বিশ্বকাপই ধোনির বিদায়ী মঞ্চ হতে চলেছে, তিনি কি পারবেন ইমরান হয়ে উঠতে?
না পারার কারণ নেই, জয়সূচক রানটা তো ছক্কা হাঁকিয়েই নিতে পছন্দ করেন
- Total Shares
ন্যাটা ব্যাটসম্যানটা সবেমাত্র নেমেছে। ছোট পায়ে খেলছে। একটা স্লিপ বাড়িয়ে আর একটা সিলি পয়েন্ট রেখে অফস্পিনারকে রাউন্ড দ্য উইকেটে আসতে হবে। ফ্লাইট মিস করলেই উইকেটের পিছনে জমা পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিংবা, বড্ড বেশি ডিফেন্সিভ হয়ে যাচ্ছি। ক্লোজ ইন ফিল্ডারের সংখ্যা বাড়িয়ে ব্যাটসম্যানদের উপর চাপ বাড়াতে হবে। এই উইকেটটা খুব গুরত্বপূর্ণ। একটা সময় ছিল যখন তিনি নাকি মাঠে দাঁড়িয়ে সর্বদাই স্ট্রাটেজি নিয়ে চিন্তা করতেন, অধিনায়ক না থাকলেও। কারণ তিনি খেলাটাকে উপভোগ করতেন।
নিজের অবসরের সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুনীল মনোহর গাভাস্কার বলেছিলেন, "এর পর একটা সময় এল যখন আমি মাঠে দাঁড়িয়ে অহরহ ঘড়ি দেখতে শুরু করলাম - কখন লাঞ্চ ব্রেক হবে বা কখন চা-পানের বিরতি হবে। বুঝলাম আমি আর খেলাটা উপভোগ করতে পাচ্ছি না। অর্থাৎ, এ বার ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর সময় এসেছে।"
জয়সূচক রানটা ছক্কা হাঁকিয়েই নিতে পছন্দ করেন ধোনি [ছবি: এএফপি]
১৯৮৭ সালের মার্চে টেস্ট থেকে অবসর নিয়েছিলেন গাভাস্কার। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেঙ্গালুরুতে ভারত হারলেও শেষ ম্যাচেও ম্যাচের সেরা হয়েছিলেন গাভাস্কার। দ্বিতীয় ইনিংসে লড়াকু ৯৬ রানের জন্য। এর মাস আটেক পর ১৯৮৭-এর বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল নিজের ঘরের মাঠ মুম্বাইতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শেষ একদিনের ম্যাচটি খেলেছিলেন তিনি। ইংরেজ ওপেনার গ্রাহাম গুচের সুইপ সেই ম্যাচে হারিয়ে দিয়েছিল ভারতকে। খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি গাভাস্কার। মাত্র চার রান করেই প্যাভিলিয়নে ফিরতে হয়েছিল তাঁকে।
শেষ একদিনের ম্যাচে রান না পেলেও বা শেষ টেস্ট বা একদিনের ম্যাচে দল হেরে গেলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সুনীল গাভাস্কারের প্রস্থান অবশ্য মাথা উঁচু করে হয়েছিল। ফর্মের তুঙ্গে থাকতে থাকতেই নিজেকে সরিয়ে ফেল - এই মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। আর অবসরের ক্ষেত্রেও তাঁর টাইমিংটা ছিল নিখুঁত।
সবাই সচিন তেন্ডুলকর বা স্টিভ ওয়া নন যে বিদায় ম্যাচের মঞ্চ একেবারে প্রস্তুত থাকবে। সচিন শেষ টেস্ট খেলবেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তাও আবার ঘরের মাঠ মুম্বাইতে। আর, শেষ টেস্ট ইনিংসে (পড়ুন আন্তর্জাতিক ইনিংসে) করবেন ৭৪ রান। কিংবা স্টিভ ওয়া শেষ টেস্ট খেলবেন ঘরের মাঠ সিডনিতে। আর জীবনের শেষ টেস্টে অধিনায়োকোচিত ৮০ রানের ইনিংস খেলে দলকে নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করবেন।
সবাই আবার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও নন। খাল কেটে কুমির এনে ক্রিকেট জীবনের অন্তিম লগ্নে দল থেকে বারংবার বাদ পড়বেন। তারপর নিজের বিদায়ী মঞ্চ তৈরি করে দলে ফিরেই অবসরের কথা ঘোষণা করবেন। আর শেষ টেস্টে ৮৫ রান করে (যদিও শেষ ইনিংসে সৌরভ শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন) আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে মহারাজকীয় প্রস্থান করবেন।
এমন অনেক ক্রিকেটারই রয়েছেন যাঁরা বিদায় মঞ্চ পাননি। দল থেকে বাদ পড়ার পর আর কোনও দিনও দলে প্রত্যাবর্তন করতে পারেননি। আর, কোনও একদিন অবসরের ঘোষণা করে বুঝতে পেরে ছিলেন যে নিজের অজান্তে কবে একদিন যেন শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটা খেলা হয়ে গিয়েছে।
আসলে সুনীল মনোহর গাভাস্কারের মতো অবসরের সময়ে টাইমিংটা সকলের নিখুঁত হয় না।
আজকে অবসর নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে কারণ ভারতীয় ক্রিকেটের আর এক মহানক্ষত্রের ক্রিকেট জীবন একেবারে অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। টেস্ট ক্রিকেট থেকে আগেই তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। একদিনের ক্রিকেটে বিশ্বকাপ অবধি তাঁকে রাখা হবে কিনা তা নিয়ে চলছে জোর বিতর্ক। আর, এরই মাঝে, টি-২০ দল থেকে দুম করে বাদ দিয়ে দেওয়া হল তাঁকে।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে - ভারতীয় ক্রিকেটের মিস্টার কুল মহেন্দ্র সিং ধোনি মাথা ঠান্ডা রেখে সেই নিখুঁত টাইমিংয়ে নিজের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শেষ করতে পারবেন তো?
