পাকিস্তানকে বয়কট: নীতিটা ছেলেখেলা নয়, তাই সন্ত্রাস ও ক্রীড়া একসঙ্গে চলতে পারে না
বহুদেশীয় খেলায় যোগ দিলেও দু-দেশীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বন্ধ হোক
- Total Shares
১৯৭৪ সালে ভারত প্রথম বারের জন্য ডেভিস কাপের ফাইনালে ওঠে। আমাদের বিপক্ষে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
আমি টেনিসের ভক্ত ছিলাম। আমি ওয়েস্ট বাকল্যান্ডের ডেভনশায়ারে আমাদের স্কুলের হয়ে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় খেলেছি। ১৯৭৪ সালে আমি ডেভিস কাপের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ দেখতে কলকাতা পর্যন্ত গিয়ে হাজির হই। যখন সেই সময়ের টেনিস-শক্তি প্রথমে অস্ট্রেলিয়া ও তার পরে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে যখন ভারত প্রথমবার ডেভিস কাপের ফাইনালে পৌঁছে ইতিহাস গড়েছিব তখন আমার শিহরিত হওয়ারই কথা ছিল।
তবে আমি শিহরিত হইনি।
কারণ ভারতের বিপক্ষে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
ইন্দিরা গান্ধী ঠিক করেছিলেন যে ডেভিস কাপের ভারত খেলবে না দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে – আন্তর্জাতিক চাপে সেখানে জাতিবিদ্বেষের অবসান ঘটেছিল। (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)
আমরা তখন খুব ছোট, তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার সঙ্গে যে অদ্ভুত ভাবে ক্রীতদাসের মতো আচরণ করত মূলত ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস থেকে আগত শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক স্বল্প জনসংখ্যার লোক, সেটা না বোঝার মতো শিশুও তখন ছিলাম না।
আমরা টেনিসের প্রতি আমাদের ভালোবাসা চেপে রেখেছিলাম এবং একজন ছাত্র হিসাবে, ডেভিস কাপের ফাইনাল ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে না খেলার ব্যাপারে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের সিদ্ধান্ত পুরোপুরি সমর্থন করেছিলাম।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (সেই ভয়ঙ্কর ক্রীতদাস ব্যবসা যে দেশের ইতিহাসে রয়েছে) নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের দেশগুলোও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও ক্রীড়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল তাদের জাতিবিদ্বেষের কারণে।
জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ যত বেড়েছে, অন্য দেশগুলিতও দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়দের বর্জন করতে শুরু করেছে। অলিম্পিক্স এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
১৯৯২ সালের মধ্যে সেই জাতিবিদ্বেষ ঘুচে যায়, দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে কারার অন্তরালে থাকার পর মুক্তি পান নেলসন ম্যান্ডেলা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আবার প্রবেশ করে দক্ষিণ আফ্রিকা।
এ ক্ষেত্রে ক্রিকেট মস্তবড় একটা ভূমিকা পালন করেছিল। মিশ্র-জাতিসত্ত্বার ইংরেজ ক্রিকেটার বাসিল ডি’অলিভিয়েরা ইংল্যান্ড টেস্ট দলের সদস্য বলে ১৯৬৮ সালে তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে সেই সফরটাই বাতিল করে দেয় টিসিবিবি (টেস্ট অ্যান্ড কাউন্টি ক্রিকেট বোর্ড, তখন ইংল্যান্ডের ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থাকে এই নামেই লোকে চিনত)।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে যত বেশি করে এক ঘরে করে দেওয়া হয়েছে, তত দ্রুত সেখান থেকে জাতিবিদ্বেষ দূর হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছে।
খেলাকে অস্ত্র করে অনেক দেশকেই শাস্তি দেওয়া হয়েছে – অথবা রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া হয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধ যখন চরমে তখন ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিক বয়কট করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাল্টা হিসাবে সোভিয়েত রাশিয়াও ১৯৮৪ সালের লস এঞ্জেলেস অলিম্পিক বয়কট করে।
পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার প্রতিবাদে ভারতেরও কি ১৬ জুন ম্যাঞ্চেস্টারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রিকেট বিশ্বকাপ বয়কট করা উচিত?
