এজবাস্টনে প্রথম টেস্টে কেন হারতে হল ভারতকে
মাত্র ১৯৪ রান তাড়া করতে ব্যর্থ ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা
- Total Shares
অধিনায়ক বিরাট কোহলির হাল অধিনায়ক সচিনের মতো হবে না তো! নেতা হয়ে রান করে যাবে, দল হারবে। দুর্দান্ত ফিল্ডিং করে দলকে ম্যাচে ফেরাবে। কিন্তু দল হারবে। এমন হতে হতে সচিন অধিনায়কত্ব ছেড়েছিলেন। কোহলি কী করেন তাই দেখার।
১৫টি সেশনের লড়াই ১০টিতেই শেষ। হার চতুর্থদিন লাঞ্চের আগেই, আরও ৫টি সেশন বাকি থাকতেই। ৩১ রানে হার: মনে হবে দারুণ লড়ে হার। হার কিন্তু হারই, তা সে ১ রানে হোক আর কয়েকশো রানেই হোক, ১ উইকেটে হোক আর ১০ উইকেটেই হোক। সিরিজে তো পিছিয়ে পড়া।
হার শব্দটা ভীষণ অপছন্দ কোহলির। জয় ছাড়া তাঁর মন খুশ হয় না। ইংল্যান্ডের মাটিতে তাঁর ব্যাটিংয়ে সাফল্য ছিল না। এবার শুরুতেই সেঞ্চুরি, তাও ‘একা কুম্ভ’ হয়ে লড়ে। টেস্ট সিরিজের প্রথম ইনিংসেই যখন খেলা শুরু করলেন, তখন নন-স্ট্রাইকার এন্ড থেকে দেখলেন দলের স্কোর ১০০/৫। তখন ২৯.২ ওভার। দল তাড়া করছিল ইংল্যান্ডের ২৮৭ রান।
‘লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’ - তেমনটাই করছিলেন। টেল এন্ডারদের নিয়ে ২৭৪ রান পর্যন্ত টানলেন। প্রায় ৪০ ওভারের লড়াই। নিজে ১৪৯ রানের লড়াকু ইনিংস দলকে দিলেন। বিপক্ষ জানল, এ বার বিরাটই বিরাট বাধা। মাত্র ১৩ রানে পিছিয়ে পড়ার পর বিপক্ষকে ৭ উইকেটে ৮৭ রানে ঠেলে দেওয়া মানে, ইংল্যান্ডের কাছে ‘জোর কা ঝটকা’। কিন্তু সদ্য দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নামা কুড়ি বছরের কুরান ৬৫ বলে ৬৩ রান করে সেই ঝটকায় ‘ধীরে সে লাগা’ ট্যাগ বসিয়ে দিলেন।
অধিনায়ক বিরাট কোহলির হাল অধিনায়ক সচিনের মতো হবে না তো
১৯৪ রান মানেই সিরিজের প্রথম টেস্ট জয়। রান তাড়া করতে ধাওয়ানরা নেমেছিলেন, নাকি তাড়াতাড়ি রান করতে নেমেছিলেন! তাড়া তো করা শুরু করেছিলেন ইংল্যান্ডের বোলাররা!
২৪.৩ ওভারে ৭৮ রানে আবার ভারতের ‘পঞ্চপাণ্ডব ব্যাটধারী’ ড্রেসিংরুমে হাজির! আবার সেই একটাই নাম: বিরাট কোহলি। ১৩০ কোটির যাবতীয় স্বপ্নের সওদাগর হয়ে হাল ধরা যে কী চাপের, তা কোহলি আউট হতেই তাঁর শরীরি ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছিল। শেষমেষ ৩১ রানে হার। অনেকটা এ ভাবেই একবার নেতা সচিনের ভারত, টেস্টে ক্যারিবিয়ান মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরেছিল ৩৮ রানে। সেদিনও তীরে এসে তরী ডোবে, এবারও বিদেশের মাটিতে সেই ‘রিপ্লে’।
ব্যর্থতায় প্রশ্ন বেশি মনে ভিড় করে।
আম ক্রিকেটপ্রেমী হিসাবে প্রশ্ন আমারও আছে।
প্রথমত, এ কেমন চূড়ান্ত একাদশ? হার্দিক পান্ডিয়া অলরাউন্ডার। বোলারও নিশ্চয়? প্রথম ইনিংসে তাঁর বোলিং বিশ্লেষণ: ১০-১-৪৬-০। দ্বিতীয় ইনিংসে দল বল করল ৫৩ ওভার। তাঁর কথা ভাবাই হল না! কুরান যখন আক্রমণাত্মক মেজাজে, তখন তো একবার তাঁকে বল দিয়ে দেখা যেত! একটি ওভারও ওঁকে দেওয়া হয়নি।
অধিনায়ক সৌরভ একবার চ্যাম্পিয়ান ট্রফি ম্যাচে শেষ ওভার সেওয়াগকে দিয়ে স্পিন বল করিয়ে ম্যাচ পকেটে পুরেছিলেন। দলে সেদিন কুম্বলে-হরভজনও ছিলেন।
বোলার পান্ডিয়াকে আরও বেশি ব্যবহার করা যেত
দ্বিতীয়ত, ৭ জন ব্যাটসম্যান ও ৪ জন বোলার নিয়ে নামা: এ তো বিদেশের মাটিতে ভারতের সহজ পন্থা। নেতা গাভাসকার থেকে কোহলি- সেই ‘আগে তো বাঁচো’ নীতি। কিন্তু কাজে লাগল কোথায়? ম্যাচে কোহলির একার সংগ্রহ ২০০, বাকি ছয় ব্যাটসম্যানের সংগ্রহ: ১৩৭। তা হলে?
তৃতীয়ত, ভারতের হাতিয়ার স্পিন বোলিং। অভিজ্ঞ অফ স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন। তিনি সেরাটা দিলেনও। গোটা ম্যাচে দল করল ১৪২.৪ ওভার। তিন জেনুইন পেসার আর হার্দিক মিলে করলেন ৯৫.৪ ওভার। মোট ১২ টি উইকেট ওঁদের ঝুলিতে। আর একা অশ্বিন করলেন-৪৭ ওভার। তাঁর ঝুলিতে উইকেট সংখ্যা-৭! একাই দলের প্রায় অর্ধেক ওভার করে, পেসারদের চেয়ে বেশি মেডেন ওভার ( ১১ ওভার, পেসাররা ৮)!
টিম ম্যানেজমেন্ট শুরুতেই কুলদীপের মতো চ্যায়নাম্যান বোলার নামালে, কোনটায় কম পড়তো? নাকি কোচ রবি শাস্ত্রীর প্রখর বুদ্ধি ‘আস্তিনের তলায় সেরা অস্ত্র’ সাজিয়ে রাখা মেনে নিয়েছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। আর তাই প্রথম রাতেই (প্রথম টেস্টে) ‘বেড়াল’টা মেরে দিলেন রুটরা?
তৃতীয়ত, ভারতীয় পেসারদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ইশান্ত শর্মা। তার অন্যতম কারণ, আইপিএলে সুযোগ না পেয়ে ইংল্যান্ডে এসে ক্লাবে খেলা। পরিবেশ-উইকেটকে পরখ করে রাখা। পেসারদের নেওয়া ১২টি উইকেটের মধ্যে তিনিই নিয়েছেন ছ’টি। তাও দ্বিতীয় ইনিংসে ৫টি। তাই ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের সামনে জয়ের লক্ষ্য ছিল নাগালের মধ্যে, মাত্র ১৯৪ রান।
ওপেনার শিখর ধাওয়ান ব্যাট বাগিয়ে বল ধাওয়া করে ব্যর্থ (২৬ বলে ১৩ রান)। অন্য ওপেনার বিজয়ও (২০, ৬) জয়ের রথ টানতে ব্যর্থ। তিন নম্বরী কে এল রাহুল ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ ট্যাগে বেমানান (৪,১৩)। দলের সহ-অধিনায়ক অজিঙ্কা রাহানে (১৫,২) রানের ছন্দেই নেই। কেকেআরের নেতা তথা উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান দীনেশ কার্তিক (০, ২০) যে অভিজ্ঞ, তা প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে আরও একবার ব্যর্থ।
আইপিএলে না খেলা পূজারা ইংল্যান্ডে এসে ক্লাবে খেলেছেন। বড়সড় রান পাননি, আগেও খেলেছেন। শুধু ওয়ার্ম ম্যাচের স্কোরে দল বাছাই হয়! পূজারার সাম্প্রতিক অতীতের সাফল্য সকলে ভুলে গেলেন?
চতুর্থত, নিজেদের শক্তিতে ভরসা রেখে নামা উচিত মাঠে। ৭ ব্যাটসম্যানে যদি ১৯৪ রান না তোলা যায়, তাহলে জয়ের লক্ষ্য আরও কমাতে হবে। স্পিন যখন আমাদের হাতিয়ার তখন দুই স্পিনার নিয়ে নামা উচিত— অশ্বিন আর কুলদীপ। দরকার কী অলরাউন্ডারের- যাঁকে ব্যবহার করা হবে না। আইপিএলেও তো বল-ব্যাটের টক্কর। টেস্টেও তাই। পান্ডিয়াকে উপর থেকে ভিভ-গেইলদের মতো হাবভাব দেখালে চলবে না, ভিতরে ততটাই শক্তপোক্ত হতে হবে। বোলারকে আড়াল করে ক্রিজে ব্যাট হাতে লড়ে একা দলকে জেতানোর মানসিকতা আনতে হবে। বাকি তিন পেসারকে নিয়ে আরও নিখুঁত হওয়ার মন্ত্র শানাতে হবে বোলিং কোচ ভরত অরুণকে।
পঞ্চমত, প্রাক্তন সফল ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে হালেই একটি ইউটিউব শো-তে বলতে শুনলাম, "সকাল-সকাল রবির কোনও ইন্টারভিউ নিও না। ও বুঝতেই পারে না, কি বলছে।" কোনও সন্দেহ নেই, এটা রসিকতা মাত্র। কিন্তু সূক্ষ খবরও। শাস্ত্রীর সেই টম বয় ইমেজ এখনও অন! সে হোকগে।
ওপেনার শাস্ত্রী জানতেন, তাঁর অফ স্টাম্পটি কোথায়। ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গারের চেয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা আর সাফল্য অনেক বেশি। এবার নেটে হাতে-নাতে করে দেখান না ধাওয়ান, মুরলী, রাহুল, রাহানে, পূজারা, কার্তিকদের? ওহ্, তালিকা লম্বা হয়ে গেল!! রবির ‘মধ্যপ্রদেশ’ পারবে তো এতটা চাপ নিতে? নিতে কিন্তু এই সফরেই হবে। অন্যথায়, প্রাক্তন এক সফল ভারতীয় অধিনায়ক কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে অপেক্ষা করছেন।
পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজের আলাদা মজা আছে। দুটো ম্যাচ হেরে গেলেও সিরিজ জেতা যায় তিনটি ম্যাচ জিতে। কোহলি শুরুতেই ফর্মে। অশ্বিন, ইশান্তরাও। বাকিদের গা গরম হলেই , অন্য ভারতীয় দল হবে। চলুন, আমাদের মতোন চাষারা আশাতেই বাঁচি।