বাঙালিও শরিক, তাই ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসে আবেগ আছে বঙ্গের ক্রিকেটপ্রেমীদের
গেঞ্জি উড়িয়ে বার্তা দিয়েছিলেন, 'তুমি গাভাস্কার-সচিনের পাড়ায় যা করতে পার আমি গ্রেসের বারান্দাতেও তা করতে পারি'
- Total Shares
একটা সময় ছিল যখন বাঙালি পড়ুয়ার অন্যতম সেরা ঠিকানা ছিল ইংল্যান্ড। ছেলে বিলেত পাড়ি দিয়েছে বা ছেলে বিলেত ফেরত মানেই সেই ছেলের দাম বাড়তে বাধ্য। চাকরির বাজারে, বিয়ের বাজারেও। সুকুমার রায় থেকে শুরু করে সুভাষচন্দ্র বসু - রানি ভিক্টোরিয়ার-রাজা পঞ্চম জর্জের দেশ থেকে উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি নিয়ে আসা কৃতি বাঙালির সংখ্যা কিন্তু নেহাতই কম নয়।
একটা সময় ছিল যখন বর্ষাকালের কলকাতার ময়দানের সেরা গন্তব্য ছিল ইংল্যান্ড। মে মাসের শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের শুরু অবধি ঘোর বর্ষায় ময়দানে ক্রিকেট বন্ধ থাকে। আর, এই অফ সিজিনেও অনুশীলনের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে কলকাতার ক্রিকেটাররা ছুটতেন ইংল্যান্ডে। ওখানে ক্লাব ক্রিকেট খেলতে। দেবাং গান্ধী থেকে শুরু করে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় - শহরের প্রথম ডিভিশন ক্রিকেট খেলা অধিকাংশ ক্রিকেটারই বর্ষাকালে ইংলিশ ক্লাব ক্রিকেট খেলতে যেতেন।
প্রথম বাঙালি টেস্ট অধিনায়ক পঙ্কজ রয়ে
সেই অযোধ্যা আজও আছে। কিন্তু তার অতীতের জৌলুস অনেকটাই ফিকে। ইঞ্জিনিয়ার হতে চাওয়া বাঙালি এখন উচ্চশিক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নিয়েছে। কাউন্টি ক্রিকেটের জৌলুসও এখন অনেকটাই কম। উল্টে, ভারতীয় ক্রিকেটের রমরমা বাজার। সব মিলিয়ে স্বাধীনতার সাত দশক পর ভারতীয়দের কাছে ইংল্যান্ডের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই কমেছে।
তাই বলে কি ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ঐতিহ্য ফিকে হয়ে গেছে? কখনই নয়। ভারত পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে যতই আলোড়ন সৃষ্টি হোক না কেন অ্যাসেজ সিরিজের ঐতহ্য এখনও সর্বজনবিদিত। লর্ডস এখনও বিশ্ব ক্রিকেটের মক্কা। এর সঙ্গে রয়েছে সে দেশের ক্রিকেট মাঠগুলতে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঐতিহাসিক চিত্রনাট্য, যার অনেকগুলোই তো ক্রিকেট লোকগাথা হয়ে গেছে। এই ইতিহাসগুলো তো সহজে ভোলার নয়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাঙালি ক্রিকেটারের প্রতিনিধিত্ব যতই কম থাকুক না কেন, এ বঙ্গের ক্রিকেট প্রেমিকরাও এই ইতিহাস মনে রাখবেন। কারণ এর মধ্যে কয়েকটি ইতিহাসের শরিক তো বাঙালি নিজেই।
লর্ডসে টেস্ট অভিষেক
টনটনের সেই সর্বোচ্চ রানের ইনিংস
প্রথম বাঙালি টেস্ট অধিনায়ক পঙ্কজ রায়। ১৯৫৯ সালে একটি মাত্র টেস্টে তিনি ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর, তাঁর ভারতীয় দলের ব্লেজার গায়ে চাপিয়ে টস করতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ইংল্যান্ডেই। যে কোনও বাঙালি ক্রিকেটপ্রেমীর কাছে এই তথ্য কিন্তু অজানা নয়। এর পর আবার ৩৭ বছরের অপেক্ষা। আবার ইংল্যান্ডের মাঠে বাঙালির ক্রিকেট ইতিহাস।
