মুম্বাই লবির রাজনীতি না থাকলে গোপালস্যার স্বচ্ছন্দে টেস্ট খেলতে পারতেন
বাংলার নতুন প্রজন্মকে তৈরির দায়িত্ব এখন অন্য কারও উপরে বর্তাবে
- Total Shares
খানিক ভয়ে ভয়েই ফোনটা করেছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না বিষয়টি তিনি কী ভাবে নেবেন। আসলে, সে বছর রঞ্জিতে আমি রান পাচ্ছিলাম না। অসুবিধা হাচ্ছিল। কিন্তু সমস্যার সমাধানগুলো ঠিক ঠাওর করতে পারছিলাম না। অবশেষে, এক সতীর্থের পরামর্শে ফোন করে বসলাম গোপাল বসুকে।
ফোন করার পর বুঝলাম, যতটা ভয় পেয়েছিলাম ততটা ভয় পাওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না। মন দিয়ে তিনি আমার কথাগুলো শুনলেন। আমার সমস্যাগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিলেন। এবং পরের দিনই সিএবির নেটে আমাকে ডেকে পাঠালেন। সেদিন ঘণ্টাখানেক কাটিয়েছিলাম গোপালস্যারের সঙ্গে। শুধু একটা কথাই বলব সেই এক ঘণ্টার কথা আমি জীবনে কোনও দিন ভুলব না। শুধু কয়েকটি বেসিক টিপস দিয়ে ছিলেন যা শিক্ষানবিশ পর্যায়ে আমার রপ্ত করা উচিত ছিল। আর ওই বেসিক টিপসেই বাজিমাৎ। আমি আবার রানে ফিরলাম। ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া অবধি আমি ওই টিপসগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম।
আরও একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। বাংলার নেটে সেদিন গোপালস্যার এসেছিলেন। বল করছিলেন সেই বাংলা দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ বোলার ডেভিডদা (উৎপল চট্টোপাধ্যায়)। হঠাৎ ডেভিডদার কাছে গিয়ে স্যার বললেন, "তুমি কিন্তু একটু বেশি জোরে ছুটছ।" দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারকে এ রকম শিক্ষানবিশ পর্যায়ের টিপস দিতে দেখে আমরা জুনিয়ররা কতকটা অবাকই হয়ে ছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে ডেভিডদাকে বলতে শুনলাম, "ধন্যবাদ, গোপালদা। কিছুতেই বুঝতে পার ছিলাম না সমস্যাটা কোথায়। রানআপের গতি কমাতেই বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করছি।"
বঙ্গ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা কোচ প্রয়াত
এই ছিলে গোপাল বসু। একেবারে ছোট ছোট ভুলগুলো যে ভাবে ধরিয়ে দিতেন এবং সমস্যার সমাধান বাতলে দিতেন যে দাওয়াই আপনার কাজে আসতে বাধ্য। তাই তো আমার মতে বাংলার অন্যতম সেরা কোচ তিনিই। দেবাং গান্ধী থেকে শুরু করে রণদেব বসু, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে লক্ষ্মীরতন শুক্লা - সবাই তো গোপালস্যারের হাতে গড়া। বাংলা থেকে যে সমস্ত ক্রিকেটার ভারতীয় দলের দরজায় কড়া নেড়েছেন বা খেলার সুযোগ পেয়েছেন তার একটা তালিকা বানাতে বসলে দেখবেন গোপালস্যারের ছাত্রদের সংখ্যাই বেশি।
শুধু কোচ কেন, ক্রিকেটার হিসেবেও তিনি ছিলেন অনবদ্য। একটা সময় টেস্ট দলের ওপেনার হিসাবে সুনীল গাভাস্করের সঙ্গী হিসেবে তাঁর নামটাই সব চেয়ে বেশি আলোচিত হত। ১৯৭৪ সালে তিনি একটি মাত্র বেসরকারি টেস্টে সুযোগ পান। গাভাস্করের সঙ্গে জুটি বেঁধে ওপেনিং উইকেটে ১৯৪ রান করেন। প্রথম ও একমাত্র বেসরকারি টেস্টে শতরান করে আউট হয়েছিলেন তিনি। বোর্ড সভাপতি একাদশের হয়েও একটি ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেস ব্যাটারির বিরুদ্ধে তিনি ৪৪ রানের একটি অনবদ্য ইনিংস খেলে ছিলেন।
Gopal Bose, the former Bengal opener and captain, passed away on Sunday, 26 August, aged 71.He was part of India's squad for the England tour in 1974, and featured in one one-day international – his only appearance for India – at The Oval.↪️https://t.co/5BbabUFEi6 pic.twitter.com/iL2J8pRfzA
— ICC (@ICC) August 26, 2018
Lost a very dear person today ..luckily he was with his entire family in Birmingham ..will miss him ..may his soul rest in peace pic.twitter.com/yiqgMjicSR
— Sourav Ganguly (@SGanguly99) August 26, 2018
এর পর আর কোনও দিনও টেস্ট খেলার সুযোগ পাননি। আমার স্থির বিশ্বাস, ভারতীয় ক্রিকেটের মুম্বাই লবির রাজনীতির শিকার না হলে গোপাল স্যার কিন্তু চুটিয়ে দেশের হয়ে টেস্ট খেলতেন। সেই প্রতিভা স্যারের ছিল।
শুধু ওপেনার হিসাবে নয়, অফ স্পিনার হিসাবেও গোপালস্যার ছিলেন দুর্দান্ত। ১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ড সফরে ওভালে একটিমাত্র একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলবার সুযোগ পান তিনি। সেই ম্যাচে ১৩ রান করেন আর বল হাতে ডেভিড লয়েডের উইকেটটা তুলে নেন তিনি। বাংলার হয়েও বছরের পর বছর চুটিয়ে অফস্পিন করেছেন তিনি।
দেশের হয়ে খেলতে পারতেন। একটা সময় পূর্বাঞ্চল ও মুম্বাই লবি যদি রাজনীতি না করত তা হলে গোপাল বসু অবশ্য়ই চুটিয়ে ভারতীয় দলে খেলতেন।
কয়েক মাস আগে শেষ দেখা হয়েছিল গোপালস্যারের সঙ্গে। আমি ইডেনের কিউরেটরের দায়িত্ব পালন করছি বলে তিনি যারপরনাই খুশি। আমাকে বললেন, "কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রাক্তন ক্রিকেটারদের খুব একটা বেশি এই কাজে দেখা যায় না। মন দিয়ে কর। যদিও কোনও পরামর্শের দরকার পড়ে আমাকে অবশ্যই জানিও।"
রবিবার সকালে স্যারের ছেলে তথা একসময় কালীঘাট ক্লাবে আমার সতীর্থ পপের (অরিজিৎ বসু) কাছ থেকে স্যারের মৃত্যু সংবাদটা পেলাম।
ভবিষ্যতের দেবাংদের তৈরি করবার দায়িত্বটা এবার অন্য কাউকে নিতে হবে।