প্রথমেই বুঝতে হবে গাভাস্কারের যুগ আর বিরাট কোহলির যুগের মধ্যে একটা বড় তফাৎ রয়েছে। দুই প্রজন্মের ক্রিকেটারাই (আর পাঁচটি পেশার মতোই) ক্রিকেট জীবনের শেষ লগ্নে এসে আতঙ্কে ভোগেন। আতঙ্কে ভুগবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুই প্রজন্মের আতঙ্কের কারণটা যে ভিন্ন।
বিশ্বকাপে ধোনিকে প্ৰয়োজন পড়বে বিরাটদের [ছবি: এএফপি]
গাভাস্কারের প্রজন্মে আতঙ্কের কারণটা ছিল শুধুই দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ হারানো। ধোনিরা দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে যারপরনাই গর্ব অনুভব করেন। অবসর নিলে সেই সুযোগটা তিনি হারাবেন। আর সেখান থেকেই আতঙ্কের শুরু। তবে বিরাট যুগে অবসর নিতে গেলে আতঙ্কের অন্য একটি কারণও রয়েছে - স্পনসর, কোটি কোটি টাকার এন্ডোর্সমেন্ট। আপনি যত বড়ই কেউকেটা হোন না কেন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে না থাকলে ভারতীয় দলের সাজঘরে প্রবেশের ছাড়পত্র না থাকলে, এন্ডোর্সমেন্ট কমতে বাধ্য। আর এই আতঙ্কও তাড়া করে বেড়ায় ক্রিকেট জীবনের শেষ লগ্নে চলে আসা ক্রিকেটারদের। এই আতঙ্কই তো টাইমিংয়ের গন্ডগোল করে দেয়।
ধোনি ভক্ত হিসাবে আমার আতঙ্ক শুরু হয়ে গেছে। মহেন্দ্র সিং ধোনির টাইমিংয়ে কোনও গন্ডগোল হবে না তো? দেশকে দু'দুটি বিশ্বকাপ দিয়েছেন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি, তাঁর বিদায় বেলা বেদনাদায়ক হলে তা মেনে নেওয়া যায় না।
কিন্তু আতঙ্ক হচ্ছে। কারণ সম্প্রতি টি-২০ দল থেকে বাদ পড়েছেন তিনি।
ভাবতে অবাক লাগে, ২০১৮ সালের তো শুরুতেই আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে অনবদ্য খেলেছিলেন তিনি। তাঁর অধিনায়কত্বে চেন্নাই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। টুর্নামেন্টে ঝুড়ি ঝুড়ি রান করেছিলেন তিনি। সেই টুর্নামেন্টে ধোনির গড় ছিল ৭৫.৮৩ ও স্ট্রাইক রেট ১৫০.৬৬। এই টি-২০ লিগের পর মাত্র দু'টি একদিনের সিরিজ খেলেছে ভারত। আর সেই দুটো সিরিজেই রান পাননি বলেই আজ ভারতীয় টি-২০ দলে নেই ধোনি।
মাত্র দুটি সিরিজে রান পাননি বলেই কি তাঁকে বাদ দেওয়া হল? না, একেবারেই নয়। বাদ নয়, ধোনিকে বার্তা দেওয়া হল টি-২০ জাতীয় দলের জন্য এবার 'নতুন মুখের' সন্ধান শুরু হয়ে গিয়েছে। আর, ভারতের রিজার্ভ বেঞ্চ এখন যা শক্তিশালী তাতে 'নতুন মুখের' সন্ধান পেতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না।
১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ জিতেই অবসর নিয়েছিলেন ইমরান খান [ছবি: এএফপি]
তা হলে, মহেন্দ্র সিং ধোনির সামনে শুধুমাত্র একদিনের ক্রিকেট পড়ে রইল? কিছুদিন আগেই ডেইলিও তে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল যেখানে বলা হয়েছিল মহেন্দ্র সিং ধোনিকে বিশ্বকাপ অবধি একদিনের দলে রেখে দেওয়া উচিত। লেখকের সঙ্গে আমিও এক মত। বিশ্বকাপে বিরাটদের ধোনিকে প্রয়োজন হবে।
কিন্তু তার পর? পাঁচ বছর পরের বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখে এরপর একদিনের দলের জন্যও 'নতুন মুখের' সন্ধান শুরু করে দেবে টিম ম্যানেজমেন্ট। তাঁর মানে কি বিশ্বকাপকেই বিদায়ী মঞ্চ হিসেবে বেছে নেবেন ধোনি?
আর বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতেই অবসর নেওয়ার মধ্যে একটা আলাদা উন্মাদনা রয়েছে। পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এই উন্মাদনার কথা সবচেয়ে ভালো জানেন। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল মেলবোর্নে ইংল্যান্ডকে হারিয়েই অবসরের কথা ঘোষণা করেছিলেন ইমরান।
ধোনি কি পারবেন নিজের অবসরের টাইমিংটা ঠিক রাখতে? ইমরান খানের মতোই ধোনির বিদায়ও কি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে?
না পারার তো কারণ নেই। জয়সূচক রানটা তো বরাবরই ছয় মেরেই নিতে পছন্দ করেন ধোনি।