হকি বিশ্বকাপের আয়োজনে কতটা প্রস্তুত নবীন পট্টনায়কের ভুবনেশ্বর?
ভুবনেশ্বর শহর তাঁদের লুকোল কোথায়? কর্পোরেট কারসাজি?
- Total Shares
‘বিশ্বকাপের শহরে’ ঝটিকা সফরে গিয়ে, ঝটকাই লেগেছিল। বিশ্বকাপ বলে কথা। ২৮ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বকাপ হকির আসর বসছে ভারতে, তাও আবার ওড়িশার ভুবনেশ্বরে। বেজায় তামঝাম হবে... এমন আশা নিয়ে কাকভোরে ভুবনেশ্বর জংশন স্টেশনে নামলাম। স্টেশনের ওয়াইফাই ডিসপ্লে বোর্ডগুলো চোখ টানলো। প্ল্যাটফর্মের গণ্ডী টপকে বাইরে এসে একটাও সেই হোর্ডিং চোখ টানলো না।
কোথায় বিশ্বকাপ? যে ক’টা হোর্ডিং আর ব্যানার, তাতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের ছবি আর ‘মেক ইন ওড়িশা কনক্লেভ’-এর ছড়াছড়ি। মনে হতে লাগল, ‘বিশ্বকাপ হকি’ নিয়ে এ শহর থোড়াই ভাবে।
কলিঙ্গ স্টেডিয়াম, এখানেই বসছে হকি বিশ্বকাপের আসর (পিটিআই)
আমাদের কলকাতা ফিফার যুব বিশ্বকাপের আয়োজনের সামান্য অংশের আয়োজক হয়ে কী কাণ্ডটাই না করেছিল! তিলোত্তমা কলকাতার কেতাই বদলে গিয়েছিল ষাট দিন আগে থেকে। আর ১৬ দেশের বিশ্বসেরার এই লড়াই তো কলিঙ্গ নগরীর স্টেডিয়ামেই হবে--তবুও এত গা এলিয়ে থাকা ভাব! ভাবা যায়?
ভাবাই তো যাচ্ছে না। জাতীয় হকি দলের এখন স্পনসর আর কোনও কর্পোরেট সংস্থা নয়, খোদ ওই রাজ্যের পর্যটন দফতর -- ওড়িশা পর্যটন দফতর। তাই নিলামের আসরে মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক বলেই দিয়েছিলেন ভারতীয় হকি ফেডারেশনকে যে, ভুবনেশ্বরেই হবে ভুবনভোলানো বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপ হকি ভুবনেশ্বরেই হচ্ছে। আর এক সপ্তাহও বাকি নেই। কিন্ত মূল কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে গিয়ে উদ্বোধনীর প্রস্তুতিতে যা দেখে এসেছিলাম, তা এ বাংলায় হলে কী ঝড় যে বইতো! বিতর্কের ঝড় বয়ে গেয়েছিল ইডেনে ১৯৯৬ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে। মাঠের মাঝখানে মঞ্চ বানিয়ে সেই মাঠেই খেলার ব্যবস্থা ছিল। ছেলেদের বিশ্বকাপ হকির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও হতে যাচ্ছে কলিঙ্গ স্টেডিয়ামের মূল মাঠের মাঝে। ফুটবলের মাঠ খোঁড়া হয়ে গেছে। মঞ্চের জন্য বিশাল প্ল্যাটফর্মের মাঝে ৮ ফুট ব্যাসের গোল অংশ থাকছে। মঞ্চের নীচ থেকেই লিফট কনসেপ্টে উঠে আসবেন কিং খান - শাহরুখ। কিংবা ‘চোলি গার্ল’ মাধুরী দীক্ষিত। আর সঙ্গে এ আর রহমান।
হকি স্টিক হাতে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক (পিটিআই)
‘জয় হিন্দ’ শুনবে গোটা বিশ্ব। ওড়িশার ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতরের সচিব একরাশ আত্মবিশ্বাসের স্বরে বলে দিলেন, “এই প্রথম বিশ্বকাপ হকির উদ্বোধনে চোখ ধাঁধানো অনুষ্ঠান দেখাব আমরা।” এত আগেই কথায় পূর্ণ তৃপ্তির ঢেঁকুর।
বিশ্বকাপ ট্রফিটি উন্মোচন অনুষ্ঠানে সাদা বড় ঘেরের পাজামা আর গোল গলা সাদা পাঞ্জাবির টেডমার্ক পোশাকে মুখ্যমন্ত্রী পট্টনায়ক বারবার বার্তা দিলেন, “কথা কম, কাজ বেশি।”
সত্যিই কাজ বেশিতে বিশ্বাসী প্রশাসনের বাবুরা? ভুবনেশ্বরেই দেওয়ালে দেওয়ালে হকির চিত্রে তুলির টান বোঝাচ্ছে কোথাও - এ তো হকির শহর। এক সময় সাবেক বিহার (রাঁচি) দিয়েছে দেশের তাবড় হকি তারকা। মাহি ধোনি বদলে দিয়েছেন রাঁচির সম্পর্কে ধারনা। ভুবনেশ্বর যেন আরও চমক দেওয়ার অপেক্ষায়।
চমক শুরু রাজীব শেঠ দিয়ে! বাংলা রঞ্জি দলের প্রাক্তন মিডিয়াম পেসার এখন ওড়িশার বদলে যাওয়া খেলোয়ারি অন্যতম খিলাড়ি। দিল্লিতে বেড়ে ওঠা ওড়িশা আর বাংলায় দাপটে ক্রিকেট খেলার সুবাদে টাটার কর্মী। টাটা আবার ওড়িশার ব্যবসা আর খেলার পরিকাঠামোর বড় কারিগর। রাজীবের কাচে ঘেরা কর্পোরেট কেবিন, প্রায় দেড় দশক পর দেখা হওয়ার ঘোর কাটাতেই সময় নিল।
রাজীবের সেই মিষ্টি হাসি। সাহেবি স্কুলে পড়া ছাত্রের শিষ্টাচার আমার চেনা ক্রিকেটার বন্ধুকে কাছে ফিরিয়ে আনল। কিন্তু চেয়ারে বসা টানটান চেহারার পিছনে দেওয়ালে ঠাসা বোর্ডে কালো কালিতে লেখা টাস্ক চার্ট বারবার বোঝাল, সে আজও নিয়মের বেড়িতে নিজেকে বেঁধে রেখেছে।
গ্রিন টি আর সঙ্গে প্রোটিন বিস্কুট কিংবা এক প্লেট পেয়ারা বলে দিচ্ছিল, সে অভ্যাস বদলায়নি। হাসতে হাসতে বাংলা নিয়ে ক্রিকেট আড্ডার ফাঁকে বললো, “ভাই, কলকাতা আমাকে আর মনে রাখেনি। সিএবিতে কিছু করতে চেয়ে কত চিঠি আর ই-মেল লিখেছি তার ইওত্তা নেই। জানো কি, মালয়েশিয়ার কোচের দায়িত্ব সামলে এসেছি?”