অতি সংক্ষিপ্ত উত্তরটি হল: হ্যাঁ। বড় করে বললে: একেবারেই হ্যাঁ।
পাকিস্তানের সঙ্গে মুখোমুখি সব খেলাই ভারতের বর্জন করা উচিত – ক্রিকেট, ফুটবল, হকি – সব।
যে সব খেলায় বহু দেশ যোগ দেয় সেখানে ব্যাপারটা খুব জটিল।
পাকিস্তান প্রতিযোগিতায় রয়েছে বলে অলিম্পিক্স ও ক্রিকেট বিশ্বকাপের মতো আসর ভারত বয়কট করতে পারে না। তাই ভারতের ক্রীড়ানীতি এমন হোক যেখানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুই দেশের খেলা বর্জন করা হবে কিন্তু বহুদেশের খেলায় ভারত যোগ দিয়ে যাবে।
ভারত অবশ্যই ২০১৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে যোগ দেবে কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৬ জুন খেলতে নামবে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারত যে বিন্দুমাত্র সহনশীলতা দেখাবে না, এর মাধ্যমেই সারা বিশ্বকে সেই বার্তা দেওয়া যাবে।
সচিন তেণ্ডুলকর বলেছেন যে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের খেলা উচিত, কারণ দুটো পয়েন্টের মূল্য আছে। সচিন বলেছিলেন, “বিশ্বকাপের খেলায় চিরকালই পাকিস্তানকে টেক্কা দিয়ে এসেছে ভারত, এটা হল ওদের আরও একবার টেক্কা দেওয়ার সময়। প্রতিযোগিতায় ওদের দুটো পয়েন্ট পাইয়ে দিয়ে সুবিধা করে দেওয়া আমার মোটেই পছন্দ নয়।”
আসলে ওই দুটো পয়েন্ট মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেললে রাওয়ালপিণ্ডির সেই জঘন্য নীতিটাকেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে, যে নীতিটি হল সন্ত্রাস চালিয়ে যাও এবং একই সঙ্গে সম্মান আদায় করে নেওয়ার জন্য ভারতকে আলোচনার আহ্বান জানাও এবং ভারতের সঙ্গে খেলা বজায় রেখে যাও।
অতএব ভারতের নীতি হোক সুস্পষ্ট ও স্থায়ী – কোনও রকম দ্বিপাক্ষিক খেলায় পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া নয়। বহুদেশীয় খেলার ক্ষেত্রে পাকিস্তান দুই পয়েন্ট পায় পাক, তাতে মেডেলের তালিকায় যা স্থান হয় হোক। যাঁরা প্রায় প্রত্যেক দিন পাকিস্তানের সন্ত্রাসের ফলে শহিদ হচ্ছেন, তাঁদের রক্তের দামের চেয়ে মেডেলের দাম মোটেই বেশি নয়।
আমরা পাকিস্তানকে হারাতে ভালোবাসি। তবে এবার তাদের সঙ্গে খেলতে অস্বীকার করে তাদের পরাজিত করতে হবে, কারণ তারা এর মূল্যটাই বোঝে না। (ছবি: রয়টার্স)
খুব সাধারণ একটা যুক্তি হল – রাজনীতির সঙ্গে খেলাকে মিশিয়ে ফেল না। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিকরা ও সেনা ঠিক সেটাই করে থাকে। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) পরিচালনা করে পাকিস্তানের সেনা। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান হলেন তার পৃষ্ঠপোষক।
পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে পাকিস্তানের ক্রিকেট অধিনায়ক সরফারোজ আহমেদ বলেছিলেন যে ক্রিকেটকে নিশানা বানানোয় তিনি ‘হতাশ’। খেয়াল করে দেখুন, তিনি কখনোই বলেননি যে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে তিনি হতাশ, তিনি সিআরপিএফ জওয়ানদের শহিদ হওয়ায় দুঃখপ্রকাশও করেননি। তার বদলে তিনি ভাবলেশহীন ভাবে বলেন, “আমি মনে করতে পারছি না যে পাকিস্তান কোনও দিন খেলার সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়েছে বলে।”