ছিয়ানব্বই সালের ২২শে জুন। লর্ডসে অভিষেক টেস্টেই সৌরভের শতরান। সেদিন সৌরভের শতরানের দৃশ্যটা অবশ্য টিভিতে দেখা হয়নি। অন্য একটি খেলার সরাসরি সম্প্রচার করবে বলে ভারত ইংল্যান্ড ম্যাচের সম্প্রচার মাঝপথেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বাঙালিকে সৌরভের শতরানের খবর পেতে হয়েছিল রেডিওতে ধারাবিবরণী শুনে। তবে সেই আফসোস পরের ম্যাচেই সুদে আসলে পুষিয়ে নেওয়া গিয়েছিল। নটিংহ্যামের পরের টেস্টেও সৌরভের শতরান। গোটা বিশ্ব দেখল রবিন হুডের পাড়ায় বাঙালির ইংরেজ শাসন।
বিলেতের মাঠে বাঙালির শাসন অবশ্য শুধু টেস্ট ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে বসেছিল বিশ্বকাপের আসর। আর, বিশ্বকাপ অভিযানে শুরুতেই ধাক্কা খেল আজহারের ভারত। প্রথম তিনটে ম্যাচ হেরে কোনওক্রমে কেনিয়ার সঙ্গে জিতে পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল ভারত। সেই স্বপ্ন পূরণের মাঝে তখন দাঁড়িয়ে তৎকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা ও 'ঘরের মাঠের' ইংল্যান্ড। দুটি ম্যাচই জিততে হবে ভারতকে। ভারতের স্বপ্ন অবশ্য পূরণ হয়েছিল। আর, তা বাঙালির হাত ধরেই।
টনটনে ১৫৮ বলে ১৮৩ করলেন সৌরভ। বলতে গেলে ভিভিয়ান রিচার্ডসের কাউন্টি মাঠে শ্রীলঙ্কার বোলারদের সঙ্গে ছেলেখেলা করলেন সৌরভ। একদিনের ক্রিকেটে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কপিল দেবের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন সৌরভ। পরের ম্যাচ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। আর, বৃত্তি বিঘ্নিত ম্যাচে ভারতের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন সৌরভ। তাঁর সিম বল সেদিন ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দিয়ে ভারতকে পরবর্তী রাউন্ডে তুলে দিয়েছিল।
ক্রিকেট যতদিন থাকবে ততদিন এই ছবিটাও থাকবে
ইংল্যান্ডের মাঠে ইতিহাস সৃষ্টিকারী পারফর্ম্যান্স অবশ্য অনেকেরই আছে। আর, এই পারফর্ম্যান্সগুলোই তো ইংরেজ ক্রিকেটকে এখন ও ঐতিহ্যমণ্ডিত করে রেখেছে। কিন্তু মাঠের বাইরেও ইতিহাস ক্রিকেট সৃষ্টি হয়েছে ইংল্যান্ডে। আর তা হয়েছে একজন বাঙালির হাত ধরেই। ২০০২ সালে তৎকালীন ভারত অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে। ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনালে মহম্মদ কাইফের জয়সূচক রান আর ক্রিকেট মক্কা লর্ডসের বারান্দায় সৌরভের খালি গায়ে গেঞ্জি ওড়ানো। ঐতিহ্যের পূজারীরা এই দৃশ্য দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন, হয়েছেনও। কিন্তু তাই বলে ইতিহাস তো মুছেফেলতে পারবেন না।
কয়েক মাস আগেই মুম্বাইতে একটি একদিনের সিরিজের শেষ ম্যাচে ভারতকে হারিয়ে মাঠের মধ্যেই গেঞ্জি খুলে দৌড়িছিলেন অ্যান্ড্রু ফ্লিন্টফ। অনেকেই মনে করেন এটা তারই উত্তর। বার্তাটা বেশ পরিষ্কার - 'তুমি গাভাস্কার সচিনের পাড়ায় যা করতে পার, আমিও গ্রেসের স্মৃতিবিজড়িত বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই কাজটাই করতে পারি।'
বিরাটের ভারত এখন বার্মিংহ্যামে টেস্ট খেলেছে। দলে বঙ্গজ প্রতিনিধি বলতে শুধুই শামি। ঋদ্ধিও এখন ইংল্যান্ডে, তবে টেস্ট দলের প্রতিনিধি হিসেবে নয়, চিকিৎসা করাতে।
তাতে অবশ্য বাঙালির কিছু এসে যায় না। বিরাটদের সমর্থন করার পাশাপাশি ইংল্যান্ড ক্রিকেট নিয়ে আবেগতাড়িত হওয়ার যথেষ্ট কারণ বাঙালির রয়েছে।