নৈশালোকে ফুটবল কী ভাবে অন্ধকার কাশ্মীরের আতঙ্ক কাটাতে সাহায্য করছে
স্কুল মাঠে জ্বলছে বাতিস্তম্ভ, কাশ্মীরিরা ফিরে পাচ্ছেন তাদের হারিয়ে যাওয়া ফুটবল প্রেম
- Total Shares
সূর্য অস্তাচলে। ক্রমেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে অশান্ত কাশ্মীরে। শ্রীনগরে ছবির মতো সুন্দর জাবেরবান পাহাড়ের পাদদেশে একটি খেলার মাঠের আলোগুলি তখনই একে একে জ্বলে উঠল। এই আলোই এখন গোটা রাজ্য জুড়েই নতুন আশার আলো সঞ্চার করে চলেছে।
উপত্যকার অতি প্রিয় খেলা ফুটবলের টানে অন্তত হাজার তিনেক দর্শক ভিড় করেছেন সেই মাঠে।
সময়টা অবশ্য বেশ গোলমেলে। কাশ্মীরে অনূর্ধ-১৯ পর্যায়ের নৈশালোকে প্রথম টুর্নামেন্ট চিনার কাপ। এই টুর্নামেন্টের মূল সংগঠক ডিপিএস শ্রীনগর। জাতীয় সড়ক ধরে শ্রীনগরে প্রবেশের মুখে আথওয়াজন এলাকায় এই স্কুলের বিশাল ক্যাম্পাস।
সবেমাত্র রাজ্যের দুই খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলের মধ্যে হাড্ডাহাডি ম্যাচ শেষ হয়েছে। সেই ম্যাচে টিন্ডেল বিস্কো ২-১ গোলে বার্ন হলকে পরাজিত করেছে।
ম্যাচের আগে ছবি তুলতে ব্যস্ত কিশোর ফুটবলাররা [ছবি: লেখক]
অন্য একটি ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে উত্তর কাশ্মীরের দল। এই উত্তর কাশ্মীরেই গত ১১ সেপ্টেম্বর গুলির লড়াইয়ে একজন ১৮ বছরের কিশোর-সহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
এই ম্যাচে এজিএস বান্দিপোরা শেষ পর্যন্ত এজিএস সোপোরকে পরাজিত করেছে। জয়ী দলের অধিনায়ক ১৫ বছরের ফাইসুল সাবির উত্তেজনায় টগবগ করতে করতে বলেই ফেললেন, "আমাদের ওখানে (উত্তর কাশ্মীরে) তো এই সময় আমরা সবাই ঘরবন্দি হয়ে থাকি। কিন্তু এখানে মাঠে লাগানো বাতিস্তম্ভগুলোতো দেখছি ম্যাজিকের মতো কাজ করছে। সত্যি এই ভর সন্ধ্যাবেলাতেও যে নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করা যায় তা আমি কল্পনাও করতে পারেনি।"
দলের প্রশিক্ষক বছর কুড়ির ইরশাদ আহমেদ অবশ্য সতর্ক। দলের প্রতিটি সদস্যকে বাড়ি ফেরার জন্য তাড়া দিয়ে চলেছেন। শ্রীনগর থেকে বান্দিপোরার দুরত্ব নয় নয় করে ৭০ কিলোমিটার।
সূর্য ডোবার পর বাড়ি ফিরতে কি কিছুটা হলেও ভয় পাচ্ছেন দলের সদস্যরা? তাদের শহরে তো জঙ্গি ও নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর মধ্যে লড়াই নিত্যদিন লেগে আছে। দলের তরুণ ফুটবলাররা অবশ্য মানতে রাজি নন, "পারিপার্শিক পরিস্থিতিকে আপনি কী চোখে দেখছেন তার উপর আপনার ভয় পাওয়া বা না পাওয়াটা নিৰ্ভর করে। নৈশালোকে প্রথমবার খেলতে নেমে আমরা ভয়কে জয় করতে শিখেছি।"
নৈশালোকে চলছে কাশ্মীরিদের অতি প্রিয় ফুটবল খেলা [ছবি: লেখক]
এই তরুণ তুর্কিরা বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছে যে নৈশালোকে ফুটবল 'অন্ধকার কাশ্মীরের অজানা আশঙ্কা' সম্পর্কে তাদের নিজেদের ও তাদের পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গিটাই বদলে দিয়েছে।
সংগঠক স্কুলের অধিনায়ক আইহান শেখকে সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির বাইরে বেরোতে দিতে রাজি ছিলেন না তাঁর বাড়ির লোকজন। আইহান জানাচ্ছেন, "এখন অবশ্য পরিবেশ অনেকটাই ভিন্ন। আমার পরিবারের লোকেরা এখন মাঠে এসে এই খেলা উপভোগ করেন। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই আলোগুলো আমাদের সঠিক পথই দেখাচ্ছে।"
খুব সম্ভবত ডিপিএস শ্রীনগর স্কুলই দেশের একমাত্র স্কুল যেখানে খেলার মাঠে নৈশালোকের ব্যবস্থা রয়েছে।
এর পিছনে অবশ্য যথেষ্ট কারণও রয়েছে। স্কুলের চেয়ারম্যান তথা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বিজয় ধর বলেন, "আমাদের ছেলেরা (কাশ্মীরি) বহু ক্ষেত্রেই বঞ্চনার শিকার হয়েছে। তাই তো প্রায়শই একটা প্রশ্ন শুনতে হয় আমাদের - গত ৩০ বছর ধরে আমরা ওদের জন্যে কী করেছি।"
২০০৩ সালে ৬০ জন পড়ুয়া নিয়ে স্কুলটি শুরু হয়েছিল। এখন প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী-সহ স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা সাড়ে চার হাজারেরও বেশি।
সেনাবাহিনীর চেষ্টা সত্ত্বেও সন্ত্রাসবাদীদের সংখ্যা বেড়েই চেলছে কাশ্মীরে [ছবি: পিটিআই]
কাশ্মীরের মতো অশান্ত রাজ্যে ডিপিএস শ্রীনগরের আধুনিক ও যথোপযুক্ত পরিকাঠামো সত্যিই প্রশংসা দাবি করে। পুরো রাজ্যে এটিই একমাত্র স্কুল যার প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের পুরোটাই সৌর শক্তির সাহায্যে উৎপাদন হয়।
স্কুলের বেশ কয়েকজন ছাত্র ইতিমধ্যেই বিশ্বের তাবড় তাবড় বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে গেছেন। বিজয় ধর বলেছেন, "আমাদের দুই ছাত্রী স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০০ শতাংশ বৃত্তি পেয়েছে। আরও তিনজন পড়ুয়া নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পেয়েছে"। এখানে উল্লেখ্য, বিজয় ধর যে স্কুলে ছেলেবেলায় পড়তেন সেই টিন্ডেল বিস্কো স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাই (ওঁর নামেই স্কুল) উনিশ শতকে কাশ্মীরে ফুটবলের সূচনা করেন।
ক্রমে কাশ্মীরে ফুটবল খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটা সময় ছিল, যখন কাশ্মীরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে রাজ্য সরকারের খাদ্য ও গণবন্টন দপ্তর এবং এসআরটিসি দপ্তরের ফুটবল দল নিয়ে চর্চা হত। কিন্তু গত ৩০ বছরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় কাশ্মীরিদের ফুটবল উন্মাদনায় অনেকটাই ভাঁটা পড়েছে।
সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোই যেন নৈশালোকের ফুটবল ফিরিয়ে নিয়ে আসছে। ব্যবসায়ী ওয়াসিম রিফাত বলছিলেন, "ফুটবল আমার অতি প্রিয়। আর নৈশালোকে নিজের চোখের সামনে ফুটবল দেখতে পাওয়াটা তো এক অনন্য অভিজ্ঞতা।"
কিন্তু এই সময় গোটা কাশ্মীর জুড়েই সন্ত্রাসবাদের বাড়বাড়ন্ত। সেনাবাহিনীর ব্যাপক চেষ্টা সত্ত্বেও গত দশ বছরে এই প্রথম রাজ্যের নথিভুক্ত জঙ্গি সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই স্থানীয়।
১১ই সেপ্টেম্বর যখন তার বয়সী কিশোররা অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবল প্রতিযোগিতা নিয়ে মাতামাতি করছে তখন ১৮ বছরের ফুরকান হানদ্বারার লানগেট অঞ্চলে নিরাপত্তা রক্ষীদের গুলিতে নিহত হয়েছে। মাত্র মাস চারেক আগেই জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছিল ফুরকান।
তাহলে এই জঙ্গি দমনের উপায় কী?
জয়ী দলের এক সদস্যের সঙ্গে আয়োজক ডিপিএস শ্রীনগরের চেয়ারম্যান বিজয় ধর [ছবি: লেখক]
বিজয় ধরের মতে, "তাদের অনেক বেশি করে বিভিন্ন ধরণের গঠনমূলক কাজে লাগাতে হবে। আজকের তরুণ প্রজন্ম ১৯৪৭, ১৯৬৫ কিংবা ১৯৭২-এর রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে উৎসাহী নয়। তারা সুন্দর ভবিষ্যৎ চায় আর তাই তারা অশান্ত। এক্ষেত্রে ওদের দোষারোপ করে কোনও লাভ হবে না।"
রাত ১০টা বাজতে চলল। এ দিনের মতো খেলা শেষ। সকলেই বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
কিন্তু পরিস্থিতি খুব সুখের নয়। আগের রাতে এ রকম সময়তেই অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজন লোক পুরোনো শ্রীনগরের কেন্দ্রস্থলে একজনকে গুলি করে মেরেছে। গত তিন দিনে এই নিয়ে তিনজন রহস্যজনক ভাবে নিহত হলেন।
কাশ্মীরের জনশূন্য রাস্তায় সতর্ক পুলিশ প্রশাসন। জায়গায় জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে চলছে তল্লাশি।
আমাদের গাড়ি একটি চেকপোস্টে দাঁড়াতেই একজন পুলিশকর্মী বন্দুক উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কোথা থেকে আসা হচ্ছে।
"আমি ফুটবল খেলা দেখে ফিরছি।"
উত্তর শুনে রীতিমতো ধাঁধায় পড়ে গেলেন সেই পুলিশ অফিসার, "তাই নাকি? তা, কাশ্মীরে এত রাতে কারা ফুটবল খেলে?"