গে টিভিতে দেখছেন মেয়ের সাফল্যের রিপ্লে আবার কখন দেখায়। মেয়ে আরও বড় হোক। বিশ্ব জয় করুক। বলেই ফেললেন, "আমি অসুস্থ বটে, কিন্তু মেয়ের সাফল্য অনেকটাই সুস্থ করে তুলেছে।"
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজে ফোনে কথা বলেছেন স্বপ্নার মা বাসনার সঙ্গে। এশিয়ান গেমস কভার করতে যাওয়া সিনিয়র সাংবাদিকের স্বপ্নার সাফল্যের ট্যুইটে অধিকাংশ সাই কর্তারা রিট্যুইট করে গর্ব প্রকাশ করেছিলেন, "আমাদের সাইয়েই মেয়ে।"
A talented athlete wins a prestigious medal.Well done @Swapna_Barman96 for winning the Gold in the Heptathlon. This success demonstrates the skills and perseverance you are blessed with. India is extremely proud of you! #AsianGames2018 pic.twitter.com/bjYqFI0dXN
— Narendra Modi (@narendramodi) August 29, 2018
. @Swapna_Barman96 - Queen of Heptathlon!Heptathlon, deemed as THE toughest Athletic event, has been conquered by ????????. Standing ovation 2 Swapna Barman, who, in a majestic display, clinched a????. AN ILLUSTRIOUS MOMENT in India's sports history at #ASIANGAMES! #KheloIndia pic.twitter.com/Ek3IeitaUL
— Rajyavardhan Rathore (@Ra_THORe) August 29, 2018
কিন্তু সেদিন তাঁরা কোথায় ছিলেন, যেদিন স্বপ্নার কিছু হবে না বলে- তাঁদেরই একজন এই সোনা জয়ীকে সাই থেকে ছুটি দিতে চেয়েছিলেন। তারপর চোট-আঘাত সামলে বারংবার তাঁকে যোগ্যতা প্রমাণের অগ্নিপরীক্ষায় পুড়তে হয়েছে। পুড়তে পুড়তে আরও ইস্পাত কঠিন মানসিকতার হয়ে উঠেছিল। ঈশ্বর অন্যভাবেই গড়েছিলেন মেয়েটিকে। দু'পায়ে পাঁচের বদলে ছ'টি আঙ্গুল। দৌড়বিদের পা-ই সব। সেই পায়ের বাড়তি আঙ্গুল মানেই সাধারণ জুতোতে হবে না, বিশেষ জুতো চাই। জীবনের শুরুতেই লড়াই ছিল অন্য মাত্রার। ২০১৬ সালে দৌড়-ঝাঁপ-লাফের জন্য স্কলারশিপ জুটেছিল দেড় লাখ টাকার। এমন এক সংস্থা তাঁর পাশে দাঁড়ায় যার নাম "দ্য ওয়াল অব ইন্ডিয়ান ক্রিকেট"। হ্যাঁ, রাহুল দ্রাবিড়। ক্রিকেটের বাইরে অন্য খেলার প্রতিভাবানদের পাশে দাঁড়ানো এই সংস্থার নাম: গো স্পোর্টস ফাউন্ডেশন। রাহুল দ্রাবিড় অ্যাথলিট মেন্টরশিপ প্রকল্পে আছেন স্বপ্না। দ্রাবিড়ের এমন ভাবনার খবরও ক'জন জানতেন?
বিশ্বজয়ের পরে স্বপ্না বর্মণ (এপি)
প্রাইজ মানির টাকা চলে যায় সংসারে। ভালো খাওয়া তো দূরে থাক , দু'বেলা দু'মুঠো পেটে জুটতো না স্বপ্নার। তবুও স্বপ্ন ফিকে হয়নি। তাই কলকাতা সাই কেন্দ্রে ঠাঁই পাওয়া রঙিন করে তাঁর স্বপ্নকে। বাবার চিকিৎসার খরচ, বাড়ির চারধারে পাঁচিল দেওয়া- এসবের পাশে চলছে নিজের স্বপ্নকে ছোঁয়ার লড়াই। আজ প্রথম ভারতীয় মহিলা হয়ে হেপ্টাথলনে এশিয়ান গেমসে সোনা জয়ী কন্যা এই বাংলারই এক জেলার। এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, এশিয়াডে নাম্বার ওয়ান। এরপর? মেয়ের বাবার স্বপ্ন: বিশ্বসেরা কন্যা আমার স্বপ্না। এই স্বপ্নাকে নিয়ে স্বপ্ন আজ উসকে দিচ্ছে সকলকে।