স্বীকার করেছি জানতাম না, কিন্তু জানলাম। এখন সে বোর্ডের ম্যাচ অবজারভার হয়ে কাজ করে। আর ভুবনেশ্বরকে দেশের সেরা ‘স্পোর্টস সিটি’ বানানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজে বুঁদ। কাজ করার সুযোগ থাকলে প্রাক্তন ক্রীড়াবিদরা মাঠ-ময়দানকে কিছু ফেরত দিতেই চান।
সেই সুযোগটাই নাকি ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী সকল ইচ্ছুক প্রতিনিধিকে দিতে চান। ভুবনেশ্বরের সব বড় বড় রাস্তার সিগন্যাল আজ সৌরশক্তি নির্ভর। বিদ্যুৎ অপচয় বন্ধের সব সিদ্ধান্ত বহাল হয়েছে। অপরাধ কমাতে প্রতি থানাকে রিপোর্ট পাঠাতে হয় রোজ। আমাদের রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর মতো হঠাৎ হঠাৎ পরিদর্শনের নমুনা ভুবনেশ্বরের আম জনতা জানে না। কিন্তু জানে পট্টনায়ক ভীষণ ভাবেই কেজো মানসিকতার। তাই সকল সরকারি দপ্তর জানে রাজনীতির কারবারিরা আর যাই করুন, ফাইল ফেলে রেখে কাজের গতি মন্থর করবেন না।
হকি বিশ্বকাপের ম্যাসকট ওলি (সংবাদসংস্থা)
এই পরিবেশটাই তো শিল্পপতিদের পছন্দ। ‘মেক ইন ওড়িশা’ কনক্লেভে যোগ দিতে স্বয়ং হাজির রিলায়েন্সের কর্ণধান মুকেশ আম্বানি। আদানি গোষ্ঠীর পয়লা নম্বর কর্তাও হাজির। টাটাগোষ্ঠী তো আছেই। আর আছে আরও এগিয়ে চলার ভাবনা। প্রায় এক মাস ধরে চলবে বিশ্বকাপ। ওড়িশা পর্যটন দফতর রেলে ক্যাটারিং পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা আইআরসিটিসি-র সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আকর্ষণীয় ট্যুর প্যাকেজও বানিয়ে ফেলেছে। সমুদ্র আর আকর্ষণীয় সংস্কৃতি তো আছেই। আছে বহু শতকের সংস্কৃতি ও বিভিন্ন ধরনের স্থাপত্যশৈলির হাজারো নিদর্শন।
কিন্তু ওঁরা কোথায়? ভুবনেশ্বর স্টেশন চত্বরে পাইনি, আশপাশে দোকান-বাজারে, রেস্তোরাঁর এদিকে ওদিকে – কোথাও নেই! তিলোত্তমা কলকাতা ওঁদের নিয়েই যে বাঁচে। ঝটিকা সফর ভুবনেশ্বরে ভিখারি দেখতে দেয়নি। পুরীর জগন্নাথ মন্দির ঘিরে যাঁরা, ভুবনেশ্বর শহর তাঁদের লুকোল কোথায়? কর্পোরেট কারসাজি? আসলে বাজি জিততে মরিয়া ঈশ্বরের ভুবন, শহর ভুবনেশ্বর।
২৭ নভেম্বর শাহরুখ-মাধুরী-রহমানের ত্রিধারায় মাততে চলেছে শহর। ৮০০ জন পারফর্মার রোজ গা গরম করে চলেছেন আর্থ সং-এর তালে থিম ফুটিয়ে তুলতে। জনপ্রিয় ওড়িয়া নায়ক সব্যসাচী মিশ্র আর নায়িকা আর্চিতা সাহু থাকবেন উদ্বোধনী উনুষ্ঠানে। শহর ছাড়িয়ে রাজধানী, রাজধানীর গণ্ডী টপকে রাজ্য। আবার তা টপকে দেশের সংস্কৃতি দিয়ে দেশ-বিদেশকে এক সূত্রে বাধার ভাবনার কাজ চলছে।
ভারতীয় হকি দলও এই পরিবেশ আর পরিকাঠামোতে মানিয়ে নিয়েছে। এখন সেই স্লোগানের কাউন্টডাউন শুরু – চক দে ইন্ডিয়া।