আরেকটা ছেঁদো যুক্তি খুবই শোনা যাচ্ছে, কাউকে বর্জন করে কখনও সন্ত্রাস বন্ধ করা যায় না। সত্যিই হয় না। তবে যে রাষ্ট্র সন্ত্রাসে মদত দেয় সেই দেশের বিরুদ্ধে খেললে তারা কখনও সন্ত্রাস বন্ধ করবে না – ঘটনা হল তারা এটাকে বৈধতা দেওয়া বলে ভাববে।
এটাকে আনন্দদায়ক বলে মনে হয় – তবে এটা বন্ধ করে এখন আমাদের নির্ভীক শহিদদের সম্মান জানাতে হবে। (ছবি: রয়টার্স)
এটা শুধু পাকিস্তানের তীব্র ভারত-বিরোধী সেনা, রাজনীতিক ও ধর্মীয় ভাবে চরমপন্থীদের ব্যাপার নয়। পাঠ্যপুস্তক থেকে ভারতকে যারা খলনায়ক বলে মনে করে সেই সব গড়পড়তা পাকিস্তানির মনেও ভারতের ব্যাপারে তীব্র বিরূপ ধারণা রয়েছে। পাকিস্তানের ধারনার সঙ্গে এই ধারনার বিরোধ রয়েছে, উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে আহমদীদের নিপীড়ন করা তাদের সংবিধান-স্বীকৃত।
ভারত ও আফগানিস্তানে দুটি ভিন্ন কারণে সন্ত্রাসবাদকে ব্যবহার করছে পাকিস্তান। আফগানিস্তানে তাদের সন্ত্রাসের কৌশলগত কারণ হল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কয়েকটি উদ্দেশ্য সাধন করা। এ ক্ষেত্রে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিয়ে আসছে যে তারান্ত তালিবান সন্ত্রাসবাদীদের পুরো ছেড়ে দেবে (যেটা তাদের তৈরি ও তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে) যদি না আন্তর্জাতিক শক্তিগুলি তাকে তাদের বিদেশনীতির অঙ্গ হিসাবে সন্ত্রাসবাদকে ব্যবহার করতে দেয়।
ভারতে হালকা ধরনের সন্ত্রাসবাদী হামলাকে ব্যবহার করে পাকিস্তানি সেনা যাতে তারা ভারত থেকে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে তা যাতে বজায় থাকে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ হল রাষ্ট্রীয় নীতি। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ ও আলোচনা যেমন একই সঙ্গে চলতে পারে না সেই একই কারণে সন্ত্রাসবাদ ও খেলাও একই সঙ্গে চলতে পারে না।
পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদী হামলার বহুমুখী জবাব দেওয়ার জন্য ভারত প্রস্তুত।
কাশ্মীর, পঞ্জাব ও দিল্লি ও দেশের বাকি অংশে পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইটা দীর্ঘমেয়াদি ও কঠিন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলা – তা যে ধরনের খেলাই হোক না কেন – প্রত্যেক ভারতীয়ের মন থেকে বহু দূরে সরে যাওয়া উচিত।
পাকিস্তান আমাদের যন্ত্রণা ছাড়া কিছুই দেয়নি। আমরা কেন তাদের ভারতের বিরুদ্ধে খেলার সম্মান ও আনন্দ দেব? (ছবি: রয়টার্স)
টেলিভিশনের পর্দায় ক্রিকেট খেলা দেখিয়ে যে আয় হয়, তার ৭০ শতাংশ আসে ভারতের দর্শকদের থেকে – এটাকে যদি কমিয়ে দেওয়া যায় তা হলে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্স (আইসিসি) দ্রুত লাইনে চলে আসবে।
একটা দুশ্চিন্তা রয়েছে যে দু-জন পাকিস্তানি শুটারকে ভিসা দিতে অস্বীকার করায় অলিম্পিকের খেলা আয়োজন করা থেকে বঞ্চিত হতে পারে ভারত। ঠিক পদক্ষেপ হল, বহুদেশীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানকে যোগ দিতে দেওয়া – কিন্তু দেশে হোক বা বিদেশে – পাকিস্তানের মুখোমুখি হবে না ভারত, সেই মেডেলের মূল্য যতই হোক না কেন।
যে দেশ সন্ত্রাসবাদে সরকারি ভাবে মদত দেয়, ২০১৯ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপে ম্যাচে সেই দেশের বিরুদ্ধে না খেললে পুলওয়ামায় আমেদের নিহত শহিদদের সামান্যতম সম্মানটুকু প্রদর্শন করা যাবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে