বিরাট কোহলি অসাধারণ, কিন্তু পাতৌদি বা দ্রাবিড়ের যোগ্য নন
কোহলির আগ্রাসনে স্পোর্টসম্যানশিপের অভাব রয়েছে, যা দ্রাবিড়ের মধ্যে ছিল
- Total Shares
এই মুহূর্তে বিরাট কোহলিকে কিংবদন্তি বলা যেতেই পারে। তিনি একজন চ্যাম্পিয়ন। আর, গোটা বিশ্বই চ্যাম্পিয়নদের কুর্নিশ করেন। তাঁর শারীরিক ভাষা আক্রমণাত্মক আর তাঁর ক্রিকেট রেকর্ড ঘটলে মনে হয় গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস খুলে বসেছি। তিনি একজন দক্ষ অধিনায়ক ও একজন অনবদ্য ব্যাটসম্যান। সর্বপরি, একজন আদর্শ নেতা।
বর্তমানের মধ্যবিত্তদের বিপণন বিশ্বে ব্যাঙ্ক থেকে পানীয় সমস্ত রকমের পণ্যেরই বিজ্ঞাপনে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা অনস্বীকার্য। তাঁর মধ্যে এমন একটি চ্যারিশ্মা রয়েছে যা তাঁর দলের আর কারুর মধ্যে নেই। তাঁর আবেগ, তাঁর ফিটনেস, তাঁর অগ্রাসন সকলকেই মুগ্ধ করে। ভারতীয় দলে তাঁর উপস্থিতি কিন্তু দলের মিলিত শক্তির চাইতেও বেশি।
ক্রিকেটার বিরাট কোহলির মধ্যে কিছু একটার অভাব রয়েছে [ছবি: রয়টার্স]
বর্তমান বিশ্ব সাফল্যের পিছনে দৌড়ায়। আর, এই যুগের অন্যতমশ্রেষ্ট প্রতিনিধি তিনি। তাঁর বিবাহের কথায় আসা যাক। তাঁর বিবাহকে কেন্দ্র করে প্রচার তুঙ্গে ছিল। অনুষ্কাকে বিয়ে করেছেন তিনি। আর, অনুষ্কা ও বিরাট একেবারে একে ওপরের পরিপূরক। অথচ, এই সব গুন্ থাকা সত্ত্বেও বিতর্ক কিন্তু বিরাটকেও তাড়া করে বেড়ায়। আর, ঠিক এই প্রসঙ্গে আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পড়ে গেল। আমার গল্পটা পুরানো হতে পারে। কিন্তু যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।
ক্রিকেটের পটপরিবর্তন
একদল ক্রিকেট ভক্তদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময়ে আমি বিরাটের প্রতি তাঁদের মনোভাবের কথা জানতে চেয়েছিলাম। দেখলাম বিরাটের পারফরমেন্স ও কীর্তি নিয়ে তাঁরা যারপরনাই উৎফুল্ল। বিরাট যে টেস্ট ক্রিকেটে সবচাইতে দ্রুত শীর্ষে উঠে এসেছে সে ব্যাপারে তাঁরা প্রত্যেকেই একমত।
কিন্তু এত হাইপ, এতটা অগ্রাসন, এতটা গতিময় এবং এতটা সাফল্য থাকা সত্ত্বেও কোহলির মধ্যে কিছু একটার অভাববোধ রয়েছে।
কেন জানি না সৌরভ, লক্ষণ, সচিন কিংবা দ্রাবিড়ের সামনে তিনি যেন কেমন ফিকে। তাঁদের মধ্যে একটা বিশেষ ধরণের চরিত্র লক্ষ করা যেত। যা কোহলির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না।
বিষয়টি একটু বুঝিয়ে বলা যাক।
ক্রিকেট শব্দটি কিন্তু ক্রিকেট খেলাটির থেকে অনেক বড়। ক্রিকেট একটি খেলা কিন্তু রূপকার্থে ক্রিকেট শব্দটি কিন্তু ক্রিকেট খেলাটিকেও ছাপিয়ে যায়।
নিজেকে প্রমান করতে পাতৌদির পরিসংখ্যানের প্রয়োজন পড়ে না [ছবি: টুইটার]
ক্রিকেট একটি জীবনধারাও বটে।
সম্প্রতিকালে ক্রিকেট সংক্রান্ত বইগুলো যত বেশি সমাজতান্ত্রিক হয় তার চাইতে আত্মকথা ধর্মী হয়ে থাকে। এই বইগুলোতে বেশ মজার মজার কথা প্রকাশ করা হয়ে থাকে। তবে এই ঘটনাগুলো নেহাতই ছোট। ক্রিকেট লোকগাথা নয়।
এ প্রসঙ্গে নবাব পাতৌদির কথা বলা চলে।
একজন রাজপুত্র হয়েও ভারতীয় ক্রিকেটকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে তিনি দিনরাত মেহনত করে গিয়েছেন। এরাপল্লী প্রসন্নের কথা শুনলেই তাঁর চরিত্রের একটি বর্ননা আন্দাজ করে নেওয়া যেতে পারে।
পাতৌদি অধিনায়ক ছিলেন। তাঁকে পরিসংখ্যান দিয়ে প্রতিভার পরিচয় দিতে হয়নি। তাঁর নেতৃত্বের মানটাই অন্যরকম ছিল। তিনি এমন একটি আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করেছিলেন যা ক্রিকেটের চাইতেও বৃহৎ ছিল। তাঁর অধিনায়কত্ব ইতিহাসে স্থান করে নেওয়ার যোগ্যতা রাখে। কোহলি কিন্তু অধিনায়ক পাতৌদি নন। পাতৌদি একটি পরিকাঠামো তৈরি করে দিয়েছিলেন। আর, কোহলি শুধুমাত্র সেই পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে নিজের কাজটি করে চলেছেন।
দ্রাবিড় বনাম কোহলি
তাঁর পরিমিত আগ্রাসনের জন্যে রাহুল দ্রাবিড়কে ভদ্র বা বিনয়ী বলা চলে।
তাঁর অ্যাকশনের চাইতেও তাঁর চিন্তাশীল অনুভূতিগুলো আমাদের নাড়া দিয়ে থাকে। তিনি ক্রিকেট নিয়ে চিন্তা করেন। কিন্তু সেই তাঁর চিন্তাতেও একটি শৈলী লক্ষ করা যায়। তাঁর চিন্তা যেন একটি জীবনধারা।
আমরা তাঁর 'ম্যাচুরিটি' সহজেই আন্দাজ করে নিতে পারি যা ওয়াইনের মতো মসৃন। উল্টোদিকে, বিরাটের অগ্রাসন যেন অনেকটাই ছোবল মারার মতো।
দ্রাবিড় যখন সকলকে নিয়ে চলতে পছন্দ করেন, তখন বিরাটকে দেখলে মনে হয় তিনি একাই একশো।
তাঁর পেশাদারিত্বের জন্যে দ্রাবিড়কে ক্রিকেট খেলাটির চিরাচরিত চরিত্রের সঙ্গে অনেকটা স্বচ্ছন্দ্য বলে মনে হয়। উল্টোদিকে, বিরাটকে দেখলে মনে হয় বাজারে একটি নতুন পণ্যের আমদানি হয়েছে। যাঁকে বাইরে থেকে দেখলে ভালোই লাগে। কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় কোথাও যেন দ্রাবিড়ের স্পোর্টসমানশিপের সঙ্গে অনেকটাই ফারাক রয়েছে।
বিরাট সকলকে আকর্ষণ করতে পারেন। কিন্তু দ্রাবিড় নিজেই আকর্ষণীয়। প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটের একজন প্রতিনিধি বিরাট। অন্যদিকে, রাহুল যেন ঠিক একজন ক্রিকেট দার্শনিক।
তাঁর মধ্যে কিছু একটা রয়েছে যা তাঁর মনুষ্যত্বের পরিচয় বহন করে। তাঁর পেশাদারিত্ব কিন্তু তাঁর চরিত্র হনন করে না।
ক্রিকেট একতাময়
ক্রিকেট খেলাটির নৈতিকতা সর্বদাই আকর্ষণীয়।
ক্রিকেট বরাবরই নৈতিকতার বার্তা দিয়ে থাকে। সিএলআর জেমস, নরম্যান ইয়ার্ডলি কিংবা এস কে গুরুনাথানের লেখা পড়লে মনে হয় ক্রিকেটের মতো নীতিপরায়ণ ক্রীড়া বিশ্বে খুব একটা বেশি নেই। ক্রিকেট এমন কিছু কথা বলে থাকে যা খেলাটির জনক ইংরেজরা বলতে পারেন না।
ইংরেজরা স্পোর্টসম্যানশিপের কথা বলে থাকে। কিন্তু ভারতীয় ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটাররা বরাবরই স্পোর্টসম্যানশিপের বিজ্ঞাপন করে গিয়েছেন। জার্ডিন, লারউড কিংবা কিথ মিলারের মধ্যে পার্থক্য তো রয়েছেই।
রাহুলকে ক্রিকেট দার্শনিক বলাই শ্রেয় [ছবি: রয়টার্স]
মিলার একজন নায়ক যিনি কখনই ক্রিকেটকে যুদ্ধ হিসেবে দেখেননি। তাঁর কাছে ক্রিকেট শুধুই একটি খেলা। তাঁর কাছে ক্রিকেট শুধুই রোমান্স। তাঁর কাছে ক্রিকেট একটি আবেগ, প্রতিযোগিতা নয়।
কিন্তু আজকের টি-২০ যুগে ক্রিকেট তো শুধুই আর খেলা নয়, প্রতিযোগিতাও বটে। যার সঙ্গে অগ্রাসন ও বাজারের মূল্যও জড়িয়ে রয়েছে। আজকের ক্রিকেটে কোনও টেবিল ম্যানার্স নেই, কোনও নীতিশাস্ত্র নেই। আজকের ক্রিকেটে একটি রাজনৈতিক ধরণ রয়েছে যা দিয়ে দেশপ্রেমকে ছাপিয়ে খেলাটিকে বিশ্বজনীন করে তুলেছে।
পাতৌদি, দ্রাবিড় ও বেদি আমার নায়ক। যাদের মধ্যে নৈতিকতা ছিল। এই নৈতিকতা শুধুমাত্র দক্ষতা নয় একজনের চরিত্র বুঝতেও সাহায্য করে। এখন ভারত জিতলেও আমি এই নায়কদের অভাব বোধ করে থাকি। বর্তমানে ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহের ভাঁটা নেই। বরঞ্চ ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে আগ্রহ তুঙ্গে। তা সত্ত্বেও সকলকে নিজের পছন্দ অপছন্দের গল্প বলার সুযোগ দেওয়া উচিত।
(সৌজন্যে: মেল টুডে)
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে